ভূত বসেছে শিয়রে, পেত্নীর লজ্জা করে

শহর জুড়ে পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। ‘তারা’ আবার ফেরত আসছে। ইয়ে-এ-এ-! তারা মানে কারা? আরে সেই ভূতের দল। এর আগে ভূতের ভবিষ্যতে ভুতেদের ভবিষ্যৎ কল্পনাতীত উজ্জ্বল করার পর পরিচালক অনীক দত্ত’র হাত ধরেই ফেরত এসেছে ভূতের দল। ছবির নাম ‘ভবিষ্যতের ভূত’। নাম দুটো কাছাকাছি হলেও, প্রথম ছবির সিক্যুয়েল নয় এটা। তবে সেই অভিযোগে কম হেনস্থা পোহাতে হয়নি অনীককে। একেবারে আইন আদালত অবধি গড়ায় ব্যাপারটা।

কিন্তু ভূতের ভবিষ্যৎ তো বাঙালির রক্তে মিশে গেছে। দুটোই ভূত-পেত্নীদের নিয়ে ছবি। তাই দর্শকের অপেক্ষা ছিল ভবিষ্যতের ভূত কিরকম ছবি হবে, তাই নিয়ে। ১৫ ফেব্রুয়ারী মুক্তিও পেল ছবিটি। আর ঠিক একদিনের মাথায় প্রথম শো’এর পর, ছবিটিকে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ এল কোনও অদৃশ্য ‘হায়ার অথরিটি’ থেকে। যারা আগাম টিকিট কেটে পরের দিন  ছবিটি দেখতে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হল যে ভবিষ্যতের ভূত গায়েব হয়ে গেছে।

কারণ? অজানা। অনেকবার জানতে চাওয়া হয়েছে, কিন্তু কারোর কাছেই কোনও সদুত্তর নেই। সবাই ধাঁধায়। এই ঘটনা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে চলচ্চিত্র এবং দর্শক মহলে এবং অবশ্যই আরো বেশী মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয়। সবারই মুখে কুলুপ, কারণটা যদিও প্রায় সবাই জানে। একটা ছবিকে মুক্তি পাওয়ার পরের দিনই রাজ্যের সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ থেকে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা অন্তত ‘সাধারণ’ কারোর নেই, সরকার ছাড়া।

হারানো লেত্তি, হারানো লাট্টু

একটা ছবি বন্ধ হয়ে যাওয়া বা প্রেক্ষাগৃহ থেকে তুলে নেওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। মোটামুটি যেগুলো আখছার হয়ে থাকে, যেমন সেই ছবিটির মধ্যে কোনও খারাপ বার্তা আছে যা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর কিংবা ছবিটির মাধ্যমে কোনও জাতি বা ব্যক্তিবিশেষকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অমার্যাদা করা হয়েছে, অথবা কোনও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতা বা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ছবি বানানো হয়েছে যা সেই দলটিকে কলঙ্কিত করছে। আবার অনেক সময় সৎভাবে ছবিও বানানো হয় সমাজের বিরুদ্ধে মানুষকে জাগ্রত করার জন্য।

কিন্তু একটি আদ্যপান্ত মজার সংলাপে পরিপুর্ণ, হালকা রাজনৈতিক প্রহসনধর্মী ছবি, যাতে বেশ কিছু শ্রুতিমধুর গান, নাচ আছে এবং শাসক দলের ধারপাশও মাড়ানো হয়নি, সেই ছবি তুলে নেওয়া হল কেন? কাউকে সেভাবে আঘাত দিলে তো ছবিটি মুক্তির ছাড়পত্রই পেত না। আর এরকম ছবি তো এ রাজ্যে প্রথমবার বানানো হয়নি। এর আগেও এই ঘরানার ছবি পশ্চিমবঙ্গে রমরমিয়ে ব্যবসা করেছে।

ঝান্ডি অভিযান

কয়েক দশক পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত, সুচিত্রা সেন ও সঞ্জীব কুমার অভিনীত ‘আঁধী’ ছবিটি ভারতের সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তৎকালীন সরকারে নির্দেশে। ছবিটির পরিচালক ছিলেন গুলজ়ার। কিঞ্চিৎ দোষ ছিল আঁধীর। অনেকের বিশ্বাস, ছবিটিতে সুচিত্রা সেন অভিনীত চরিত্র আরতি দেবীকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আদলে তৈরী করা হয়েছিল। সরকারের ধারণা ছিল, এই ছবি মুক্তি পেলে ইন্দিরার ব্যক্তিত্বহানী হতে পারে। সেই সংশয়ে এবং সরকারী হস্তক্ষেপে ছবিটি মুক্তি পেতে দেওয়াই হয়নি। পরে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজ়রাল ও দুজন পেটোয়া কংগ্রেসী সাংসদ ছবিটি দেখার মুক্তির সবুজ সংকেত দেন। সেই ছবিটিতে ভারতের মহিলা প্রধানমন্ত্রী আরতী দেবীকে খুলে আম মদ্যপান এবং সিগারেট ফুঁকতে দেখানো হয়। এই দৃশ্যগুলি বিরোধী দল পরবর্তী ভোটের আগে কুরুচিকর ভাবে তুলে ধরে এবং যথারীতি ২৬ সপ্তাহ চলার পর ছবিটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সম্পূর্নি ষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

পরবর্তীকালে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার ওপর বানানো ছবি ‘পরজ়ানিয়া’ (২০০৭), ‘দাঙ্গা’ (২০১৮), পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ে ‘উড়তা পাঞ্জাব’ (২০১৬), এবং ‘পদ্মাবত’ (২০১৮) ছবিগুলিও অনেক মারদাঙ্গা, হুমকির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। রাজপুতদের একাংশের হিংসা ছড়ানোর কারণ ছিল রানী পদ্মাবতীর চরিত্রকে নাকি পদ্মাবত ছবিতে কুরূপে দেখানো হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের হিংস্র মনোভাবের কারণ ছিল ছবিতে আলাউদ্দিন খলজীর চরিত্রায়ন। যথারীতি সেই হুমকি ভয়াবহ রূপ নেয়। সেট এবং পোষাক পোড়ানোতেই ক্ষান্ত থাকেনি উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী করণী সেনা এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিবাদী মানুষজন। অবলা জীবজন্তু পোড়ানো থেকে শুরু করে ছবির পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভনশালীকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। সেই হুমকির থেকে রেহাই পেতে এবং ছবিকে মুক্ত করতে ‘পদ্মাবতী’কে পদ্মাবত নামকরণ করতে হয় আদালতের নির্দেশে।

পদ্মাবত ছাড়াও এরকম আরও অনেক ছবি নিষিদ্ধ বা প্রেক্ষাগৃহ থেকে সরিয়ে নেওয়া সত্বেও বাণিজ্যিক ভাবে অসম্ভব সাফল্য লাভ করে।

তাশি গাঁওয়ে একদিন

এখন কথা হল, ভবিষ্যতের ভূত ছবিতে ভূত-পেত্নী-শাকচুন্নী-ব্রহ্মদৈত্য বা সেরকম কারোর আদলে বা অনুপ্রেরণায় তো বানানো হয়নি। একদল বাতিল ভূতের ভবিষ্যতের গল্প বলা হয়েছে এই ছবিতে। এরকম কয়েকটি ভূত আশ্রয় নেয় একটি শরণার্থী শিবিরে। বাস্তব জগতে তারা কোনঠাসা। কোথায় থাকবে তা নিয়ে হেব্বি চাপে ভূতেদের দল। ভার্চুয়াল জগৎ না বাস্তব, কোথায় নিজেদের জন্য একটু জায়গা খুঁজে পাবে তারা, তা নিয়েই এই রহস্যময় ছবি। রীতিমত সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র হাতে নিয়ে এই ছবির বাজারে আগমন।

দূরদুরান্ত দিয়ে কল্পনা, ভাবনাচিন্তা করে চুল পাকিয়ে ফেলেও ধরা যাচ্ছে না কেন এই ছবি প্রেক্ষাগৃহে ব্রাত্য। কোনও সাধারণ বা মহামানব বা মহামানবীর আদলে তো এই ছবির কোনও চরিত্রকেই ফেলা যাচ্ছে না। কেউ নিজেদের মেলাতে পারছেন কি না সেটা অবশ্যা জানা নেই। নাহ, আমি তো কোনও বাস্তব ভূত বা পেত্নীকে এর সাথে মেলাতে পারছি না। কোনও জাতি, ধর্ম বা কোনও সম্প্রদায়কেও অবমাননা করা হয়নি। তাহলে, কোন স্বার্থে ছবিটি বন্ধ করা হল? দর্শকের কি এইটুকু অধিকারও নেই জানার? একটাই প্রশ্ন—কেন? উত্তর নেই, সবাই মূক। হাজার চেষ্টা করলেও প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ বা সরকারী দপ্তর, কারোর কাছেই কোনও জবাব নেই।

সত্যজিৎ ও রেলভূত

ভগবানের দৌলতে কান যখন আছে, খবর তো ঢুকবেই। তো সেই কান পাতলে যা শ্রবণপটাহে আঘাত করছে, সেটার যদি এক অংশও আমাদের বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে একটা গণতান্ত্রিক দেশে এর চেয়ে লজ্জাজনক কিছুই হতে পারে না। সেই অগুন্তি ন্যাক্কারজনক কাজের লিস্ট পড়তে শুরু করলে শেষ হবে না, তাই ওসবে ঢোকার দরকার নেই। কোনও সভ্য পরিণত মনস্ক ব্যক্তি অন্তত এরকম শিশুসুলভ কাজ করতে পারে না। কোনও শিল্পকে রাজনীতির রঙ দিয়ে যেমন মুড়ে রাখা সম্ভব নয়, তেমনই কোনও ক্ষমতার অপপ্রয়োগে শিল্প এবং শিল্পীকে হেনস্থা করা যায় না। এটা অনৈতিক। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার।

প্রতিবাদে এই সেদিন প্রতিটি মানুষ, কলাকুশলী জমা হয়েছিলেন অ্যাকাডেমির সামনে গাছতলায়। জীবনে বোধহয় প্রথমবার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে রাস্তায় নামতে হল একটি ছবি মুক্তির দাবীতে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাঁর প্রশ্ন, “আমার প্রথম থেকেই অদ্ভুত লাগছে। কখনও তো হয়নি এরকম। হায়ার অথরিটি নাকি বলেছে এই ছবির বিষয় থেকে গোলযোগ তৈরি হতে পারে। এ তো যথেচ্ছাচার। এ ক্ষেত্রে কি কোনও প্রতিহিংসামূলক আচরণ কাজ করছে? কারণটা অজানা এবং নিঃসন্দেহে স্বেচ্ছাচারিতার নিদর্শন।’’

শব্দ যখন ছবি আঁকে

সৌমিত্রবাবুর প্রশ্নটা আসলে সবার। কারণটা কি? কেন এই পদক্ষেপ? কোনও যথাযথ কারণ ছাড়া এই পদক্ষেপ কেউ নিতে পারে না। এটা আইনবিরুদ্ধ। সবাইকে জানানো হয়েছে ‘হায়ার অথরিটির নির্দেশ’। কে সেই অশরীরী হায়ার অথরিটি, যে পেছন থেকে কাজ চালায় অথচ জনসমক্ষে আসার মত সৎসাহস পায় না? চূড়ান্ত হাস্যকর পরিস্থিতি।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, পদ্মাবত ছবিটিকে যখন মুক্তি পেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল, এবং হিন্দুত্ববাদী একটি রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তখন ‘ঘন্টা খানেক’ মোক্ষম আলোচনা চলেছিল, সেদিন এই ‘অশরীরী’ কর্তৃপক্ষরা এবং তাঁদের ধামাধরা কিছু পরিচালকও এই ঘটনাকে অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে তাঁদের টুঁটি টিপে ধরেছিলেন। ‘ঘন্টা খানেক’ বোকাবাক্সের সামনে অযথা বসে—আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি অত্যন্ত উদারমনস্ক—এটাই মনে হয়েছিল। এ রাজ্যে সকলের সমান বাকস্বাধীনতা আছে। আমরা গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক। ফলে, কোথাও কোনও ছবিকে কেউ মুক্তি দিক বা না দিক, আমাদের রাজ্যে সেই ছবি মুক্তি পাবে, পাবেই। আমরা বুক পেতে আছি। সেক্ষেত্রে আশা করা যায়, আমাদের রাজ্য, রাজনীতি, রাজনীতিবিদ এবং বিদেহী হায়ার অথরিটি বাকস্বাধীনতা থেকে চলচ্চিত্র বানানো এবং চলচ্চিত্র উৎসব কেন্দ্রিক সর্ব বিষয়েই অত্যন্ত সুনিপুণভাবে এবং পরিনতভাবে সব স্বাধীনতা প্রকাশের পন্থী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। Fair enough. একমাত্র মহাদেবের ত্রিশুলে কন্ডোম পরালে এবং হনুমান চালিশাকে জাপানী তেল এর সমার্থক বললে সেগুলোকে দোষের আওতায় আনা যাবে না। কারণ? আরে কাকা সেগুলোই তো আসল ‘শিল্প’।

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

কথা হচ্ছিল ছবির প্রধান চরিত্র রূপালী, ওরফে চান্দ্রেয়ী ঘোষের সঙ্গে। “বিশ্বাস করো, আমরা কিছুই জানি না। লোকে বলছে রাজনৈতিক ক্ষোভের জন্য ছবিটা সরিয়ে দিল। কিন্তু সেটা কতটা সত্যি, কিংবা আদৌ সত্যি কি না, জানি না। লোকের কথাই যদি মানতে হয়, তাহলে বলব, আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। আশা করছি ঝামেলা মিটে যাবে শীঘ্রই, আবার মুক্তি পাবে ভবিষ্যতের ভূত। তবে, কোনও একটা সামান্য মন্তব্যের যদি এই পরিণতি হয়, তাহলে তো মানুষের আর কিছুই বলার থাকবে না। আমরা অন্ধকারে বাস করছি তাহলে। অশীতিপর সৌমিত্রবাবু গাছতলায় দাঁড়িয়ে একটি ছবি মুক্তির আবেদন করছেন। এটা ভাবা যায়? অথচ, শোনার কেউ নেই। কারণ কেউ নিশ্চিৎ ভাবে জানে না কি হয়েছে, কারা করছে, বা কি উদ্দেশ্যে করছে। অদৃশ্য এই হায়ার অথরিটি। আজ কোনও কারণ না দেখিয়ে ছবি তুলে নেওয়া হয়েছে, কাল হয়ত অন্য কোনও শিল্পীকে এইভাবে থামিয়ে দেওয়া হবে, বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হবে। হতেই পারে।”

তবুও আশা ছাড়ছেন না চান্দ্রেয়ী। “টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেককেই আমরা পাশে পেয়েছি। তাঁরা নিজেরা এগিয়ে এসে জানিয়েছেন, পাশে আছেন। জনসমক্ষে অনেকেই এসে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এখানে তো ‘ছবি সরিয়ে নেওয়াকে সমর্থন’ করে কথা বলার কোনো ব্যাপার নেই। ফেসবুকে এসে অধিকাংশ শিল্পীরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কারণ, এটা সেরকমই একটা পরিস্থিতি। শুধু তো আমাদের ছবির কলাকুশলীরা নন, আমাদের পাশে আছে এই ছবিতে কাজ না করা সাধারণ মানুষও। ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন অনেকেই।”

নীরবে চলে গেলেন সত্যজিতের মণিমালিকা, বিস্মৃতই রইল বাঙালি

কিন্তু ছবির মধ্যে আছেটা কি?

শোনা যাচ্ছে, রাজনৈতিক স্যাটায়ারধর্মী এই ছবিতে অনেকগুলি চরিত্র। এরকমও অনেকে আছেন, যারা বেঁচেও মরে আছেন। একসময় তাঁরা সমাজের দাপুটে ব্যক্তি ছিলেন, আজ তারা টিমটিম জ্বলছেন মাত্র। তাঁদের জীবনযাপনের কথা বলা হয়েছে। ভূত এবং ভবিষ্যৎ, এই সবটা মিলিয়ে একটা ছবি। সত্যিকার অর্থেই অতীত ও ভবিষ্যতের গল্প বলা হয়েছে এই ছবিতে। সেখানে ভূতেরাও আছে, মানুষও আছে। এখনকার যুগের অনেক সমস্যা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার একটা ব্যাপার আছে। “দূর্দান্ত চিত্রনাট্য। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে,” দাবী চান্দ্রেয়ীর। “যেমন একটা  স্যাটায়ার মানুষ আশার করেন, ঠিক তেমনটাই। কোথাও কোনও বাড়বাড়ি নেই, অসভ্যতামী নেই, অসংলগ্নতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা এখানে এমন কোনও সাজানো বা মিথ্যে ঘটনা বলা নেই, যা মানুষ জানে না, কিংবা সমাজকে প্রভাবিত করবে।”

এতসব কিছুর পরেও টালিগঞ্জের কিছু হাতে গোনা কলাকুশলী আছেন, যাঁরা নিজেদের এই প্রতিবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। কোনও সংঘাতের মধ্যে তাঁরা ঢুকতে নারাজ। তাঁদের স্টেজের ওপরে স্পটলাইটের আলোয় ‘হামি বাংলাকে ভালোবাসি’র সাথে নৈকট্য মুবারক। তাঁদের জন্য এই ‘কাঁধ ঘেঁসাঘেসি’ অনেক বেশি লাভজনক। হতেই পারে। প্রতিবাদী সহকর্মীদের পাশে দাঁড়াতেই হবে এমন দাসখত লিখে কেউ কোনও পেশায় আসেন না।

দর্শক আমাকে খল চরিত্রে দেখতে পছন্দ করেন না: ভাস্বর

তবে দমে যাওয়ারও কিছু নেই।

কোনও এক সংবাদমাধ্যমে অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমি কোনও ছবির প্রচারের শরিক নই। কিন্তু সেন্সরের ছাড়পত্র পেয়েও একটা ছবির আটকে যাওয়ার ঘটনা অভাবনীয়। বিষয়টা দর্শকদের উপরে ছাড়লেই বোধহয় ভাল হত।’’ পরিচালক তরুণ মজুমদার বলেছেন, ‘‘এটা শুধু অনীকের ছবি না দেখানোর বিষয় নয়। কোনও শিল্পীই কারোর ক্রীতদাস হতে পারে না।”

অ্যাকাডেমির গাছতলায় প্রতিবাদ সভা থেকে অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘রিলিজ়ের আগে ছবির বিষয় জানতে চেয়ে পুলিশের তরফে একটা চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কনটেন্ট জানতে চাওয়ার মানে আপনি পুলিশের নজরে আছেন। তার মানে কি ভয় দেখানো? ক’দিন আগে ব্রিগেড থেকে এত গালাগালি করা হল, তাতে কেউ ভয় পেল না, আমাদের সিনেমাটা কি তার থেকেও ভয়ের? একটা সিনেমা কি রাজনৈতিক জমায়েতের থেকে বড় হতে পারে?’’

ভাবনার বিষয় অবশ্যই।

‘‘একটি সেন্সর পাওয়া ছবি আটকানোর পিছনে কোনও অজুহাতই ধোপে টেকে না,” প্রতিবাদে বলেছেন অপর্ণা সেন। এমনকি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বেরাও গোটা ঘটনায় ধন্দে। রাজ্যসভার সাংসদ, চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীর মত, ‘‘আমি পুরোদস্তুর শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’’

পুরোনো শিল্পীদের চূড়ান্ত অপমান করা হয়, ক্ষোভ তনিমার

অবিশ্বাস্য লাগছে, না? তবুও সত্যি। এরকম হতেই পারে।

মাত্র ৮৮,৭৫২ বর্গফুটের একটা রাজ্য ভবিষ্যতের ভূত বয়কট করতেই পারে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। আরে পিসিমা, এটা কেন বুঝতে পারছেন না, যা নিষিদ্ধ তার প্রতিই মানুষের আকর্ষণ সবথেকে বেশি? আর তার জেরেই ভবিষ্যতের ভূত—যদি ধরেও নিই যে অত্যন্ত খাজা ছবি হয়েছে—রমরম করে ব্যবসা করবে। এমনিতেই আজকাল মুঠোফোনের দৌলতে সবাই অফিস যেতে যেতে বা কাজের ফাঁকে সিনেমা দেখে। হলের সংখ্যা কমতে কমতে এখন জটায়ুর টাকের চুলের থেকেও কম। যে কটি বেঁচে বর্তে আছে, সেগুলোওতেও মরচে পড়া কোলাপসিব্‌ল গেট দেখতে চান না কি? বাংলা ছবি তো হলে শো’ই পায় না। অনীকবাবু আরামসে ছবিটা কোনও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে দিতে পারতেন, কালীঘাট থেকে ক্যালিফোর্নিয়া সবাই দেখত। তখন আটকানো যেত কি?

মোদ্দা কথা হল, মিনিবাস কন্ডাক্টর সিনড্রোমে ভুগে কোনও লাভ নেই। ‘দাদা পেছন দিকে এগিয়ে যান’ না বলে, ছবিটা রিলিজ় করতে দিন। তাতে সিনেমা শিল্পটা বাঁচবে। আর কাজ হারিয়ে চপ-তেলেভাজার দোকানের সংখ্যাও বাড়াতে হবে না।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Surma

Group editor of an UK-based bilingual magazine. Former editorial staff of leading Kolkata newspapers. Children sector worker. Adaptable, amiable, affectionate, politics enthusiast, and mountain and music lover. Tiger addict. Outspoken and hypersomniac.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *