ঝান্ডি অভিযান
এমন বৈপরীত্যও কখনও জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে বৈকি। গিফ্ট অফ দ্য মেজাই-এর গল্পটা মনে আছে? যেখানে জিম তার ছিন্ন স্ট্র্যাপসহ সোনালি ঘড়িটি বিক্রয় করে দেয় প্রিয়তমা ডেলা’র সুন্দর লম্বা চুলের জন্য একটি চিরুনি কেনার জন্য, এবং বাড়ি ফিরে দেখে, তার প্রেয়সী সেই চুল বিক্রয়ের টাকা দিয়ে জিমের প্রিয় ঘড়িটির জন্য একুশ ডলারের একটি প্ল্যাটিনাম চেইন কিনে তারই অপেক্ষায় বসে রয়েছে?
লাভা’য় বৌদ্ধ মনাস্ট্রির শান্ত বাতাসে শান্তির অপার্থিব অনুভূতি মনে আসার আগেই শঙ্করদার মোবাইলে অশান্তির খবর পাওয়া গেল, রাজনৈতিক ঝামেলায় পেডং থানা জ্বালিয়ে দিয়েছে একদল দুষ্কৃতি, ডেকেছে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ। তাই এক্ষুণি আমাদের নেমে যেতে হবে, নতুবা গরুবাথানে আটকে যেতে পারি। আমি শুধু ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধের দিকে একটিবার দেখলাম, মনে মনেই নালিশ জানালাম কাজটা ভালো হলো না কিন্তু।
দেবতার গ্রাস
সকালে এসবের আঁচ ছিল না একেবারেই। বরং নতুন জায়গা দেখার বাসনা ও উষ্ণতার আমেজ ছিল সকলের মধ্যেই। মজাও করছিলাম খুব। সেই কবে গান্ধীজি করে গিয়েছেন ডান্ডি অভিযান আর আজ আমরা করব ঝান্ডি অভিযান। গতরাত্রে আবার ‘ঝান্ডি’ শব্দটিকে নিয়ে মহিলামহলের তিন রসিক সদস্যাদের মধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসাহাসিও চলছিল। তাই শুনে আমি আবার বুঝতে চাইছিলাম ঠিক কোন শব্দ বা পদার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য পেয়ে তাদের এই রসিকতা। মাথায় যা আসছিল, তা না বলাই ভালো, অশ্লীলতার দায়ে দুষ্ট হয়ে যেতে পারি।
শঙ্করদা আমাদের সারথী, মাইডিয়ার লোক। জীবনটাকে দিব্যি তার হাতে সঁপে দিয়ে প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করা যায়। গাড়ির পিছনে বসলে চেনা রাস্তাঘাটও অচেনা ঠেকে। মালবাজার ছাড়িয়ে কোন রাস্তা দিয়ে শঙ্করদা ও তার বাহন পথ বার করে চলল, তা ঠাহর করার আগেই দেখলাম আমাদের চারপাশে সবুজ চা বাগান। গরুবাথান বাজার ছাড়িয়ে ডামডিম নদী পেরিয়ে গাড়ি উঠতে থাকল। নদীর দু’পাশেই রাস্তা, ঠিক হলো আমরা একপথে উঠব আর একপথে নামব।
এদিকে গাড়ির মধ্যে অসুস্থতা কখন যে ডেরা নিয়েছে বোঝা যায়নি। প্রথমে নেহা ও তার মা, পরে তাদের সাথে যোগ দিল নেহার বাবা, সস্ত্রীক মিলন মন্ডল। একে একে আউট হতে থাকল অনেকেই। নিজেদের এনার্জি ধরে রাখার স্বার্থে ঠিক হলো রিশপ বাদ। গাড়ি পাক খেতে খেতে ওপরে উঠতে থাকে, শঙ্করদার ধারাবিবরণী চলতে থাকে আর সবুজ পাহাড় আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। পাছে আয়ু কমে যায় এই ভয়ে আমি বরাবরই কম কথা বলি। এখন তো একেবারে চুপ। ভয়ে ভয়ে আছি, রিশপ বাদ হয়ে গেছে, ঝান্ডিটাও না বাদ হয়ে যায়। কখনও সখনও এমনও ভাবছি, ওরা যদি আর যেতে না পারে তাহলে আমিই বরং থেকে যাব, ঝান্ডি হোক বা ডান্ডি একটা কোথাও বডি ফেলে দেব।
যে জন থাকে মাঝখানে
এমনিতে বেড়াতে বেড়িয়ে কোনও আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে ডেরা নেওয়া আমার একেবারেই না-পসন্দ। কেমন জানি মনে হয়, ওদের বাড়ি তো আসিনি, শুধু ওদের অবস্থানের সুবিধাটুকু নিচ্ছি। এটা আমার ঠিক বলে মনে হয় না কোনওদিনই। কাজেই ওখানে বন্ধুর কোয়ার্টার, বা মামাতো দাদার পিসতুতো শ্যালিকা থাকে, অতএব ওখানে থেকেই ঘুরব, এটা আমার অসহ্য লাগে। বরং রেলস্টেশনে বসে বসে ট্রেন ও লোক গোনা ভালো। কিন্তু নানা প্যাঁচপয়জার খাটিয়েও মিলন মন্ডলের বৌদির প্রেমে ফাটল আমি ধরাতে পারিনি। তাই গতরাত্রে আলিপুরদুয়ার থেকে মালবাজারে দাদার বাড়িতে পৌঁছেছি। একটাই প্রাপ্তি, বিয়ের বছর কুড়ি পরেও দাদা-বৌদির যা মিল ও বোঝাপড়া দেখলাম তার সিকিভাগ আমাদের মধ্যে থাকলে পরস্ত্রীর দিকে একেবারেই তাকাতে হতো না।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
আলিপুরদুয়ার থেকে মালবাজার ট্রেনরুটটি দারুণ। সুন্দর সুন্দর নামের নদী, জঙ্গল ও তার মধ্যে বন্যজন্তু দেখতে পাওয়ার বাসনা ভালো লাগবেই। নিজের মনে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঝান্ডি ঢুকে গেছি খেয়ালই হয়নি। আজ আবহাওয়াটাও খুব জুতের না। টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছে আর চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। কাঞ্চনজঙ্ঘা যে এবারেও ধরা দেবে না, তা আমি অনেক আগেই বুঝে গেছি। খিদেও পেয়েছে খুব। শঙ্করদা বলল, ওয়াই-ওয়াই খেয়ে দেখতে পারেন, ভালো লাগবে। আমি সর্বভূক, তাছাড়া খিদে পেটে ভালোমন্দ বিচার করতে যাওয়া বিয়ের মন্ডপ থেকে বউ পালানোর সামিল। অতএব ওয়াই-ওয়াই। যারা ভাবছেন ওটা আবার কি, ওয়াই-ফাই না কি, তাদের জানাই, ওয়াই-ওয়াই আসলে চাউমিন বা ম্যাগির সমগোত্রীয়। ওদেরই জ্ঞাতিগোষ্ঠী ভাবতে পারেন। নামের টানেই হোক বা খিদের তাড়নায়, একে একে পুরো ব্যাটেলিয়নই কিন্তু ওতে মগ্ন হলো। এককাপ ধূমায়িত চা নিয়ে আমি ছাদে গেলাম, চোখের সামনে পেঁজাতুলোর মতো ভেজা ভেজা কুয়াশা আড়াল করে রেখেছে কাঞ্চনকে। মনে হচ্ছে যেন বড় একটা লাঠি দিয়ে ওই আড়ালকে সরাতে পারলেই হেসে উঠবে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
প্রাত্যহিকতার রোজনামচা যদি আপনাকে ক্লান্ত করে, পরিচিত প্রতিবেশীকে যদি দিনকয়েক ভুলে থাকতে চান অথবা গিন্নীর ক্রমশ গরম হয়ে ওঠা মেজাজটাকে করতে চান ঠান্ডা, চোখ বুজে ঝান্ডি চলে যান। বেশি ঘোরাঘুরির প্রয়োজন নেই, লোকজনও কম, খুব পরিস্কার ঝান্ডি আপনার ধোঁয়াশা মাখা দাম্পত্যকে নতুন অক্সিজেন দান করবে। যে হাসি দেখে যৌবনে আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, সহধর্মিনীর ঠোঁটে সে হাসি ফিরে আসবে, কাঞ্চনের আলোয় উদ্ভাসিত হবে তার হৃদয় এবং সে আপনার কাছে আপনার স্বরচিত কবিতার ক’টা লাইন শুনতেও চাইতে পারে, যে কবিতা লেখা ডায়েরির পাতা এতদিনে হলুদ হয়ে গেছে হয়ত। আর যদি এসবের কিছুই না হয়, তাহলে আমাকে না হয় তেড়ে গালিগালাজ করবেন।
গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই
ওয়াই-ওয়াইয়ের উষ্ণতা আর ঝান্ডির ঠান্ডিতে আমাদের ব্যাটেলিয়ন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠল। গাড়ি এবার ছুটল লাভা’র দিকে। সমতলের রাস্তাঘাট আমরা যেভাবে মনে রাখতে পারি, পাহাড়ি পথে তা পারি না। একই পাহাড়ের চারিপাশের রাস্তায় হয়ত আপনি চল্লিশ বার চক্কর কেটেছেন, কিন্তু খেয়াল রাখতে পারবেন না। বিশ্বের তামাম প্রাকৃতিক সৃষ্টি এভাবেই নিজেদের রহস্যে মুড়ে রাখে নারীমনের মতোই। আপনি হাজারো চেষ্টা করলেও সে মনের নাগাল পাবেন না, তাই বুঝি প্রকৃতিকে আমরা মা বা নারী হিসেবে পুজো করে থাকি।
লাভা’য় সবুজ-কালচে পাইন গাছের আধিক্য। খাড়া খাড়া পাইন যেন সবুজ সভ্যতা গড়েছে এই গ্রামে। বিরাট বিশাল চত্বরের বৌদ্ধ মনাস্ট্রিও আপনার মনে শ্রান্ত ভাব বয়ে আনবে। সংসার ও প্রিয়জন ছেড়ে দীক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীরাও আপনাকে অবাক করবে বৈকি।
আজকাল খবরের কাগজ খুললেই নারী নির্যাতনের নানান খবর। শিউরে উঠি মাঝে মাঝে। আমিও পুরুষ, আমার মধ্যেও কি বাস করে এরকম কোনও মনোবৃত্তি? ভয় হয়, থেকে থেকে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা হয়। একটা জঘন্য ঘটনার জন্য প্রচার পায় একটা গোটা জনপদ, হয়ে ওঠে নির্যাতনের নেতিবাচক প্রতীক। রিপুর তাড়না আর পাশবিক মনোবৃত্তি মানুষকে করে তোলে জানোয়ার। আর ঠিক তখনই গৌতম বুদ্ধের প্রতি আমার শ্রদ্ধা উপচে পড়ে। কামজয়ের বিধান যদি তিনি দিয়ে থাকেন, তাহলে হয়ত তা অজান্তে সমাজেরও কিছু উপকারে আসছে। আকাঙ্খা সম্বরণের তত্বে জীবনও হয়ে উঠতে পারে সুস্থির।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
গরুবাথানে আটকা পড়িনি। শুধু একই পথে ফিরতে হয়েছিল। লাভা’তে আরও কিছুটা সময় কাটাতে পারলে হয়ত ভালো হতো। এতসবের পরেও আমার একটাই জিজ্ঞাস্য, আগুন যাকে পায় তাকেই পোড়ায়। কোনও বাছবিচার কোনওদিনই সে করে না। তবুও আমরা আগুন নিয়ে খেলি কেন?
কিভাবে যাবেন: নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছোট গাড়ি
কোথায় থাকবেন: বেশকিছু হোমস্টে রয়েছে
ছবি: তন্ময় শিরোমণি ও প্রবুদ্ধ নিয়োগী