তাশি গাঁওয়ে একদিন
সান্তালিখোলাকে পেছনে ফেলে আরও ২ কিমি পথ পেরিয়ে এবার হাঁটার পালা। শুরুতেই সামান্য প্রস্তুতি। তারপর আমার এবারের একমাত্র সফরসঙ্গী রাজাদা বলল, ‘চল এবার শুরু করা যাক।’ রাজাদা পেশায় সাংবাদিক, নেশা ভ্রমণ। চরৈবেতি তার মজ্জায়।
না, আর কোনও বাড়তি কথা নয়। শুধু দুপাশের সবুজে ঘেরা চড়াই পাথুরে পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। বন্য সবুজের গন্ধ, ঝিঁঝি পোকার ডাক, আর ছোট-ছোট পাহাড়ি ঝর্ণার বয়ে যাওয়ার শব্দ আমাদের সঙ্গী। আরও কিছুটা পথ। দু-একটা বসতি আর সঙ্গে বাহারি প্রজাপতির সঙ্গে খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম ঐতিহাসিক বক্সা ফোর্ট। এবার সামান্য বিশ্রাম।
আলাপ হলো মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে। জানা গেল তারাও যাবে তাশি গাঁও। ঘাম মুছতে মুছতে আবার হাঁটা শুরু। সঙ্গের পাঁচ লিটার জল প্রায় শেষ। পথের বাঁকে স্থানীয় লোকজন পেয়ে সামান্য আলাপ সেরে নেওয়া। শরীরে ক্লান্তি কিন্তু মনের এক অদ্ভূত ভালোলাগা নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে আমরা পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে।
না, এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পাহাড়-সবুজ-নদীতে ঘেরা এক বিরাট উপত্যকা। আর আছে এক মাথা খোলা আকাশ। তারপর পেটের দাবি মিটিয়ে বেরিয়ে পড়া তাশি গাঁও দর্শনে।
সন্ধ্যা নামলো। এবার বসে থাকা উপত্যকায়। ইতিমধ্যে এসে উপস্থিত পথে আলাপ হওয়া সেই ৪/৫ জন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্মীরা। যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মহিলাদের পশুপালন এবং পশুজাত দ্রব্য উৎপাদনের শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
তারা এসেই ঘোষণা করলো, ‘আমাদের কাজ সেরে গানবাজনা করব। আপনারাও সঙ্গে থাকবেন কিন্তু।’ আকাশ তারায় তারায় ভরা। ধীরে ধীরে শুরু হল নেপালি, রাভা, হিন্দি এবং বাংলা ভাষায় গান ও নাচ। আমাকে অবাক করে দিয়ে রাজাদাও দুহাত তুলে কোমর দুলিয়ে খানিক নেচে নিলো ওদের সঙ্গে। আর নিজস্ব আড়ষ্টতায় বসে রইলাম আমি।
নাচগানের পর ঠিক হলো আন্তাক্ষরি খেলা হবে দুই দলে ভাগ হয়ে। রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত চললো ওই চার ভাযার গানে এই খেলা। এবারও আমি কেবলই শ্রোতা।
দেবতার গ্রাস
অনিতা শর্মা, ক্লান্তি মারাক, রুমা রাভা। এছাড়া আরও কয়েকজন দিনের পর দিন যে আক্লান্ত পরিশ্রম করে পাহাড়ি মহিলাদের স্বনির্ভর করে চলেছে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। পথে বেরিয়ে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে এও এক সঞ্চয় বটে।
রাত্রি আরও গভীর। তারারা যেন ঝিলিক দিচ্ছে সারা আকাশ জুড়ে। নিচে কিছু জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। নিস্তব্ধ চারপাশ। পরের দিনের নেমে আসার পরিকল্পনায় আমরা। রাজাদা জীবনানন্দ, শক্তি, সুনীলের কবিতা শুরু করলো। প্রত্যেকটা শব্দ যেন জীবন্ত হয়ে চোখেপর সামনে হাজির। মুহূর্তে মনে হলো, তারাভরা নিশ্চুপ নিশুতি রাতে অশরীরীর প্রকাশ ঘটছে এই বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে একান্তে। আমিও আবিষ্কার করলাম আমার চেনা এক অচেনা মানুষ, রাজাদাকে, নিজের মতো করে।
ছবি: মানিক
লেখা ও ছবি বেশ ভাল লাগল। আরো বেড়ানোর গল্প পড়তে চাই।