হারানো লেত্তি, হারানো লাট্টু
‘আমপাতা জোড়া জোড়া/মারবো চাবুক চলবে ঘোড়া/ওরে বিবি সরে দাঁড়া/আসছে আমার পাগলা ঘোড়া…’ কেন খেলতাম কেউ জানে না। কিন্তু খেলেছি আমরা সবাই। ক্লাসের অফ পিরিয়ডে, টিফিনে খেতে খেতে, বাড়ির রকে, ছাদের পাঁচিলের ধারে, সামনের এক চিলতে মাঠে, দুই হাতে তালি মেরে গড়গড় করে বলে যেতাম। সবাই কখনও না কখনও প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে খেলে নিয়েছি একটু। সুর করে বলার মধ্যে অদ্ভুত এক তৃপ্তি ছিল।
এরকমই খেলা ছিল ‘ইকিরমিকির চাম চিকির চামে কাটা মজুমদার, ধেয়ে এলো দামোদর…’ কিংবা ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, ঢাল মেঘর ঘোঘর বাজে…।’ কিসের ছড়া, কি তার মানে কেউই জানতাম না। আসলে এগুলো ছিল টাইমপাসের খেলা। আজকের দিনের মত তখনও ছোটদের জীবনে সময় এত অপ্রতুল হয়ে যায়নি। স্কুল থেকে ফেরা আর পড়তে বসার মধ্যে হাতে অঢেল সময় থাকত খেলাধুলা করার। আবার পড়াশোনা শেষ করে রাতের খাবার খেতে যাওয়ার আগেও অনেকটা সময় পেতাম আমরা। তাই সময় কাটানোর জন্য নানান মজার খেলা তখন জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল।
কত রকমের খেলা দিয়ে যে সাজানো ছিল আমাদের ছোটবেলাটা, আর সেসব কবেই বা হারিয়ে গেল টেরই পেলাম না আমরা। যেমন ছিল ‘রস কষ শিঙাড়া বুলবুলি মস্তক’, এও এক মজার ইনডোর গেম। লুডো, সাপলুডো, চাইনিজ় চেকার কিংবা দাবা, এসব তখন নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। রবিবারে সারাদিন বোর্ড পেতে ক্যারাম পেটানো ছিল বহু বাড়ির চিলেকোঠার চেনা ছবি।
সে ছিল আমাদের সত্তর-আশির দশক। খুব ছোটবেলায় ছিল পুতুল খেলা। পুতুলের সংসার সামলাতে গিয়ে সঙ্গে থাকত খেলনাবাটি। সেখানে পুতুলের বিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সেই বিয়েবাড়ির মেনু ঠিক করা অবধি, সবই আমরা খুব দক্ষতার সঙ্গে করে থাকতাম। সেই প্রাচীনকালে আশির দশকের কোনও এক গোধূলি লগ্নে আমার নীল স্যুট পরা ছেলের সঙ্গে বান্ধবীর বার্বি পুতুলের বিয়ে দিয়েছিলাম। যদিও কনেটি ছিল আমার ছেলের চেয়ে বেশ কিছুটা লম্বা, তবু সোনার আংটি বেঁকা হয় না বলেই বোধহয় মেয়ের মা বিয়েতে আপত্তি করেননি। মেনু ছিল ঝাল মটর, মাছ লজেন্স, রঙবেরঙের পপিন্স, পিপারমেন্ট আর হজমিগুলি। সবশেষে মৌরি লজেন্স। ছেলে-বৌকে বরণ করে ঘরে তুলেও অষ্টমঙ্গলায় সেই যে তারা শ্বশুরবাড়ি গেল সেই ইস্তক ছেলে আমার ঘরজামাই হয়েছিল বলে এক সপ্তাহ মনের দুঃখে খেলতে যাইনি।
বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
যাক সে কথা। যে বয়সে আমরা পুতুল খেলছি সেই সময় ছেলেদের ছিল গুলতি বা গাছের ডাল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। কেউ কেউ আবার লাট্টু বা চটপটি নিয়ে মেতে থাকত সারা বিকেল।
এ তো গেল ঘরের খেলা। মাঠে গিয়ে বা বাড়ির উঠোনে যে কতরকমের খেলা তখন চলত তার ইয়ত্তা নেই। স্কুল থেকে ফিরে কোনওরকমে নাকে মুখে গুঁজে মাঠে দৌড়। ততক্ষণে সেখানে হাজির একপাল ছেলেমেয়ের দল। যাদের সকালে স্কুল থাকত, তাদের রীতিমতো হিংসে হত, ওরা কেমন চারটে বাজতে না বাজতেই মাঠে চলে আসে। আমাদের আসতে পাঁচটা বেজে যায়। তারপর কখনও ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আবার কখনও বা বড় দল করে শুরু হয়ে যেত খেলা। ক্রিকেট ফুটবল নয়, সেসব তখন বড়দের খেলা ছিল। আমরা খেলতাম ছোঁয়াছুঁয়ি কিংবা লক-অ্যান্ড-কি।
আবার কোনও কোনওদিন দুজন মুখোমুখি হাত ধরে উঁচু করে দাঁড়িয়ে শুরু হয়ে যেত ‘ওপেনটি বায়স্কোপ, টাইটুই টায়স্কোপ, চুল টানা বিবিয়ানা, সাহেব বাবুর বৈঠকখানা…’, বাকিরা তখন হাতের তলা দিয়ে এক এক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। শেষ লাইনে এসে একজনকে ‘গলায় দেব ফুলের মালা’ বলে বরণ করে নেওয়া হত। আর উঠোন বা ছাদের খেলা ছিল এক্কা দোক্কা কিংবা কিতকিত। দুটোই ঘর কেটে খেলা হত। এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলতে হত। স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে যে যার ঘুঁটি সংগ্রহ করে আনত।
এদিকে আমাদের ছাদে কিতকিত চলছে তো ওদিকে হয়ত পাশের বাড়ির ছাদে তখন চলছে হইহই করে ঘুড়ি ওড়ানো। বিকেল হলেই আকাশের দিকে তাকালে শুধু নানা রঙের ঘুড়ির বাহার দেখা যেত তখন। তার কোনটাও মুখপোড়া, কোনওটা পেটকাটি, কোনওটা চাপরাস তো কোনওটা চাঁদিয়াল। আর থেকে থেকে কোনও না কোনও ছাদ থেকে আওয়াজ উঠত ‘ভোকাট্টা!’
যে মৃত্যু আজও রহস্য
ছুটিতে মামারবাড়ি গেলেই কিছু বাঁধাধরা খেলা ছিল আমাদের। যেমন কুমিরডাঙা। মাঝে খোলা উঠোন আর একদিকে একটা লাল রঙের রক, দিব্যি জমে যেত ‘কুমির তোমার জলকে নেমেছি’ বলে ডাকাডাকি। আবার কখনও মামাতো মাসতুতো ভাইবোনেরা সবাই এলে দলে ভারি হতে পারলে দুটো দল বানিয়ে উঠোনে সার দিয়ে বসে নাম পাতাপাতি খেলা। দারুণ জমে যেত। দু দিকে দুটো দল মুখোমুখি বসত। যে ক্যাপ্টেন সে সকলের নাম দেবে। কোনও দল ফুলের নাম নিল তো কোনও দল হয়ত মিষ্টির নাম নিল। এই নাম দেওয়া হত আবার কানে কানে। যার নাম, শুধু সেই জানবে। দলের সকলের নাম দেওয়া হয়ে গেলে ক্যাপ্টেন অন্য দলের কোনও একজনের চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে তার দলের কোনও একজনকে ডাকবে, ‘আয় তো রে আমার ডালিয়া,’ কিংবা ‘আয় তো রে আমার চন্দ্রপুলি।’ ক্যাপ্টেনের নামকরণ অনুযায়ী তখন ডালিয়া বা চন্দ্রপুলি এসে সেই চোখ বন্ধ করা খেলোয়াড়ের মাথায় একটা হালকা চাঁটি মেরে ফিরে যাবে। এবার সেই খেলোয়াড়ের চোখ খুলে দিয়ে বলা হবে কে মেরে গেছে খুঁজে বার করো। খেলা ভালোই জমত তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দলের লোকজনের ইশারার ঠেলায় বেশিরভাগ সময়ই তুমুল ঝগড়া হয়ে খেলা ভেস্তে যেত।
আবার কখনও ছোট দল হলে দুই দলে ভাগ হয়ে শুরু হয়ে যেত, ‘এলাডিং বেলাডিং শৈল কিসের খবর আইল, রাজামশাই একটি বালিকা চাইল, কোন বালিকা চাইল? নিয়ে যাও নিয়ে যাও বালিকা, চলে এসো চলে এসো বালিকা।’ তবে রাজামশাই হঠাৎ বালিকা চেয়ে পাঠাতেন কেন সে প্রশ্ন সে সময় মনে জাগেনি কখনও।
আর একটা খেলা ছিল লন্ডন। একজন দেয়ালের দিকে ফিরে চোখ বুজে বলবে এল-ও-এন-ডি-ও-এন-লন্ডন, এর মধ্যে বাকিরা উল্টোদিকের দেয়ালের দিক থেকে তার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তাকে ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করবে। এছাড়া ছিল গো-স্ট্যাচু খেলা। একজন খেলাবে, সে সবাইকে গো বললে তারা নিজেদের জায়গায় ঘুরতে থাকবে, আর স্ট্যাচু বললেই তারা এক একরকম ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে পড়বে। তখন বিচারকের কাজ হবে এদের হাসাবার চেষ্টা করা। সেই চেষ্টায় সফল হলেই সে আউট হয়ে যাবে। কেউ কেউ যদিও হাজার প্ররোচনাতেও হাসত না। সে জিতে যেত।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
শীতকালে পিকনিকগুলো ছিল আর এক খেলাধুলার জায়গা। তখন পিকনিক মানেই ডিজে বা মিউজ়িক বক্সের বাড়াবাড়ি ছিল না। হাসি গল্প গান আর খেলা দিয়ে কেটে যেত সারাটা দিন। সেই সব পিকনিকের দিনে একটা প্রিয় খেলা ছিল পাখি ওড়ে, মাছ ওড়ে। সবাই যে যার জায়গায় দাঁড়িয়েই খেলতে পারত। যে খেলাবে সে এক এক করে বলবে কাক ওড়ে, কোকিল ওড়ে। সবাই তখন দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে ওড়ার মতো করে হাত দোলাবে। এর মধ্যে কখনও কখনও বলা হবে কুকুর ওড়ে, সিংহ ওড়ে কিংবা মানুষ ওড়ে। এগুলোয় হাত তুললেই আউট হয়ে যেতে হবে। যদিও বিচিত্র সব তর্কাতর্কি শোনা যেত সেই নিয়ে। যেমন: ‘কুকুরকে যদি প্লেনে করে কোথাও নিয়ে যাই তাহলে তো সে ওড়ে। তাই আমি আউট হব না।’ এবং সব শেষে, ‘খেলব না।’
পিকনিকে মিউজ়িকাল চেয়ার খেলাও একেবারে বাঁধাধরা ব্যাপার ছিল তখন। বাচ্চা, বড় সবাই মিলে সমান উৎসাহে কতগুলো চেয়ার জোগাড় করে তার চারপাশে ঘুরে তারপর চেয়ারে বসার জন্য হুড়োহুড়ি করছে এ জিনিস বাঙালীর পিকনিকে খুব চেনা দৃশ্য ছিল। আর ছিল দড়ি টানাটানি। সে টানের চোটে মাঝে মাঝেই দু দলের লোকজন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেত। তবু উৎসাহে কোনও ঘাটতি ছিল না। সবাই তখন করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে মুডে প্রাণপণে টেনে চলেছে।
মাঠে গিয়ে দল বেঁধে খেলার মধ্যে রুমাল চোর, লুকোচুরি, পিট্টু, গোল্লাছুট, বুড়ি বাসন্তী এমন আরও কত কি যে ছিল তখন। লুকোচুরির ইনডোর সংস্করণ ছিল ডার্করুম খেলা।
সেসব শৈশব কৈশোরের দিনগুলোয় তখন না ছিল পরীক্ষা নিয়ে টেনশন আর না ছিল মোবাইল গেমের হাতছানি। কেউ কখনও ভয় দেখায়নি রেজাল্ট ভাল না হলে বাড়িতে আর থাকা যাবে না, বোর্ডিং কিংবা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সত্যি, সে বড় নিশ্চিন্ত সময় ছিল আমাদের জীবনের। বাইরে যত দুষ্টুমি যত বেয়াদপি করেই এসো না কেন, ঠিক কোনও না কোনও মামা, কাকা, পিসি, মাসি, ঠাকুমা কিংবা দিদিমা রক্ষা করবেই। ভয় কাকে বলে, স্ট্রেস কি, আতঙ্ক কার নাম, চাপ কিভাবে নিতে হয় এসব ভাবনা কখনও আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করেনি। প্রতিযোগিতা আর ইঁদুর দৌড় কিভাবে একটার পর একটা প্রজন্মকে ক্রমশ পঙ্গু করে দিতে থাকল সে আমরা নিজে চোখে দেখেছি, দেখছি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি, তার ভালো দিক যেমন অসংখ্য তেমন তার খারাপ দিক ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও অগুনতি। ধীরে ধীরে তা গ্রাস করছে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। আর আমরা তা দেখছি হাত পা বাঁধা বন্দীর মত অসহায় হয়ে।
নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি এসব দিনগুলি স্কুলবেলায় উপভোগ করার জন্য। লেখাটি পড়ে যেন শৈশবের রঙীন দিনগুলোয় পরিভ্রমণ করলাম। সব খেলা হয়তো খেলিনি তবে ‘ফল ফুল নাম দেশ’, ‘মাংস চোর’, ‘কানামাছি’ এবং আরও কিছু আজও মনে গেঁথে আছে। এমনকী ঘরোয়া খেলা গুলো আজও সময় পেলেই খেলি। লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন সুন্দরভাবে ফেলে আসা স্মৃতি উসকে দেওয়ার জন্য।