শব্দ যখন ছবি আঁকে
বেতার প্রযোজনা—ইংরাজিতে যাকে radio production বলা হয়—বেশ উচ্চমার্গীয়, গালভরা, এবং অভিজাত একটি শব্দ। কিন্তু মুস্কিলটা হল, এটা খায় না মাথায় দেয়? মনের মধ্যে ঠিক এই চিন্তাটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রথম যখন কথাটা শুনি।
সালটা ২০০৮-০৯ হবে। আমি তখন ইঞ্জিনিয়রিং পাঠরত। দক্ষিণ কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি বেতার কেন্দ্র থেকে একটা অফার পেলাম প্রযোজক হবার। চিরকালের গানপাগল ছেলে আমি। তা ছাড়া মনের ভিতরে একটা ভবঘুরেও আছে যে কি না সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে চায়। তাই কাজে জুটে গেলাম।
প্রথম দিনের লেকচারটা আজও মনে আছে: “বেতার প্রযোজনায় আসতে হলে বা রেডিও প্রোডিউসার হতে গেলে শুধুমাত্র পুঁথিসর্বস্ব বিদ্যা থাকলে চলবে না।”
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
নাহ্, ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। কিন্তু বেশ মনে ধরেছিল কথাটা। যত দিন গেছে তত বুঝতে পেরেছি রেডিও প্রোডিউসারের কাজ চোখ-কান পঞ্চমেন্দ্রিয় খোলা রাখা। অনেকটা ফেলুদার গল্পে সিধু জ্যাঠার মতন। তবে এক্ষেত্রে তফাৎ একটাই। অনবরত সবকিছু খেয়াল রেখে তা আপন মনের মাধুরি মিশায়ে নতুনভাবে উপস্থাপন করা। মানে গাছ থেকে আপেল পড়া দেখলে বুঝতে হবে যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে।
বেতার প্রযোজনার তিনটে ধাপ আছে: প্রি-প্রোডাকশন, প্রোডাকশন, এবং পোস্ট-প্রোডাকশন। কিন্তু সবকিছুর জন্য সর্বপ্রথম যেটা দরকার, তা হল একটি রেকর্ডিং স্টুডিও। এ হল সেই জায়গা যেখানে বাইরের কোনও আওয়াজ আসে না আর সেখানেই যাবতীয় শব্দগ্রহণের কাজ হয়ে থাকে।
Advertisement
যে কোনও রেকর্ডিং স্টুডিওরই অনেকগুলো কম্পোনেন্ট থাকে। এর মধ্যে প্রধান দুটি হল চ্যানেল মিক্সার ও মাইক্রোফোন। এটা কিছুদিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম। আর তারও পরে জেনেছিলাম মাইক্রোফোনেরও আবার কিছু শ্রেণীবিভাগ আছে। এগুলো হল unidirectional, যা কেবল একদিকের শব্দই রেকর্ড করে; bidirectional, যা দুই দিকের শব্দ রেকর্ড করে; এবং omnidirectional, যা সবদিকের শব্দ রেকর্ড করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও আছে lapel, অর্থাৎ জামা বা কলারের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছোট্ট মাইক্রোফান, এবং boom বা gun মাইক।
দেবতার গ্রাস
কিন্তু ফাটাফাটি লেগেছিল প্রথমবার যখন বেতার প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করি। কোনও একটা শো বা অনুষ্ঠান কেন জনপ্রিয় হয়? এই প্রশ্নটা শুরুতেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। স্বচ্ছন্দে বলা যায়, এক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল অনুপাতের পরিকল্পনা।
শুনতে বেশ অদ্ভুত লাগল, তাই না? কিন্তু অদ্ভুত লাগলেও, এটাই সত্যি। বেতার প্রযোজনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত অনুপাতের বিষয় খেয়াল রাখা উচিত সেগুলো নিম্নরূপ।
১. বিষয়বস্তু বা topic এবং সেই বিষয়ের ওপর চিত্তাকর্ষক কিছু তথ্য যা এখনও অনেকেরই অজানা।
২. কোন কোন বিষয় রাখা হবে তার একটি তালিকা এবং সেই সমস্ত বিষয়কে ঠিকভাবে সাজিয়ে একটি চিত্রনাট্য লেখা।
৩. সাবলীল বাচনভঙ্গী ও সুন্দর কন্ঠস্বর, যা একজন উপস্থাপকের (চলতি ভাযায় রেডিও জকি) প্রধান সম্পদ।
৪. সঙ্গীত ও আবহ।
আবার শুধুমাত্র গান নিয়েও বেতার অনুষ্ঠান করা যায়। যে কোনও অনুষ্ঠানের title track-এ গান থাকতে পারে। এছাড়াও প্রতিটি বেতার কেন্দ্রর আলাদা signature tune থাকে যা কিনা সেই রেডিওর এক নিজস্ব পরিচয় তৈরি করে দেয়।
‘রেডিওর হৃদয় জুড়ে সঙ্গীত’। এই কথাটা যখন প্রথম শুনি তখন কান এবং প্রাণ দুটোই জুড়িয়ে গেছিল। পরে যত দিন গেছে তত বুঝতে পেরেছি কথাটার মর্ম।
এ কেমন জীবন
সঙ্গীত মানে আবহ ও গান। দুটোর কোনও একটা যদি না থাকে, তাহলে রেডিওর প্রাণটাই থাকবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আবহ দিয়ে রেডিওর time frame থেকে আমেজ, সবকিছুই বর্ণনা করা যায়। যেমন ভোরের সময় বোঝাতে গেলে বাঁশির সুরে ভৈরবী আথবা পুরবী, বা পাখিদের কলতান ব্যবহার করা হয়।
ফিরে আসি প্রযোজনার অভিজ্ঞতায়।
প্রথমবার প্রযোজক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছিল, শো পরিকল্পনা করাটাই আসল। এবং সত্যিই তাই। এই পরিকল্পনার পর্যায়ই হল প্রি-প্রোডাকশন, যার কথা আগেই বলেছি। এর পরের অংশটি হল সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুয্ঠানটিকে সম্প্রচার উপযোগি করে তোলা। এই পর্যায়ে দুটি ভাগ থাকে। এক: রেকর্ডিং, এবং দুই: সম্পাদনা। শো সম্পাদনার শেয পর্যায়ে আসে packaging যা অনুষ্ঠানটিকে, শ্রোতারা ঠিক যেমন ভাবে শুনবেন, তেমন ভাবে উপস্থাপন করে। সব শেযে আসে পোস্ট-প্রোডাকশন, অর্থাৎ যে প্রোডাক্টটি তৈরি হল, তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া।
সত্যি বলতে কি, ব্যাপারগুলো পড়তে বা লিখতে যতটা ভালো লাগে, কাজের সময় ঢের বেশি আনন্দ হয়। আর সেই আনন্দে ভর করেই বেতার প্রযোজক হিসেবে কাটিয়ে দিলাম প্রায় এক দশক।
Khub sundor hoyechhe Gourab
wonderful write up!! All the very best in your endeavours..way to go!!