সত্যজিৎ ও রেলভূত
বাংলা, মানে বৃহত্তর বঙ্গদেশের সঙ্গে ভূতের যোগাযোগ একেবারে আত্মিক। বাঙালি ‘ভূত’ বস্তুটিকে বড় ভালোবাসে। তারা ভূতের গল্প পড়তে ভালোবাসে, ভূতুড়ে ছবি দেখতে ভালোবাসে, এমনকি ভৌতিক পরিবেশে ভূতের গল্প শোনাও তাদের কাছে যে কোনও অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়ার মতোই রোমহর্ষক। এ হেন বাঙালি যদি কোনওভাবে খবর পায় কোনও বিশেষ জায়গায় ভূতের উপদ্রব শোনা গেছে, তাহলে হইহই করে দল বেঁধে সেখানে বেড়াতে চলে যায়। ভূত যদি সেখানে থেকেও থাকে তাহলে ওই বাঙালির উৎপাতেই আর সে তল্লাটে থাকে না।
একেবারে হালের ঘটনাই ধরা যাক। বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল পুরুলিয়ার বেগুনকোদর রেল স্টেশনে নাকি তেনাদের যাতায়াত। এক স্টেশন মাস্টার ও তাঁর স্ত্রীর খুনের পর সেই স্টেশনে নাকি আর কোনও ট্রেন দাঁড়ায় না। বর্তমানে গুল্পের মহাপীঠ ইন্টারনেটে বেগুনকোদর নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। বহু মানুষ ভূত দেখার আশায় সেখানে অভিযানে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কেউ বা কোনও শব্দ শুনেছেন হয়ত। তবে সত্য ঘটনা সামনে আসতে সময় লাগেনি। এক সংবাদমাধ্যম অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে বেগুনকোদরে ভূতের কোনও অস্তিত্বই নেই। ফাঁকা স্টেশন চত্ত্বর সন্ধ্যা নামলেই চলে যায় সমাজবিরোধীদের দখলে। ভূতের গল্প তাদেরই অপপ্রচার। নির্বিঘ্নে অসামাজিক কার্যকলাপ করার ঠেক হয়ে উঠেছিল বেগুনকোদর।
আরও পড়ুন: এ কেমন জীবন
বাস্তব থেকে ফিরে আসি গল্পে। সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পেও রেলভূতের উপস্থিতি ঘটেছে বেশ কয়েকবার। যেমন ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘অনাথবাবুর ভয়’ গল্পে। এই গল্পের কথক ট্রেনে চেপে রঘুনাথপুর যাওয়ার পথে আলাপ হয় অনাথবন্ধু মিত্রর সঙ্গে। আধুনিক ভারতবর্ষে অনাথবাবুর পোশাক বেশ সেকেলে ধরণের। সত্যজিৎ লিখছেন, ‘ভদ্রলোককে হঠাৎ দেখলে মনে হবে তিনি যেন পঞ্চাশ বছরের পুরনো কোনো নাটকের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সেজেগুজে তৈরি হয়ে এসেছেন। ওরকম কোট, ও ধরনের শার্টের কলার, ওই চশমা, আর বিশেষ করে ওই বুট জুতো—এসব আর আজকালকার দিনে কেউ পরে না।’ অর্থাৎ, গল্পের শুরুতেই সত্যজিৎ একটি ভৌতিক আবহাওয়া তৈরি করে দেন।
অনাথবাবুর নেশাটিও বেশ অদ্ভূ্ত—সারা দেশ ঘুরে বিভিন্ন পুরনো বাড়িতে ভূত খুঁজে বেড়ানো এবং নিরাশ হওয়া। পরে আরও জানা যায় যে লোকটি একজন ভূত বিশেষজ্ঞ। তার নিজের ভাষায়, ‘শুধু ভূত কেন—ভূত, প্রেত, পিশাচ, ডাকিনী, যোগিনী, ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারউলফ, ভুডুইজ়ম ইত্যাদি যা কিছু আছে তার সম্বন্ধে বইয়ে যা লেখে তার প্রায় সবই পড়ে ফেলেছি।’ এও জানা যায় যে তিনি ভারতবর্ষের প্রায় তিনশোটি তথাকথিত ভূতের বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন, যার মধ্যে ছাপ্পান্নটি ডাক বাংলো ও ত্রিশটি নীলকুঠিও আছে। যদিও প্রতিবারই তাকে নিরাশ করেছে ভূতের দল।
আরও পড়ুন: শব্দ যখন ছবি আঁকে
এই গল্প থেকে আরও একটি বিশেষ জিনিস আমরা জানতে পারি। সেটা হলো ভূতের গন্ধ। মাদ্রাজি ধূপ, মাছের তেল, আর মড়াপোড়ার গন্ধ মেশানো একটা গন্ধ—এই হলো অনাথবাবুর মতে ভূত থাকার চিহ্ন। ভুল তিনি করেননি, কারণ এই রঘুনাথপুরে এসেই অবশেষে অনাথবাবু ভূতের দেখা পান এবং গল্পের শেষে তিনি নিজেই ভূত হয়ে যান। যদিও ট্রেনে ভূত দেখার ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু ট্রেনেই আলাপ হওয়া অনাথবাবু লোকটির সেকেলে বেশভূষা ও চালচলন এবং সর্বোপরি লোকটির অদ্ভুত শখ, সব মিলিয়ে গল্পটিতে শুরু থেকেই একটা থমথমে পরিবেশ এনে দেয়।
সত্যজিতের ছোটগল্পে রেলভূতের দ্বিতীয় উপস্থিতি ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’ গল্পে। বিলেত ফেরত ও সাহেবের পা চাটা রঞ্জন কুণ্ডুর মেজর ড্যাভেনপোর্টের সঙ্গে মোলাকাত এবং তার দুঃসহ অভিজ্ঞতার গল্প বোধহয় একমাত্র সত্যজিতের কলমেই সম্ভব। সাদা চামড়ার গুণকীর্তন করা রঞ্জনবাবুকে শেষমেশ খোদ এক সাহেবের হাতেই লাঞ্ছিত হতে হয়। পরে অবশ্য জানা যায় পুরো ঘটনাটাই রঞ্জনবাবুর বন্ধু পুলকেশ সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত, তার ইংরেজপ্রীতি নির্মূল করার জন্য।
আরও পড়ুন: দেবতার গ্রাস
সোজা কথায় বললে বলতে হয়, এটি আদৌ ভূতের গল্পই নয়। কিন্তু তবু ট্রেন আর ভূত এই দুটোকে একসঙ্গে ভাবতে গেলে এই গল্পটার কথা মনে আসবেই। ট্রেনের ফাঁকা কামরায় রাতের অন্ধকারে একা-একা যাত্রা করতে গেলে যথেষ্ট সাহস দরকার। কিন্তু রঞ্জনবাবুর ব্যাপার আলাদা। তিনি সাহেবী মেজাজের মানুষ। তাই এতই পুলকিত হন এমন একটা কামরা দেখে যে কোনও যাত্রাসঙ্গীর অভাবটাও তার আর গায়ে লাগে না। ট্রেনের ফাঁকা কামরা তিনি বেশ উপভোগই করছিলেন যতক্ষণ না তার সাহেব সহযাত্রীটি এসে তার আরামের বারোটা বাজিয়ে দিলেন। ক্রমাগত তাকে ‘নিগার’ বলে সম্বোধন, এবং দাবী করা যে দেশ এখনও স্বাধীন হয়নি, রঞ্জনবাবুকে বেশ বিরক্ত করে তোলে। খানিক পরে তার খেয়াল হয় মেজর ড্যাভেনপোর্ট আসলে মানুষ হতে পারেন না। তার মানে ইনি ড্যাভেনপোর্টের ভূত। পুরোনো আমলের ফার্স্ট ক্লাস কামরা, আর ১৯৩২ সালে মরে যাওয়া সাহেবের ভূত, এই সবকিছু এবার রঞ্জনবাবুর বোধগম্য হতে শুরু করে আর হাত পা অবশ হয়ে আসে ক্রমশ। ভয় পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ার আগেও তিনি শুনতে পান মেজরের গলায় ‘ডার্টি নিগার’ বলে ধমক।
এই আলোআঁধারি, সাহেব ভূতের হাতে অপদস্থ হওয়া ও সারারাতের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ফলে রঞ্জনবাবুর মন থেকে উগ্র সাহেবপ্রীতি মুছে যায় চিরকালের মতো, যেটা পুলকেশবাবু চেয়েছিলেন। প্রায় দশ বছর পরে ঘটনাচক্রে জানা যায় পুলকেশবাবুই পুরো কান্ডটা ঘটিয়েছিলেন, আর সেটাও শুধুমাত্র বন্ধুর ভুল ধারণা ভাঙার জন্যই। কারোর ভুল ধারণা যখন বদ্ধমূল হয়ে যায় তখন তাকে ভাঙার জন্য এমন অদ্ভুত ও অভিনব পদ্ধতি অবলম্বনের আইডিয়া বোধহয় সত্যজিৎ ব্যতিত অসম্ভব।
আরও পড়ুন: আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
তবে সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ রেলভূতের গল্প বোধহয় ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’। যদিও এটিও সেই অর্থে ভূতের গল্প নয়। বরং অনেকটা ইংরেজি সাহিত্যের সাইকোলজিকাল থ্রিলার ঘরানায় লেখা। বেড়াতে গিয়ে আলাপ হওয়া মনিলাল হলো রতনবাবুর doppelganger, যার কথাবার্তা, স্বভাব-চরিত্রও রতনবাবুর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। কিন্তু এমন একটি সমমনস্ক মানুষকে সঙ্গে পেয়েও রতনবাবু তাকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না। খুন করে বসলেন ট্রেনের সামনে ফেলে দিয়ে। কি বিচিত্র মানুষের মনের গতিবিধি। কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করলে মানুষ তাকে পছন্দ করে না, আবার কেউ যদি হুবহু তার মতোই আচরণ করে তাহলেও তাকে বেশিক্ষণ সহ্য করা মুস্কিল। মনিলালবাবুর উপস্থিতি রতনবাবুর পক্ষে এতটাই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে যে তিনি তার জন্য খুনের মতো দুঃসাহসিক কাজ করতেও পিছপা হন না। গল্পের ক্লাইম্যাক্স অন্যদিকে মোড় নেয় যখন পরেরদিন মনিলালবাবুর ভূত ওই একই জায়গায় একইভাবে রতনবাবুকেও ট্রেনের সামনে ঠেলে ফেলে দেয়। শুধু গল্পের অলৌকিকতা নয়, মানুষের মনস্তত্ত্বের কিছু অদ্ভুত দিকও এই গল্পের থেকে পাওয়া যায়।
সত্যজিতের রেলপ্রীতি বারবার ধরা পড়েছে তাঁর সৃষ্টিকর্মে। তা সে ‘পথের পাঁচালী’, ‘সোনার কেল্লা’ বা ‘নায়ক’-এর মতো ছবিই হোক কিংবা ‘বারীন ভৌমিকের ব্যারাম’, ‘সহযাত্রী’ কিংবা ‘বাক্স রহস্য’-এর মতো গল্পই হোক। সবথেকে বড় কথা, রেল হলো যে কোনও ভৌতিক গল্পের আদর্শ পটভূমি। রাতের অন্ধকার, খালি কামরা, মাঝেমাঝে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক, এর থেকে ভালো ভূতের গল্পের পরিবেশ আর কিই বা হতে পারে। তবে তার ছোটগল্পে অজস্রবার অজস্ররূপে ভূতের দেখা মিললেও, সত্যজিৎ কোনওদিনই ভূতের গল্প নিয়ে ছবি করার কথা ভাবেননি। ব্যাতিক্রম অবশ্যই ‘মণিহারা’। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে ভূত থাকলেও তা ভয়ের ভূত বলতে যা বোঝায়, তা নয়। বরং সে এমন ভূত যার দর্শন বোধহয় সবাই পেতে চায়।
আরও পড়ুন: যে আগুন নেভে না
তবে সত্যি কথা বলতে কী, ইংরেজিতে যাকে হার্ডবয়েল্ড হরর ফিক্শন বলা হয়ে থাকে, সত্যজিৎ সেরকম গল্প কোনওদিনই লেখেননি। ওনার গল্পে গা ছমছমে ভয়ের আবহাওয়াই আসল। রেলভূতের গল্পগুলোও তাই। ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’ আর ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’, এই দুটি গল্প সেই অর্থে শিক্ষামূলক। প্রথমটিতে রতনবাবু তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছেন তার জীবন দিয়ে এবং দ্বিতীয়টিতে, পুলকেশবাবু রঞ্জন কুণ্ডুর ভুল ভাঙাচ্ছেন রেলযাত্রার সময়। দুটি গল্পের ক্ষেত্রেই ট্রেন একটি অপরিহার্য চরিত্র হয়ে উঠেছে যাকে ছাড়া গল্পের প্রেক্ষাপট তৈরী করা অসম্ভব হতো।
‘মগজাস্ত্র ২০১৮’ ওয়েব ম্যাগ-এ প্রথম প্রকাশিত