তুমি আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও

ছবি: নগরকীর্তন

পরিচালনা: কৌশিক গাঙ্গুলী

অভিনয়ে: ঋদ্ধি সেন, ঋত্বিক চক্রবর্তী, সুজন মুখোপাধ্যায়, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, কলকাতার কিন্নর সম্প্রদায়

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৫ মিনিট

RBN রেটিং: ৪/৫

‘আমি মরিয়া হইব শ্রীনন্দের নন্দন, তোমাকে বানাব আধা, বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা।’ রাধার ক্ষোভের এই কথাগুলি কেমন করে যেন মিলে যায় এই ছবির সঙ্গে। নিজের সঙ্গে নিজের বিরোধ একটা মানুষকে কতটা অসহায় করে তোলে তা প্রান্তিক মানুষমাত্রই বুঝবেন, তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের বোঝার কথা নয়।




এই বোঝাবার কাজটাই করতে চেয়েছেন পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী। পুরুষের দেহে নারীমনের অস্তিত্ব কিংবা নারীর দেহে পুরুষমনের অস্তিত্ব আজ আর কোনও নতুন কথা নয়। কিন্তু সব জেনেও আমরা আজও যেন মানতে পারি না প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেয়ালকে।

চারপাশের বাকি একশোটা মানুষের মধ্যে যা দেখা যায় না, যে চাহিদা আমাদের সবার মধ্যে গড়ে ওঠে না, যে যন্ত্রণা আমরা নিজেদের মন ও শরীর দিয়ে বুঝি না, সেটাই অবান্তর, অস্বাভাবিক আর নিষিদ্ধ। তাকেই আমরা দাগিয়ে দিই কুৎসিত বলে। অসহায় ওরা মেনে নেন, মানিয়ে নেন। যারা মানতে পারেন না, তারা বেশিরভাগই হেরে যান জীবনের কাছে।

তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

আজন্মকালের চেনা সমাজের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একা লড়ে যাওয়া যুদ্ধে ক’জন মানুষ আর মানবী বন্দোপাধ্যায়ের মত জয়ী হতে পারেন? এ যুগেও তাই লুকিয়ে ভালবাসতে হয় মধু আর পুঁটিকে। বাংলা ছবিতে প্রান্তিক মানুষদের অসহায়তাকে তুলে ধরার যে সাহস পরিচালক কৌশিক দেখালেন তার সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করলেন অভিনেতা ঋদ্ধি সেন ও ঋত্বিক চক্রবর্তী। একই আদ্যক্ষরের দুই অভিনেতার মধ্যে চোখের ও শারীরিক ভাষার যে রসায়ন দেখা গেল তা বহুদিন কোনও নায়ক নায়িকার মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।




একজন মানুষ লিঙ্গবিশেষে যা হয়ে জন্মায়, তার মনটা যদি তেমন না হয়, তাহলে সর্বপ্রথম সে তার নিজের বাড়িতেই ব্রাত্য হয়ে যায়। একদিকে নিজেকে পরিবর্তিত করে নতুন মানুষ হয়ে ওঠার এক অদম্য আকাঙ্খা, অন্যদিকে খোদার ওপর খোদকারী করতে চাওয়ার আদিম ভয়, দুয়ে মিলে যে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা, তাকে পর্দায় অসম্ভব দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন ঋদ্ধি। বয়সে নবীন হলেও একের পর এক চরিত্রে তিনি নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবার। নিজে পুরুষ হয়েও শরীরী আবেদনে এক নারীকে বয়ে চলা যথেষ্ট কঠিন ছিল। সেখানে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন ঋদ্ধি। শীর্ষ রায়ের ক্যামেরা তার প্রতিটা শারীরিক আন্দোলনের খুঁটিনাটি ধরে রেখেছে। আর প্রতিটা দৃশ্যে আশ্চর্য করেছেন ঋদ্ধি। নিখুঁত শরীরী ভাষার সঙ্গে মাপা কণ্ঠস্বরের ব্যবহার তার নারীসত্বাকে প্রশ্ন করার কোনও অবকাশ দেয় না।

যে জন থাকে মাঝখানে

সঙ্গীত তখনই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় যখন মূল গায়কের সঙ্গে সঠিক তালমেল হয় তার সহযোগী শিল্পীদের। আর এখানেই নিখুঁতেরও একধাপ ওপরে ঋত্বিক। তার অভিনয় নিয়ে বোধহয় নতুন কিছুই বলার নেই। আন্ডারঅ্যাক্টিংকে নিজস্ব মুনশিয়ানা দিয়ে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান তিনি প্রতিবারই। মুখের মাংসপেশীকে যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করে মনের ভাব প্রকাশ করার মধ্যে যে নির্লিপ্ততা থাকে, তা ঋত্বিকের অভিনয়ের চেনা ছন্দ। কিন্তু চেনা হলেও তাকে একঘেয়ে হতে দেন না অভিনেতা নিজেই। প্রতিবারই অবাক করে তার পরিমিতিবোধ। এক অন্তর্মুখী মানুষের ভেতরের দ্বন্দ্বকে অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতে পারেন একটিমাত্র কথার সাহায্যে, ‘ছেলের সঙ্গে ছেলের ভালবাসা হয়?’

দুজন অল্প শিক্ষিত মানুষ বাইরের দুনিয়ার জ্ঞানগর্ভ বুলি, আইনের ছাড়পত্র, সমাজের গোঁড়ামি কিছুমাত্র না জেনে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে যায় শুধুমাত্র মনের টানে। গল্প বলার সহজ সরল ও নির্মম আঙ্গিকে মুগ্ধ করে অন্যরকম ভালবাসার নগরকীর্তন।

শব্দ যখন ছবি আঁকে

শেষে যাদের কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সেই কিন্নর অভিনেতাদের অভিনয়ের প্রশংসা করতেই হয়। এত সাবলীল অভিনয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবকে দর্শকের সামনে তুলে ধরেন ওঁরা যে প্রতি মুহূর্তে জীবন নিয়ে অভিযোগ করতে থাকা আমরা, যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’, তারা হয়ত কল্পনাও করতে পারব না একটা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট কাকে বলে আর কতটা প্রতিকূলতার মধ্যে ওঁরা রোজ বেঁচে থাকেন। এত কষ্টেও হাসতে, গাইতে বা নাচতে পারেন, এমনকি খুশি হলে মাথায় হাত বুলিয়েও দেন প্রতিদিন ট্রাফিক সিগনালে। অভিনন্দন কৌশিক, এদের হয়ে কিছু কঠিন সত্যকে সামনে তুলে আনার জন্য। আর খুব পরিস্কারভাবে সমকামী ও নপুংসক মানুষের পার্থক্য ও প্রান্তিকতাকে বুঝিয়ে দেবার জন্য তাঁর আলাদা ধন্যবাদ প্রাপ্য।

অভিনয়ে অন্যান্যদের মধ্যে স্বল্প পরিসরে মন ছুঁয়ে গেলেন বিদিপ্তা চক্রবর্তী। সুজন মুখোপাধ্যায় মানানসই। ছবিতে ব্যবহৃত কীর্তন সমঝদার স্রোতাদের আনন্দ দেবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য রাম রজকের মেকআপ, যথার্থ তাঁর জাতীয় পুরস্কার লাভ।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
2

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

One thought on “তুমি আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও

  • আরো একবার সাবলীল এক প্রতিক্রিয়ায় মুগ্ধ হলাম | খুব সুন্দর ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে |

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *