এ কেমন জীবন
এ এক অন্য সোনার কেল্লা। জয়সলমীরের চেনা চেহারা নয় এটা। এখানে উট নেই, কেল্লা নেই, সোনার পাথরবাটি নেই। আছে বলতে একদল নারীর দুর্ভাগ্যের গল্প। এছাড়া বালি আছে, ধুলোর ঝড় আছে, আর আছে দারিদ্র্য। আছে প্রত্যন্ত সব গ্রাম যেখানে নিরক্ষর অসহায় মহিলাদের বাস। রাজস্থানের চলতি ভাষায় এদের নাম ‘রুদালী’। জয়সলমীর ও রাজস্থানের বহু প্রাচীন গ্রামে এদের দেখা মেলে। এদের কাজই হলো অন্যের দুঃখে কাঁদা, বা বলা ভাল রোজগারের জন্য কাঁদা। গ্রামের কোথাও কোনও বিত্তশালী ঠাকুর মারা গেলে এদের ডাক পড়ে।রুদালীদের কাজ হলো মৃত মানুষের বাড়িতে গিয়ে বুকফাটা কান্না কেঁদে সমস্ত গ্রামবাসীর মনকে বিষন্নতার ছোঁয়ায় ভরিয়ে দেওয়া।
কিন্তু কেন রুদালীদের ডাকা হয়? কেন বাইরের লোক এসে দুঃখ প্রদর্শন করবে?
এর পিছনে আছে শতাব্দী প্রাচীন কিছু সংস্কার। বাড়ির মেয়েরা বাড়ির বাইরে গিয়ে সর্বসমক্ষে কাঁদতে পারে না। তাদের ঐতিহ্য ও বংশমর্যাদা তাদের সেই এক্তিয়ার দেয়না। বাড়ির মেয়েরা তাদের দুঃখ চার দেয়ালের মধ্যেই চেপে রাখবে। যত দুঃখই আসুক, তাদের ঘোমটার বাইরে বেরোনোর অধিকার নেই। স্পর্ধা নেই চৌকাঠ পেরিয়ে কাঁদতে যাবার। তাই কান্নার জন্য আছে অন্য লোক। তাই প্রয়োজন রুদালীর।
Image: Quint Hindi
রাজস্থানের নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘যতদিন স্বামী বেঁচে থাকে ততদিনই গ্রামে সন্মান থাকবে’। অর্থাৎ স্বামী বেঁচে থাকলে সংসার থাকে, জীবনে রঙ থাকে। স্বামী মারা গেলে পেটের দায়ে কালো পোশাকে নিজেকে ঢেকে রুদালী পেশায় নাম লেখাতে হয়। রুদালীদের পোশাকের রঙ কালো, যেহেতু কালো মৃত্যুর রঙ। আবার যমরাজের প্রিয় রঙও নাকি কালো। চোখে মোটা করে কাজল পরেন এরা। গলায় নানারকম রাজস্থানি কারুকাজ করা উল্কি আঁকা।
গ্রামের ঠাকুর সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে বা শেষ সময় উপস্থিত হলে রুদালীদের ডাক পড়ে। ঠাকুর বাড়ির মহিলারা অন্তঃপুরবাসিনী। তাদের স্বামী, পিতা, বা ভাই মারা গেলেও পরপুরুষের সামনে এসে চোখের জল ফেলার অধিকার নেই। কিন্তু তাই বলে সম্মানীয় ঠাকুরের মৃত্যুতে কেউ চোখের জল ফেলবে না এমন তো হতে পারে না। তাই রুদালীরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন।
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
ডাক্তার বা পরিবারের কেউ ওই ব্যক্তির মৃত্যু ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে রুদালীদের বুকফাটা কান্নায় গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি এই রুদালীদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। সেক্ষেত্রে পরিবারের লোকজনের কাছে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জরুরী তথ্য নিয়ে নেয় এরা। এরপর শুরু হয় তার নামে বুকচাপড়ে কান্না। সে এমন কান্না যা পাড়া প্রতিবেশীকেও কাঁদতে বাধ্য করে। নিজের বুকে করাঘাত করে, মাটিতে আছড়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে সকলকে জানানো হয় মৃত ব্যক্তি কত মহান ছিলেন। তিনি চলে যাওয়ায় কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল গ্রামের। দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ওড়না ভিজে গেলেও চোখ মুছবে না রুদালীরা। কান্নাই যে তাদের পেশা।
তবে সবসময় স্বাভাবিকভাবে কান্না আসেও না। তখন প্রাচীন জড়িবুটি বা চোখ জ্বালা করানো কাজলের সাহায্য নিতে হয়। সঙ্গে চলে দুঃখের গান ও ক্রমাগত বিলাপ। এই শোকপালনের মাঝে বিরতি দেওয়া হয় মধ্যাহ্নভোজের। কিছুক্ষণের জন্য কান্না থামিয়ে খাবার সময় পান রুদালীরা। খাবার বলতে কিছু বাসি রুটি ও কাঁচা পেঁয়াজ। তবু কিছু তো জোটে। ঠাকুর সম্প্রদায়ের পুরুষদের মৃত্যু এদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। ঠাকুরদের মৃত্যু না হলে তো কাজ জুটবে না। যদিও অর্থও জোটে যৎসামান্যই।
এই অবধি পড়ে মনে হতে পারে একটা অন্যধরনের পেশাই তো, দারিদ্র্য ছাড়া আর কোনও কষ্ট নেই এদের। তাহলে রুদালীদের দৈনন্দিন জীবনের অন্দরে প্রবেশ করা যাক।
Image: AbsoluteArts
দারোগি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে রুদালীরা আসে বিয়ের সময় যৌতুক বা দহেজ হিসেবে, পরিবারের সদস্য হয়ে। তবে ঠাকুরদের হাভেলি বা অন্দরমহলে এরা স্থান পায়না। এরা থাকে হাভেলির বাইরে আলাদা কুটিরে, একা। কারণ পরিবারের অন্তঃপুরে রুদালীদের জন্য জায়গা নেই। এদের অধিকার নেই সংসার করার বা বিয়ে করার। ঠাকুর পরিবারের পুরুষদের যথেচ্ছ ব্যবহারে খুব অল্পদিনে এরা সন্তানসম্ভবা হয়। কিন্তু এদের সন্তানের কোনও পিতৃপরিচয় থাকে না। এরা রুদালীর সন্তান নামেই পরিচিত হয়। পুত্রসন্তান হলে তারা ভবিষ্যতে ঠাকুর পরিবারের পরিচারকরূপে নিযুক্ত হয়। আর কন্যাসন্তান হলে ঠাকুর পরিবারের মতো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে মেরে ফেলা হয়। যদি কোনওভাবে বেঁচে যায় তাহলে সেও ভবিষ্যতে রুদালী প্রথাকে বয়ে নিয়ে চলে মায়ের মতোই।
রাজস্থানি চেনা প্রবাদ হলো, “পান্দো ভালো না কসকো, বেটি ভালি না এক, লেনো ভালো না বাপকো, সাহিব রাখ্যিয়া টেক।” অর্থাৎ খালি পায়ে কয়েক ক্রোশ হাঁটাও ভাল, কিন্তু বাড়িতে যেন কোনও কন্যার জন্ম না হয়, পিতার ওপর ঋণের বোঝা চাপানোর থেকে ঈশ্বর যেন রক্ষা করেন। ভয়ঙ্কর পণপ্রথার চাপেই কন্যাসন্তানের এত অনাদর বোঝা যায়। ঠাকুর পরিবারের রুদালীদের কাজ হলো দিনের বেলা ঠাকুরের শিশুদের দেখাশোনা করা, জল তুলে দেওয়া, এছাড়া নানান ফাইফরমাশ খাটা, আর রাতে ঠাকুরদের মনোরঞ্জন করা। এছাড়া ঠাকুর পরিবারে কেউ মারা গেলে কাঁদার জন্য এদের প্রয়োজন হয়। যেন কাঁদার জন্যই জন্ম হয়েছে এদের। অনেক ক্ষেত্রে এই শোকের উৎসব চলতে থাকে টানা ১২ দিন ধরে। যত বেশি কান্না আর শোকের বহিঃপ্রকাশ, সেই ঠাকুরের ততবেশি প্রভাব প্রতিপত্তি বলে বিশ্বাস করা হয়।
যে আগুন নেভে না
মিরাসি সম্প্রদায়ের রুদালীরা অবশ্য ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে থাকে না। এরা গ্রামের বাইরে আলাদা থাকে। নিচুজাত বলে গ্রামের কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে এদের প্রবেশাধিকার নেই। শুধু ডাক পড়ে উচবংশীয় পুরুষদের মৃত্যু হলে। তবে এরাও ঠাকুরদের হাতে যথেচ্ছভাবে অত্যাচারিত হয়। রুদালীদের আরাধ্য দেবতা ভৈরুজী। তিনি নিজেও এক কামুক দেবতা যিনি অসংখ্য নিচুজাতের নারীর ক্ষতি করেছেন। এই দেবতার লাম্পট্যের গল্প রাজস্থানের গ্রামগুলিতে মুখে মুখে ফেরে। তবু ইনিই যেন রুদালীদের নিয়তি। এই দেবতারই আরাধনা করে আসছে রুদালীরা বছরের পর বছর ধরে।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশ আজ বিশ্বাস করে কোনও কাজই ছোট নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই professional mourners ছিল এবং আছে। কিন্তু কোথাও এই পেশা এমন অপমানের নয়। জাতপাতের কড়াকড়ি কোথাও তাদের এভাবে প্রান্তিক করে দেয়না। সারা পৃথিবী জুড়ে অজস্র আশ্চর্য পেশা রয়েছে মানুষের। অর্থের বিনিময়ে মানুষকে অনেক সময়েই অনেক অদ্ভুত কাজ করতে হয়। কিন্তু দিনের শেষে প্রত্যেকে এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে পরিচিত হবেন এমনটাই কাম্য। কিছু মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে দিনের পর দিন তাদের শোষণ করে যাওয়া অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ বলা বাহুল্য।
Image: India Today
মহাশ্বেতা দেবীর লেখা গল্প অবলম্বনে কল্পনা লাজমীর ‘রুদালী’ ছায়াছবিটি তৈরী হয় ১৯৯৩ সালে। এই ছবি থেকেই প্রথম রুদালীর ধারণা পায় সারা বিশ্ব। এই ছবিতে এক রুদালীর জীবনের ব্যক্তিগত কিছু ট্র্যাজেডির গল্প দেখতে পাই আমরা। সম্প্রতি কলকাতার সাংবাদিক ও লেখিকা নিধি দুগার কুন্দলিয়া ২০১৬ সালে প্রকাশিত তাঁর The Lost Generation বইতে ভারতের লুপ্তপ্রায় কিছু প্রথা নিয়ে লিখেছেন। সেখান থেকে বর্তমান ভারতে রুদালীর বাস্তব চিত্র সম্পর্কে জানা যায়। রুদালীদের জীবন ঠিক কতটা অভিশপ্ত ছিল, কিভাবে ঠাকুর সম্প্রদায় নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় রুদালীদের ব্যবহার করে এসেছে তার সঠিক চিত্র আমরা এই বই থেকে জানতে পাই।
বর্তমানে বহু ঠাকুর পরিবার সাধারণ পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণভাবে সৎকারের কাজ করলেও প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে জাতপাত ও ছোঁয়াছুঁয়ির রেওয়াজ এখনও রয়ে গেছে। পণপ্রথার প্রভাবও একইরকম রয়ে গেছে, ফলে কন্যাসন্তান এখনও অনাহুত। অশিক্ষার অন্ধকার দূর না হওয়া অবধি এই সমস্ত শতাব্দী প্রাচীন কুসংস্কারকে এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না কোনওদিনই।
ভীষণ ভাল লাগলো লেখাটা পড়ে। সত্যিই আমরা আজও কোন অন্ধকারে বাস করি ভেবে অবাক লাগে।
Khub bhalo content.
tomar lekhar niyomito ekjon pathok hoye uthchhi .