শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
একটা সময় ছিল যখন তাঁর নামে দর্শক হলে যেত। রঙমহলে তাঁর অভিনয় দেখার জন্য লোকে লাইন দিয়ে টিকিট কাটত। সেই জহর রায়ের মৃত্যুর সময় আশেপাশে ছিলেন না প্রায় কেউই। অভিন্নহৃদয় বন্ধু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজে দাঁড়িয়ে কাঁদতে-কাঁদতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বলেন, “জহরের কি দেশের কাছে এটুকুই পাওনা ছিল? অন্য দেশে হলে স্যার উপাধি পেত!”
বহু বছর ধরে দাপটে মঞ্চ কাঁপালেও তাঁর অভিনয়ের শুরু হয়েছিল সিনেমার মাধ্যমেই। অভিনয় ছিল তাঁর রক্তে। বাবা সতু রায় ছিলেন নির্বাক যুগের নামী অভিনেতা। জহরের জন্ম হয় বরিশালে। পরে স্ত্রী আশালতাকে নিয়ে সেখান থেকে কলকাতা হয়ে অবশেষে পাটনায় চলে যান জহরের বাবা।
আরও পড়ুন: ‘নৈবেদ্য’ নিয়ে এলেন মেখলা
ছোট থেকেই নির্বাক ছবির এক বিশ্ববিখ্যাত নায়ককে নিজের গুরু মেনেছিলেন জহর। তিনি চার্লস স্পেনসর চ্যাপলিন। স্কুলজীবনেই দেখে নেন চ্যাপলিনের কালজয়ী ছবিগুলি। এমনকি এক একটা ছবি আট-দশবারও দেখেছেন শুধু চ্যাপলিনের অঙ্গভঙ্গি শেখার আশায়। কলেজ ছেড়ে একটা সময় তাঁকে সংসারের চাপে চাকরিতে ঢুকতে হলো। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রুফ রিডারের চাকরি নিয়ে কিছুদিন কাজ করলেন। তারপর মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভের চাকরিও করলেন কিছুদিন। তাও না জমায় শেষে দর্জির দোকান দিলেন। ভালোই চলছিল সেই দোকান। সেলাই মেশিন চালানো থেকে শুরু করে শার্ট প্যান্টের কাটিংও শিখে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রক্তে যার অভিনয় তিনি আর কতদিন দর্জির দোকান চালাবেন! চলে এলেন একদিন কলকাতায়। সেও পয়সা খরচ করে নয়। এক বরযাত্রীর দলের সঙ্গে টিকিটের টাকা বাঁচিয়ে কলকাতায় এসে হাজির হলেন জহর।
পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পূর্বরাগ’ ছবি দিয়ে সিনেমায় তাঁর হাতেখড়ি হলো। এরপর সারাজীবন প্রায় তিনশোর কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এর সঙ্গে ছিল অজস্র নাটক, কৌতুকাভিনয় ও কমিক রেকর্ড। এর সঙ্গে আরও একটি বিরলতম ঘটনা, একইসঙ্গে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহা ও তরুণ মজুমদারের ছবিতে অভিনয় করেছেন জহর, যে সুযোগ সম্ভবত আর কোন অভিনেতার হয়নি। তবে শুধু অভিনয়ে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও আগাগোড়া মজার মানুষ ছিলেন তিনি।
তাঁর অভিনয় প্রতিভা ও রসিকতার কিছু গল্প রইল এখানে।
‘কাট!’
ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে শুটিং করছেন পরিচালক নরেশ মিত্র। শট চলতে চলতেই হঠাৎ পরিচালকের গলা শোনা গেল ‘কাট!’ ক্যামেরা থেমে গিয়ে সেটে আলো জ্বলে উঠল। নরেশ তো হতভম্ব! তিনি তো কাট বলেননি। ওদিকে তাঁর গলা প্রায় হুবহু নকল করে যিনি শুটিং থামিয়েছেন তিনি ততক্ষণে সেট থেকে হাওয়া। ব্যাপার বুঝতে পেরে ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন নরেশ। কিন্তু রেগে থাকার কি জো আছে! পরেরদিন কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তাঁর সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জহর। এরপর আর রাগ করে থাকে কার সাধ্যি!