পরনে ‘ভালো থেকো’র শাড়ি, প্রথম ছবির স্মৃতিচারণে বিদ্যা বালন
কলকাতা: গতকাল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের তৃতীয় দিনটি ছিল বিদ্যা-ময়। শিশির মঞ্চ ও নন্দনে দর্শক ও সাংবাদিকদের সামনে স্মৃতিচারণ করে উৎসবের ঢিমে আঁচকে বেশ খানিকটা উস্কে দিয়ে গেলেন অভিনেত্রী বিদ্যা বালন (Vidya Balan)। কথা বললেন বাংলায়, কলকাতার প্রতি আবেগে উচ্ছ্বসিত হলেন, এমনকি বাংলা গানও শোনা গেল তাঁর গলায়।
পরিচালক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব গৌতম হালদারের (Goutam Halder) স্মৃতিতে এ বছর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছে উৎসব কর্তৃপক্ষ। সেই উপলক্ষে বিদ্যা এলেন উৎসব প্রাঙ্গণে, পরনে গৌতমের দেওয়া সোনালী পাড়ের লাল-কালো শাড়ি, যা তিনি পরেছিলেন ‘ভালো থেকো’র প্রিমিয়রে। বললেন, “গৌতমদা আর চৈতীবৌদি আমাকে এই শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন, তাই ভাবলাম আজ পরি এটা।”
দু’দশক আগে এক ডিসেম্বরে গৌতমের ছবি ‘ভালো থেকো’ দিয়ে অভিনয় জীবনের সূচনা হয়েছিল বিদ্যার. সেই স্মৃতিচারণে মুখর হয়ে রইলেন তিনি একটা গোটা দিন। দিনের প্রথম অনুষ্ঠান ছিল শিশির মঞ্চে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন পরিচালক সঙ্গীতা দত্ত। স্মৃতিচারণে সপ্রতিভ বিদ্যা বললেন নানান কথা। পরবর্তী অনুষ্ঠান মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডার মেজাজে। বাছবিচার না করেই সেখানে তিনি জবাব দিলেন সবরকম প্রশ্নের।
আরও পড়ুন: কেয়াতলায় রাপ্পা রায়, সঙ্গে ডলফিনও
গৌতমের ছবিতে প্রথম সুযোগ পেলেও বিদ্যা তাঁর জীবনে প্রথম যে বাঙালি পরিচালকের সংস্পর্শে আসেন তিনি প্রদীপ সরকার (Pradeep Sarkar)। প্রদীপের পরিচালনায় একটি বিজ্ঞাপনী শুট করতে সে সময় কলকাতায় এসেছিলেন বিদ্যা। সেই সেটে ছিলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার দীনেশ রাউত। গৌতমের কাছে তিনিই বিদ্যার নাম প্রস্তাব করেন। গৌতমই প্রথম যিনি বিদ্যাকে সম্পূর্ণ বাঙালি উচ্চারণে বিদ্যা বলে সম্বোধন করেছিলেন, হিন্দির মতো ‘ভিদ্যা’ বলে নয়।
সেই সময়ের কথা বলতে বসে স্মৃতিতে ভেসে যাচ্ছিলেন অভিনেত্রী। তাঁর উচ্ছ্বাস, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ দেখে মনে হচ্ছিল যেন সদ্য মুক্তি পাওয়া কোনও ছবির গল্প বলছেন তিনি। যেমন কথা বললেন ‘ভুলভুলাইয়া ৩’ নিয়ে, তেমনই বললেন ‘পরিণীতা’ এবং ‘কহানি’র কথাও।
আরও পড়ুন: ২২ বছর পর মুক্তি পেতে চলেছে অনুরাগের ছবি
নিজেকে প্রবাসী বাঙালি বলতে ভালোবাসেন বিদ্যা। যদিও পরিচালক সুজয় ঘোষ এই নিয়ে হামেশাই তাঁর সঙ্গে খুনসুটি করেন যে বিদ্যা আদৌ প্রবাসীর মানেই বোঝেন না। তবু নিজেকে নিয়ে তাঁর যুক্তি, “সেই প্রথম ছবি থেকে কলকাতার সঙ্গে, বাংলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ, তারপর কত ছবিতে যে আমি বাঙালি মেয়ের চরিত্র করেছি, একে আর কী বলব বলুন? বাংলার সঙ্গে আমি কীভাবে জড়িয়ে গেছি নিজেও জানি না। গৌতমদা ‘ভালো থেকো’র চিত্রনাট্য আমাকে শুনিয়েছিলেন বাংলায়। তখন আমি দক্ষিণ থেকে আসা এক নতুন অভিনেত্রী, বাংলার কিছুই জানি না। তবু অদ্ভুতভাবে বুঝেছিলাম সবটা। কিছু শব্দ যেগুলো বুঝতে পারিনি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু বাংলায় বলা চিত্রনাট্য বুঝতে একটুও সমস্যা হয়নি সেদিনও। তারপর তো অজস্র ছবিতে কলকাতা কানেকশন এল। এও এক আশ্চর্য ব্যাপার।”
সঙ্গীতা দত্ত ও গৌতম ঘোষের সঙ্গে
সেই শুরু, এত বছর বাংলার ছোঁয়ায় থেকে, বাংলাকে ভালোবেসে এখন পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেন তিনি। বললেন, “গোটা সাক্ষাৎকার আমি বাংলায় দিয়েছি”।
প্রথমদিন ছবির শট ছিল প্রবাদপ্রতিম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ডাকতে হতো জ্যাঠামশাই বলে, উচ্চারণের অসুবিধায় ডেকেছিলেন জ্যেঠু বলে। পরে অবশ্য উচ্চারণ ঠিক করে নিয়েছিলেন তিনি।
বাংলার কোন তিনটে প্রিয় জিনিসকে বেছে নেবেন বিদ্যা? নাহ, গড়পড়তা হিন্দি ছবির শিল্পীদের মতো রসগোল্লা বা ফুচকার নাম নেননি তিনি। সবথেকে প্রথমে যেটা ভালোবাসেন সেটা হলো বাঙালিদের সঙ্গে আড্ডা। কলকাতায় এসে পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারলে আর কিছুই চান না তিনি। দ্বিতীয় কালীঘাট মন্দির। কলকাতায় এলে তিনি কালীঘাটে অবশ্যই যাবেন দর্শন করতে। আর তৃতীয় হলো নলেন গুড়ের সন্দেশ। সাংবাদিকদের আবদারে গেয়ে শোনালেন রাহুল দেব বর্মণের গাওয়া ‘তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল’ গানের সামান্য অংশ।
আরও পড়ুন: রুপালি জগতের অন্ধকার দিক নিয়ে নতুন ওয়েব সিরিজ়
কোন অভিনেত্রীদের দেখে অনুপ্রাণিত হন বিদ্যা? নাম নিলেন মীনাকুমারী থেকে শ্রীদেবী অনেকেরই। তবে বাংলার মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কথা বললেন বিশেষভাবে। অনেকেই মাধবীর সঙ্গে তাঁর মিল খুঁজে পান এও জানালেন। অভিনয় তিনি শিখে আসেননি, মেথড অ্যাক্টিং কাকে বলে জানেন না। তবে চিত্রনাট্য শুনে এবং বারবার পড়ে যেমন বোঝেন সেভাবেই ক্যামেরার সামনে নিজেকে মেলে ধরেন বলে জানালেন তিনি। জীবনে এতবার খ্যাতির চূড়ায় থেকে আবার সেখান থেকে নেমেও এসেছেন যে স্টারডম থাকা না থাকা তাঁকে খুব একটা ভাবায় না। কমেডি ছবিতে অভিনয় করতে ভালবাসেন বিদ্যা। অথচ ভারতীয় ছবিতে মেয়েদের কমেডি করার সুযোগ সেভাবে আসে না। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ধরনের ছবিতে অভিনয় করার ভারী ইচ্ছে তাঁর। সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে অবশ্য সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করার, কিন্তু সে স্বপ্ন তো আর সত্যি হওয়া সম্ভব নয়, হেসে ফেলেন বলে। নতুন বাংলা ছবি খুব একটা দেখা না হলেও ডিজিটাল মাধ্যমে সার্ফিং করতে করতে বাংলা ছবি পেয়ে গেলে দেখতে বসে পড়েন তিনি যখন তখন, সে নতুন হোক কী পুরোনো।
আরও পড়ুন: নস্টালজিয়া ছাড়া আর কোনও প্রাপ্তি নেই
তবে ভারতের বহু ভাষায় ছবি করেছেন তিনি। বর্তমান বাংলা ছবির পরিচালকরা তাঁকে ডাকেন না। ডাকলে তিনি কাজ করতে রাজি, পরিষ্কার জানালেন। তবে এই মুহূর্তে ‘ভুলভুলাইয়া ৩’ এর সাফল্যে তৃপ্ত হয়েই কেটে যাচ্ছে তাঁর, নতুন কোনও কাজ এক্ষুনি করছেন না বলেই জানালেন তিনি।
বিদ্যার কাছে জীবনের মন্ত্র একটাই, ভালো থেকো। গৌতম হালদারের থেকে পাওয়া এই মন্ত্র যেমন অন্যকে বলেন তেমন নিজেকেও সবসময় বলে থাকেন তিনি। প্রথম ছবির নামের সঙ্গে পাওয়া সেই জীবনদর্শনই শীত শুরুর পড়ন্ত বিকেলে কলকাতাকে শিখিয়ে গেলেন মনেপ্রাণে ‘প্রবাসী বাঙালি’ বিদ্যা।
ছবি: সুফল ভট্টাচার্য