বাংলা ছবিতে ভূত
বাংলা ছবির ইতিহাসে ভৌতিক কাহিনীচিত্র খুব বেশি হয়নি। তবে খুব একটা কমও যে হয়েছে, তাও বলা যাবে না। সাধারণ কাহিনী নিয়ে ছবির সংখ্যা যত, ভূত বা গোয়েন্দা নিয়ে সিনেমা তার থেকে অনেক কম। তাছাড়া সিনেমার একটা নিজস্ব ভাষা আছে। তার জন্য তার নিজস্ব কাহিনীই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি সেই ছবি সাহিত্যনির্ভর হয় (যেমনটা আগে হতো, এবং যে কারণে এক বিশাল সময় জুড়ে, এবং এখনও ছবি বা সিনেমাকে ‘বই’ বলা হয়) তাহলে সিনেমার প্রয়োজনে তা সামান্য পাল্টাতে হয়। সাধারণ কাহিনীতে দর্শক তা মেনে নিলেও গোয়েন্দা বা ভূতের ক্ষেত্রে ছবি যদি সাহিত্যনির্ভর হয়, তাহলে এই পরিবর্তিত রূপ অনেক সময় দর্শক পছন্দ করেন না।
তাছাড়া ভুত বা গোয়েন্দাগল্প নির্ভর ছবি জনপ্রিয় হওয়া বা হিট করাকে অনেকে সিনেমা জগতের ক্রাইসিস বলে মনে করেন। কারণ ছায়াছবি সাহিত্যনির্ভর হলে, বিশেষত এমন সাহিত্য যার মধ্যে সাহিত্যগুণ অনেক কম থাকে, তার মাধ্যমে সিনেমা তৈরী হলে সেই ছবিও খুব একটা উচ্চমানের হয় না বলেই অনেকের ধারণা।
একথা শুনে আবার কেউ কেউ রাগ করতে পারেন। গোয়েন্দা বা ভৌতিক গল্পের সাহিত্যমূল্য নেই, এমন নাকউঁচু কথা সেই সব পাঠকের মেনে নেওয়া অসম্ভব যারা মূলত গোয়েন্দা ও ভৌতিক সাহিত্যই বেশি পড়েন। এখানে বলে রাখা ভাল, বর্তমান সময়ে থ্রিলার কাহিনী এবং ছবির চাহিদাই সবথেকে বেশি।
যাই হোক, হলিউডে বা হিন্দীতে যে পরিমান হরর ফিল্ম তৈরী হয়েছে, কলকাতায় ততটা হয়নি। হয়ত এই ধরণের বাংলা ছবির দর্শক সংখ্যায় কম বলেই হয়নি। বাংলায় হরর ছবির কথা বলতে গেলে তার মধ্যে কিছু গোয়েন্দা কাহিনীচিত্র ঢুকে পড়বেই। সেই সব ছবি এই লেখা থেকে বাদই থাক। নামকরা বেশকিছু ভয়ের ছবি, যেমন কালোছায়া (১৯৪৮) ও হানাবাড়ি (১৯৫২), কোনাওটাই ভূতের সিনেমা নয়। দুটিই গোয়েন্দা গল্প।
প্রেমের পাপে
তালিকায় সবার আগে যে ছবিটি আসবে সেটি হলো কঙ্কাল (১৯৫০)।পরিচালক নরেশ মিত্র। এই ছবিতে অভিনয় করেন ধীরাজ ভট্টাচার্য, জীবেন বসু, রবি রায় এবং শিশির বটব্যাল। কঙ্কাল একটি পুরোদস্তুর ভূতের ছবি। যে মহিলাকে কঙ্কালে পরিণত করা হয়েছিল, শেষ দৃশ্যে সে তার প্রতিশোধ নেয়, এটাই মূলত গল্প। পরে এর থেকেও অনেক ভয়ঙ্কর ভূতের ছবি হয়ত তৈরী হয়েছে কিন্তু তুলনামূলক অনুন্নত প্রযুক্তি ও অতি স্বল্প বিনোদনের যুগে কঙ্কাল বিরাটভাবে সফল হয়েছিল।
এরপর ১৯৬০ সালে মুক্তি পায় তপন সিংহর ছবি ক্ষুধিত পাষাণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত এই ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি, ছবি বিশ্বাস, রাধামোহন ব্যানার্জি, দিলীপ রায়, রবিন ব্যানার্জি, অরুন্ধতি দেবী, পদ্মা দেবী, বীনা চাঁদ ও অন্যান্য শিল্পীরা। এক করসংগ্রাহক কর সংগ্রহ করতে এসে একটি প্রাসাদে আশ্রয় নেন যাকে স্থানীয় লোকেরা মনে করত ভুতের বাড়ি। সেখানে এক সুন্দরী মহিলার প্রেতের সাথে ওই করসংগ্রাহকের সম্পর্ক তৈরী হয়। এটাই মূল গল্প। ছবির সুরকার ছিলেন আলী আকবর খান। ক্ষুধিত পাষাণ ফিল্মটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত সফল হয়। যদিও মূল রচনার সঙ্গে চিত্রনাট্যের মিল সামান্যই, তবুও রবীন্দ্রনাথের গল্পে এর সূত্র ও সম্ভাবনা ছিল।
১৯৬১ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত মনিহারা (তিনকন্যা ছবির অন্তর্গত, যা বাংলা ছবির ইতিহাসে খুব সম্ভবত প্রথম anthology ফিল্ম)। বাকি দুটি গল্প পোস্টমাসটার এবং সমাপ্তি। তিনটি গল্পই রবীন্দ্রনাথের লেখা। এর মধ্যে দ্বিতীয় গল্পটি ভূতের, অর্থাৎ মনিহারা। ছবিতে ব্যবসায়ী ফণিভূষণকে তারই কাহিনী শোনাচ্ছেন এক স্কুলমাস্টার। গল্পের শেষে ফণিভূষণ কাহিনীর সত্যতা অস্বীকার করেন এবং স্কুল মাস্টারও জানান তিনি তা আন্দাজে লিখেছেন মাত্র। স্কুলমাস্টারের গল্পটি ছিল ভূতের। সত্যজিৎ তার ছবির শেষ অংশটিতে একটা মৌলিক পরিবর্তন আনেন। ফণিভূষণ যখন আত্মপ্রকাশ করে, তখন দেখা যায় সে একটি কঙ্কাল, অর্থাৎ ভূত, এবং ওই স্কুলমাস্টার তখন আতঙ্কে পালাচ্ছেন। গল্প ও ছবি উভয়ই প্রবল জনপ্রিয়।
সম্ভবত সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ভূতের সিনেমা, যাতে ভূতের সর্বাধিক পজ়িটিভ ভূমিকা দেখা গেছে, এবং এতটাই পজ়িটিভ যে ওই ভূতের দেখা পেতে সবাই আগ্রহী, পারলে ভগবানকে ফেলে ওই ভূতকে দেখতে চায়, তা হলো সত্যজিতের গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯)। সত্যজিৎ এই ছবিটি তৈরী করেন তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কাহিনী অবলম্বনে, তাঁর পুত্র, বর্তমানে বাংলা ছবির সফল পরিচালক, সন্দীপ রায়ের অনুরোধে। যথারীতি নিজের বেশিরভাগ ছবির মত গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর চিত্রনাট্য, সুর, এবং গানের কথা সব সত্যজিতের লেখা। ছবিতে অভিনয় করেন তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত, হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায, জহর রায়, শান্তি চট্টোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গোবিন্দ চক্রবর্তী, প্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে।
গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর মূল চরিত্রগুলি নিয়ে পরে আরও দুটি ছবি তৈরী হয়। একটি সত্যজিতের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), অপরটি সন্দীপের পরিচালনায় গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯২)।
যাই হোক, এরমধ্যে সেভাবে আর কোনও ভুতের ছবি বাংলায় হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই বাংলায় ভূতের ছবি বলতে কুহেলির কথা বলেন। কিন্তু কুহেলি (১৯৭১) রহস্য বা থ্রিলারধর্মী ছবি। তাকে আর যাই হোক ভূতের সিনেমা বলা যায় না।
সত্যজিৎ ও রেলভূত
অবশেষে পুরোদস্তুর ভূতের ছবি হিসেবে নিশিতৃষ্ণা মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও মুনমুন সেন অভিনীত এই ছবিতে আল্পনা গোস্বামী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় ছাড়াও, পরিমল ভট্টাচার্য, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেন। বাংলা ভাষায় নির্মিত প্রথম ভ্যাম্পায়ার ছবি ছিল নিশিতৃষ্ণা। আবহসঙ্গীত ভি বালসারার। গড়চম্পা নামে একটি জায়গায় কিছু বন্ধুরা ঘুরতে যায় যেখানে রক্তপিপাসু অতিপ্রাকৃতদের বাড়বাড়ন্ত। এই ছিল গল্পের মূল কাহিনী।
এর প্রায় এক দশক পর ১৯৯৮ সালে মুক্তি পায় রবি কিনাগীর পুতুলের প্রতিশোধ। বিনি নামে একটি মেয়ে অবিনাশ নামক একটি ছেলেকে বিয়ে করে এবং তারপরে শ্বশুরকুলের দ্বারা খুন হয়। তার আত্মা প্রতিশোধ নিতে এসে প্রথমে শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে হত্যা করে ও অবশেষে স্বামীহত্যার চেষ্টা করলে, তার সতীন অর্থাৎ অবিনাশের দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী, শেষ পর্যন্ত একটি পুতুলের মধ্যে থাকা বিনির আত্মাকে প্রতিরোধ করে ও পুতুলটি নষ্ট করে ফেলে। রচনা ব্যানার্জি ও সিদ্ধান্ত মহাপাত্র এই ছবিতে অভিনয় করেন। ছবিটি ওড়িয়া ভাষাতেও মুক্তি পায়।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
এরপর বহুকাল বাংলায় আর উল্লখযোগ্য কোনও ভূতের ছবি তৈরী হয়নি। খুব সম্ভবত ভিক্টর ব্যানার্জি অভিনীত একটি ভূতের ছবি মাঝখানে মুক্তি পেয়েছিল।
বাংলাদেশে ২০০৭ সালে রক্তপিপাসা, ২০০৮ সালে ডাইনীবুড়ি, আর ২০১৪-তে সেদিন বৃষ্টি ছিল, এই তিনটি ছবি তৈরি হয়। তবে রক্তপিপাসা ছবির একটি অংশে ভূতুড়ে নাচ দেখে বাকিটা এবং অন্য ছবিগুলো দেখার আর প্রবৃত্তি হয় না।
অবশেষে ২০০৩ সালে মুক্তি পায় পাতালঘর। সেখানে একটি দৃশ্যে অঘোর সেন-এর ভূতকে দেখা যায়। তবে পাতালঘরকে ঠিক ভূতের ছবি বলা চলে না। এটি একটি পুরোদস্তুর ছোটবড় সকলের জন্য বানানো ফ্যান্টাসি ছবি। ছবিটি মুক্তির সময় সেরকম সফল হয়নি। যদিও আজকের অনেক সফল পরিচালকই মনে করেন, পাতালঘর বর্তমান সময়ে মুক্তি পেলে একটি ব্লকবাস্টার ছবি হত।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
মালায়ালম ভাষায় ১৯৯৩ সালে তৈরী হয়েছিল মানিচিত্রথাজু। মূলত মনস্তত্ববিদ্যায় ভূত বা ভর-হওয়া বিষয়গুলিকে কিভাবে দেখা হয়, তাই নিয়েই এই ছবি। মানিচিত্রথাজুর কন্নড় রিমেক অপথমিত্র মুক্তি পায় ২০০৪-এ, এবং তামিল রিমেক চন্দ্রমুখী ২০০৫-এ। ওই একই গল্প নিয়ে ২০০৫ সালে বাংলায় প্রসেনজিৎ ও অভিযেক চট্টোপাধ্যায় অভিনীত রাজমহল ছবিটি তৈরী হয়, যা ২০০৭ সালে হিন্দিতে ভুলভুলাইয়া নামে মুক্তি পায়। ভুলভুলাইয়া প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ছবির গল্প সবারই জানা। তামিল ছবিটির একটি হিন্দি ডাব্ড ভার্সনও বেরোয়। মোহনলালকে দিয়ে যে বৃত্ত শুরু হয়েছিল, তা বিষ্ণুবর্ধন, রজনীকান্ত, প্রসেনজিৎ হয়ে অক্ষয়কুমার দ্বারা সম্পূর্ণ হয়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ২০১১ সালে বেরিয়েছিল গোঁসাইবাগানের ভূত। খুব বেশি জনপ্রিয়তা না পেলেও ছোটরা আনন্দ করেই দেখেছিল তোজো গাঙ্গুলি, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, টিনু আনন্দ, ভিক্টর ব্যানার্জি, দ্বীজেন ব্যানার্জিদের অভিনয়।
পরের বছর, আর্থাৎ ২০১২ সালে, দুটি ভূতের ছবি মুক্তি পায়। সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় যেখানে ভূতের ভয় ফিল্মটি আসলে তিনখানা পৃথক গল্প নিয়ে তৈরী তিনটি আলাদা ছবি। সত্যজিৎ রায়ের গল্প অনাথবাবুর ভয় ও ব্রাউন সাহেবের বাড়ি, এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গল্প ভূত ভবিষ্যৎ, এই তিনটি কাহিনী নিয়ে ছবিটি তৈরী হয়।
ওই বছরেই অপর ছবিটিকে বাংলা ফিল্মের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন বলা চলে। ভূতের ভবিষ্যৎ ২০১২ সালে সবচেয়ে বড় হিট। পুরনো কলকাতার বাড়িগুলি একে একে ভেঙে দিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরী হওয়ার যে বাস্তব চিত্র, সেই ঐতিহ্যের টানাপোড়েনকেই স্যাটায়রের মোড়কে, বা বলা যায় ভূতের মোড়কে, নতুনভাবে পরিবেশন করেন পরিচালক অনীক দত্ত। পরান বন্দোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, সুমিত সমাদ্দার, মুমতাজ সরকার, সমদর্শী দত্ত, শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, খরাজ মুখার্জী, মীর আফসর আলী এবং বাকিদের অভিনয় এ ছবির সম্পদ।
এরপর ২০১৩ সালে রিলিজ় হয় শীর্ষেন্দুবাবুর কাহিনী অবলম্বনে হরনাথ চক্রবর্তির ছায়াময়, আর অপর্ণা সেন পরিচালিত গয়নার বাক্স।সিনেমার যদি সত্যিই নিজের ভাষা থাকে তাহলে শেষোক্ত ছবিটি বাংলায় সম্ভবত একমাত্র নিজস্ব ভূতের ছবি। ছবিতে মৌসুমী চ্যাটার্জি, কঙ্কনা সেনশর্মা, শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়, পীযুষ গাঙ্গুলী, পরান বন্দোপাধ্যায়রা অসাধারণ অভিনয় করেন।
ওই একই বছরে আরও একটি ভূতের ছবি আসে। সায়ন্তন মুখার্জী পরিচালিত অদ্ভুত। একটি শতাব্দী প্রাচীন বাড়ি, সে বাড়ির বাসিন্দারা, পূর্বপুরুষের ভূত ও গুপ্তধন নিয়ে তৈরী ছোটদের মজার ছবি ছিল অদ্ভুত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরান, খরাজ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বসু, অনামিকা সাহা, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ও অঞ্জনা বসুর অভিনয়সমৃদ্ধ এই ছবি। সেই বছরই পরিচালক জুটি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের ছবি অলীক সুখ মুক্তি পায়। একে ঠিক ভূতের ছবি না বলা গেলেও, জটিল মনস্তাত্বিক সমীকরণের সঙ্গে জড়িত কিছু অদ্ভুত দৃশ্য দেখানো হয়েছিল, যা বহু দর্শক ভৌতিক বলেই মনে করেন।
তবে ভূতের সিনেমার হিড়িক পড়ে যায় ২০১৪ সালে। সন্দীপ রায় পরিচালনা করেন চার ছবিটি। পরান, শাশ্বত, রজতাভ দত্ত ও আবির চ্যাটার্জি কে নিয়ে তৈরী এই ছবিটি সত্যজিতের লেখা দীনবন্ধু এবং কাগতাড়ুয়া গল্প দুটি অবলম্বনে, এবং অন্য দুটি ছবি রাজেশখর বসুর বটেশ্বরের অবদান ও শরদিন্দুর পরীক্ষা গল্পের ভিত্তিতে তৈরি হয়। চারটি ছোটগল্প তাই ছবির নাম চার।
সেই বছর সবচেয়ে সফল বাংলা ছবি সৃজিত মুখার্জির চতুষ্কোণ। ছবিটি যদিও ভূতের নয়, থ্রিলার। সিনেমায় চারজন পরিচালক একটি ছবি বানাতে মনস্থ করেন যাতে চারটি গল্প থাকবে। প্রত্যেকটি গল্পের কমন থিম মৃত্যু। প্রত্যেক পরিচালক তার নিজের গল্প বাকি তিনজনকে শোনান। এদের মধ্যে তিনজন পরিচালকের গল্প বেশ ভয়ের। সেই অর্থে ভূতের না হলেও, গল্পগুলোর রেশ ধরে এই ছবিকে ভূতের বলা চলে। বাস্তব জীবনে চার সফল পরিচালক—অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়—এই ছবিতে অভিনয় করেন। এছাড়াও পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী একটি ছোট চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দেন।
ওই একই বছর বেরোয় বিরসা দাশগুপ্ত পরিচালিত অভিশপ্ত নাইটি। ভূতের উল্লেখ থাকলেও এই ফিল্মকে ঠিক ভৌতিক বলা চলে না। পাওলি দাম, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, পরমব্রত, তনুশ্রী চক্রবর্তী, ভাস্বর ব্যানার্জি, লাবনী সরকার, পরান বন্দোপাধ্যায়, রাহুল ব্যানার্জি, প্রিয়াঙ্কা সরকার, নীল মুখার্জি কে না ছিল ছবিতে।
২০১৪ সালে যেন ভূতুড়ে ছবির লাইন পড়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে কৌশিক গাঙ্গুলির ছবি খাদ ছিল একটু অন্য ধরণের। সম্পর্কের টানাপোড়েন, যাদের সঙ্গে দিনের পর দিন আমরা সময় কাটাই, তাদের সঙ্গে আভ্যন্তরীন বোঝাপড়া, জীবনকে দেখার আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী, এসবই ছিল ছবির বিষয়। ভূতের ব্যাপারটা আসে খুব হালকা ভাবে। তবে সাধারণত ভূতের ছবি বলতে যা বোঝায়, এ ছবিকে সেই তালিকায় ফেলা যাবে না। লিলি চক্রবর্তী, কমলেশ্বর মুখার্জী, অর্ধেন্দু ব্যানার্জি, মিমি চক্রবর্তী, সাহেব ভট্টাচার্য, রুদ্রনীল ঘোষ, ভরত কল সকলেই যথাযথ অভিনয় করেন এই ছবিতে।
বিরসা দাশগুপ্তর আরেকটি ছবি—গল্প হলেও সত্যি—ওই বছরই বেরোয় যা ছিল ২০১২ সালে নির্মিত তামিল ফিল্ম পিৎজা’র রিমেক। গল্প হলেও সত্যি নিঃসন্দেহে বাংলা ছবির চেনা ধাঁচের থেকে অনেকটাই আলাদা। ম্যাজিক রিয়ালিজ়মকে ভুতুড়ে প্রেক্ষাপটে ফেলার এক দুরূহ কাজ করেন বিরসা। সোহম চ্যাটার্জি ও মিমি চক্রবর্তী ভাল অভিনয় করেন এই ছবিতে।
এ কেমন জীবন
২০১৪ সালে ভূতের ছবির তালিকায় আর একটি ছবি হল ভূত ভুতুড়ে সমুদ্দুরে। ছবিতে পরান, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যান্যরা অভিনয় করেন। তবে এটিও মূলত থ্রিলারধর্মী ছবি।
এর পরের বছর প্রেক্ষিত হয় ৯০ মিনিটের ছবি লুডো। আন্ডারগ্রাউন্ড হরর ফিল্মের তালিকায় এটি পরে। পরিচালক কিউ বা কৌশিক মুখোপাধ্যায়। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় নীলোৎপল সিংহরায় নির্দেশিত স্বল্পদৈর্ঘ্যর ছবি বরোদা ও বহুরূপী। তবে বড় পর্দায় এই ছবি খুব সম্ভবত দেখানো হয়নি।
২০১৭ সালে বেরোয় বিরসা দাশগুপ্তর ছবি সব ভূতুড়ে। অভিনয় করেন সোহিনী সরকার, আবির চ্যাটার্জি ও বিশ্বজিৎ চক্রবর্তি। সেই বছরই ওয়েব সিরিজ়ে সৌরভ চক্রবর্তির পরিচালনায় বেরোয় কার্টুন। অভিনয়ে পায়েল সরকার, মৈনাক বন্দোপাধ্যায় ও অরুণ মুখোপাধ্যায়।
দেবতার গ্রাস
বাংলাদেশেও অনেক ভূতের ছবি তৈরি হয়েছে আজ অবধি। সেই সমস্ত ছবির খবর রাখা সম্ভব নয়। তার মধ্যে ইচ্ছাধারী নাগ ধাঁচের কিছু ছবি আছে, যেমন কাল নাগিনীর প্রেম, বিষাক্ত নাগিন, বিষে ভরা নাগিন, সাথীহারা নাগিন, এবং এরকম আরও অনেক। তবে নাম শুনে এবং ইন্টারনেটে দু-একটা দৃশ্য দেখার পর আর সেইসব ছবি দেখার ইচ্ছে থাকে না কারোর।
মগজাস্ত্র ২০১৮ ওয়েব ম্যাগ-এ প্রথম প্রকাশিত