অবাঙালি ফেলুদা, যান্ত্রিক জটায়ু, থ্রিলের হাহাকার
ছবি: নয়ন রহস্য
পরিচালনা: সন্দীপ রায়
অভিনয়ে: ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, অভিজিৎ গুহ, আয়ুষ দাস, অভিনব বড়ুয়া, দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়, মোহন আগাসে, ভরত কল, সুপ্রিয় দত্ত, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, রাজেশ শর্মা, শুভ্রজিত দত্ত
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆
‘ফেলুদা হাতের কাপ টেবিলে রেখে একটা চারমিনার ধরিয়ে বললো, তোমাকে একটা কথা অকপটে বলছি, সুনীল। তোমার শোয়ে শোম্যানশিপের কিঞ্চিৎ অভাব লক্ষ করলাম। আজকের উঠতি জাদুকরদের কিন্তু ও দিকটা নেগলেক্ট করলে চলে না। তোমার হিপনোটিজম আর তোমার নয়ন—দুটোই আশ্চর্য আইটেম সন্দেহ নেই, কিন্তু আজকের দর্শক জাঁকজমকটাও চায়।’ স্বয়ং সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) যে কথা তাঁর গল্পের জাদুকরের জন্য ফেলুদার মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, সেই একই কথা প্রযোজ্য ‘নয়ন রহস্য’ (Nayan Rahasya) ছবির ক্ষেত্রেও। গোটা ছবি জুড়েই সেই ছাপ স্পষ্ট। জটায়ু বলতেন, যেটা চাই সেটা হলো থ্রিল। সেই থ্রিলেরই বড় অভাব চোখে পড়ল এ ছবিতে।
‘নয়ন রহস্য’ গল্পের মূল চরিত্র নয়ন এক বিস্ময় বালক যে না দেখে, না জেনেও এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে পারে যা সংখ্যায় বলা যায়। তাকে ম্যাজিকের মঞ্চে হাজির করে জাদুকর সুনীল তরফদার। কিন্তু নয়নকে বিভিন্ন কাজে লাগাতে ইচ্ছুক কিছু লোক তাদের ধাওয়া করে চেন্নাই পর্যন্ত। নয়নের সুরক্ষার ভার নিয়ে ফেলুদারাও পৌঁছে যায় সেখানে।
সাহিত্য থেকে সিনেমা হামেশাই হয়। সেক্ষেত্রে বইয়ের কাহিনি আর পর্দার ছবির মধ্যে কিছু তফাৎ থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়। নাহলে গল্প কখনও সিনেমা হয়ে ওঠে না। বিশেষত যে গল্প আশির দশকে লেখা, তাকে নিয়ে ২০২৪ সালে ছবি করতে গেলে চিত্রনাট্যে পরিবর্তন আনা কাম্য ছিল। খুব সামান্য কিছু ঘটনার এদিক-ওদিক করা ছাড়া বড় কোনও মোচড় নেই ছবিতে, ফলে ক্লাইম্যাক্স অত্যন্ত দুর্বল। পরিচালকের আগের ফেলু ছবিগুলি যেমন ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘টিনটরেটোর যিশু’ বা ‘গোরস্থানে সাবধান’-এ অপরাধ এবং সেই সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে উপযুক্ত দৃশ্য রাখা হতো। ফলে পাঠক ও দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ করার একটা ব্যাপার থাকতো। পাঠক যেভাবে একটা গল্পকে গ্রহণ করে, দর্শকের দেখা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিন্ন হয়।
আরও পড়ুন: আবারও কানে ‘মন্থন’
এই ছবিতে তেমন কোনও উত্তেজনা তো পাওয়াই গেল না বরং গাওয়াঙ্গি যেখানে জটায়ু ও নয়নকে তুলে নেয় এবং তোপসে তাকে আক্রমণ করে, সে দৃশ্যও কেটেছেঁটে যেভাবে দেখানো হলো তাতে করে গাওয়াঙ্গিকে নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়াই তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। যাকে বারবার ‘উগান্ডার অপোগন্ড’ বলা হলো, তাকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন তিনি দক্ষিণ ভারতীয়। ভয়ংকর কিছুই সেই ব্যক্তির চেহারায় পাওয়া গেল না যা দেখে ছোটরা অন্তত ভয় পেতে পারে। অথচ গাওয়াঙ্গি এই গল্পের এক মূল আকর্ষণ।
আরও পড়ুন: আবারও কৌশিকের ছবিতে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা?
দ্বিতীয়ত, হিঙ্গোরানি চরিত্রটি। গল্পে এই চরিত্রের যা বয়স, তা ছবিতে বেড়ে গিয়েছে অনেকখানি। মোহন আগাসের মতো অভিজ্ঞ অভিনেতা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে। কিন্তু গল্পের যুক্তিই হিঙ্গোরানিকে এত বয়স্ক বলে ভাবতে দেয় না। প্রথমত এই বয়সে পার্টনারশিপ চলে গেলেও তিনি অন্য কিছু করার কথা ভাববেন না। বা তেমন ভাবলেও একজন সত্তরোর্ধ ব্যক্তি ফেলুদাকে বলছেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তিনি এবার চেন্নাইতে গিয়ে চাকরির চেষ্টা করবেন, এ অত্যন্ত হাস্যকর। এছাড়া মাঝরাতে অফিসে গিয়ে বাকি কাজ করাও এই চরিত্রের পক্ষে বেশ কঠিন।
এরই সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কানে লাগে ফেলুদার অবাঙালি উচ্চারণ। আদ্যন্ত দক্ষিণ কলকাতাবাসী ফেলুদার উচ্চারণ নিয়ে বাঙালি মাত্রেই সমস্যা হতে বাধ্য, সে বই পড়া থাকুক বা না থাকুক। এছাড়াও ফেলুদার সেন্স অফ হিউমার, চোখ দিয়ে হাসি, কৌতুক এবং সর্বোপরি মগজাস্ত্রের ঝলকানি, কোনওকিছুই পাওয়া গেল না ইন্দ্রনীলের মধ্যে। ওদিকে জটায়ু হিসেবে অভিজিতের স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব চরিত্রটিকে যান্ত্রিক করে তুলেছে। বসাকের ভূমিকায় বিশ্বজিতের আরও বেশি ধার থাকা প্রয়োজন ছিল।
আরও পড়ুন: বাংলা ছবিতে রাহুল রায়
তবু কয়েকজন অভিনেতার আনাগোনা ছবিকে কিছুটা হলেও জমিয়ে তোলে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুপ্রিয় দত্ত। টিএনটির ভূমিকায় তিনি যেন একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছেন। তাঁর কমিক টাইমিংও ভালো। ডিটেকনিকের গোয়েন্দারূপে রাজেশ শর্মা বরাবরের মতোই মানানসই। এছাড়া দেবনাথের তরফদারও বিশ্বাসযোগ্য। নয়নের চরিত্রে অভিনব বেশ ভালো। শুভ্রজিত ও ভরত যথাযথ।
গল্পের প্রধান তিন চরিত্রের মানানসই না হওয়া এবং চিত্রনাট্যের দুর্বলতা, এই দুটি ‘নয়ন রহস্য’-এর প্রধান সমস্যা। যেহেতু বাংলা সাহিত্য ও সিনেমায় ফেলু একটি আইকন, তাই এ চরিত্রে কোনওরকম খামতি দর্শক পছন্দ করেন না। এছাড়া চিত্রনাট্যে রয়েছে নানা অসঙ্গতি। মেকিং অত্যন্ত সাদামাঠা। গোটা ছবিতে না রয়েছে ফেলুদা থিমের এনার্জি, না রয়েছে কোনও বুদ্ধির প্রয়োগ। হিপনোটিজ়মের প্রয়োগকে আরও একটু বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যেত।
‘সোনার কেল্লা’ মুক্তির অর্ধশতক পরেও ফেলুদা পড়া ও দেখা এক প্রজন্মের বাঙালির কাছে প্রায় ধর্মের সমান। সেই কারণেই হয়তো আজও ছুটির দিনে টিকিট পেতে সমস্যা হয়, ছবি হাউজ়ফুল যায়। তবু হলফেরত দর্শকের প্রতিক্রিয়া বলে দেয় বারবার আশা করেও হতাশ হওয়া ইদানিং যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অবিলম্বে ফেলুদা কাহিনির এনার্জি ও উত্তেজনা ছবিতে ফেরাতে না পারলে হয়তো বহু দর্শক তাঁদের প্রিয় গোয়েন্দার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।