চলচ্চিত্রের চালচিত্র হয়ে থেকে যাবে অঞ্জনের ট্রিবিউট
ছবি: চালচিত্র এখন
পরিচালনা: অঞ্জন দত্ত
অভিনয়ে: শাওন চক্রবর্তী, সুপ্রভাত দাস, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, মেঘলা দাশগুপ্ত, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, শেখর দাস, অঞ্জন দত্ত
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★★☆
কিংবদন্তি মানুষকে নিয়ে ছবি করা মানেই মেকআপ সাজপোশাকের মাধ্যমে হুবহু এক হয়ে উঠতে হবে, এই মিথকেই নস্যাৎ করে দিলেন অঞ্জন দত্ত (Anjan Dutt) তাঁর ‘চালচিত্র এখন’ (Chalchitra Ekhon) ছবির মাধ্যমে। এতে করে স্পষ্টতই ছবিটা স্থানকালের ঊর্ধ্বে এবং শুধুমাত্র দুজন অসমবয়সী মানুষের বন্ধুত্বের গল্প হয়েই থেকে যায়। মৃণাল সেন (Mrinal Sen) এবং অঞ্জন মানুষ দুটো সম্পর্কে কিছুমাত্র না জেনেই দেখে ফেলা যায়, মজা নেওয়া যায়, উচ্ছ্বসিত হওয়া যায়।
ছবির কাহিনি সাংবাদিক ও মঞ্চের অভিনেতা রঞ্জন দত্ত (শাওন) এবং বিখ্যাত পরিচালক কুণাল সেনকে (অঞ্জন) নিয়ে। কুণালের বাড়িতে তার একটা ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাদের আলাপ এবং তারও বছর দুয়েক পরে একে অপরের সান্নিধ্যে আসা। রঞ্জনের জীবনে তখন চলছে আদর্শ বনাম অস্তিত্বের লড়াই। কুণালের ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে ভেতরে-ভেতরে ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠে রঞ্জন।
সেই অর্থে এই ছবির কোনও ছকে বাঁধা গল্প নেই। যা আছে তা এক অভিনেতা কিংবা একজন লড়াকু মানুষের জার্নি। একটা সময়, একটা সম্পর্ককে খুব যত্নে গড়ে তোলা হয়েছে গোটা ছবিজুড়ে। আবার সেই সময়কেই অস্বীকার করে ছবিটি। যেন যে কোনও কালে যে কোনও দেশে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতেই পারে। সেই সম্পর্ক, যা সব অর্থেই এক বিভ্রান্ত তরুণকে পথ দেখায়। মেনে নিতে না চেয়েও যে একসময় বিরুদ্ধ মতের অধিকারকে মেনে নেয়। দুটো মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের পথিক হয়েও কীভাবে বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, আন্তরিক হয়ে উঠতে পারে এবং সে জন্য কোনও গুরুগম্ভীর ন্যারেটিভের প্রয়োজন হয় না সে কথা প্রমাণ করলেন অঞ্জন।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু
হিউমার এ ছবির অলঙ্কার। দুজন আপাদমস্তক সিরিয়াস মানুষ যখন আবেগে জড়িয়ে যায় তখন দর্শককাসনে বসে নিজের অজান্তেই চোখের কোল ভিজে ওঠে। অথচ এ ছবি আদ্যন্ত মজার, আনন্দের, উদযাপনের। মজা বন্ধুত্বের, আনন্দ আদানপ্রদানের, আর উদযাপন এই শহরের। সবদিক দিয়েই এ ছবি খুব ব্যক্তিগত, এবং একইসঙ্গে অত্যন্ত সৎ। ‘চালচিত্র’ প্রমাণ করে দেয় ভালো সিনেমা তৈরি করতে অগাধ টাকার প্রয়োজন হয় না। তাই বাজেট কম বলে ভালো ছবি হচ্ছে না, এ কথা সবক্ষেত্রে খাটে না।
আজকের এই বিশ্বব্যাপী পিঠ চাপড়ানোর যুগে কীভাবে একজন আনকোরা নতুন শিল্পী এক কিংবদন্তির সামনে দাঁড়িয়ে ঔদ্ধত্য দেখাতে পারে, এবং তারপরেও তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয় না, এ সত্যি অবিশ্বাস্য লাগে। একজন প্রোডাকশন ম্যানেজার যখন শিখিয়ে দেয় এক থালা ভাতের মূল্য, কেমন যেন চাবুক পড়ে নিজের পিঠে। বাস্তবে কতজন বোঝে সত্যিকারের শ্রমের মূল্য? পেটভরে খেতে পাওয়ার দাম? এক প্রায় বিচ্ছিন্ন বন্ধু যখন স্পষ্ট করে দেয় প্রতিদিন লোকাল ট্রেনে করে কাজ করতে যাওয়া এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা মুখে বড়-বড় আদর্শের কথা বলার থেকে অনেক বেশি বাস্তব, তখন কোথায় যেন কী একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অথচ এ ছবি দুর্বোধ্য নয়, কঠিন নয়। এমনও নয় যে এ ছবি বিশেষ কিছু মানুষ বুঝবেন। খুব সহজ সাধারণ একটা গল্প, যা প্রত্যেকটা মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই অনুভব করবেন। ‘চালচিত্র এখন’ দেখার জন্য পরিচালক মৃণাল বা অঞ্জনকে না চিনলেও চলবে।
আরও পড়ুন: আবারও কানে ‘মন্থন’
একইরকম চেহারা, মেকআপ, গলার স্বর কোনওকিছু নকল না করেই প্রত্যেক অভিনেতা চরিত্র হয়ে উঠেছেন এই ছবিতে। কুণালের ভূমিকায় অঞ্জন অনবদ্য এবং অসম্ভব স্বাভাবিক। তাঁর অভিনয়ে কোথাও অভিনয় নেই যেন। রঞ্জনের ভূমিকায় শাওন এ ছবির সম্পদ। নিজেকে কতটা ভেঙে তিনি রঞ্জন হয়ে উঠেছেন সম্ভবত নিজেও জানেন না। চোখের অভিব্যক্তি বলে দেয় অভিনেতা হিসেবে তাঁর ভবিষ্যত উজ্জ্বল। মাধবনরূপে সুপ্রভাত সাংঘাতিক দাপুটে, কম কথা বলেও নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে গেলেন। এছাড়া বিদীপ্তা, শেখর, মেঘলা, শুভাশিস প্রত্যেকেই অনন্য।
ছবিতে সঙ্গীতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ছবির মেজাজের সঙ্গে সঙ্গীতকে মাখনের মতোই মিশিয়ে দিয়েছেন নীল দত্ত। প্রতিটা গান এত আরামদায়ক যে মনে হবে শুনেই যাই। অর্ঘ্যকমল মিত্রের সম্পাদনা টান টান, কোথাও মনে হয় না এই দৃশ্য না থাকলেও চলতো। প্রভাতেন্দু মণ্ডলের ক্যামেরা সত্তরের কলকাতাকে মনে করিয়ে দেয়, যাকে চিনিয়েছিলেন মৃণাল সেন স্বয়ং।
অন্যধারার এবং চেনা ফর্মের ছবি না হয়েও এই বছরের শ্রেষ্ঠ ছবির তালিকায় থাকবে এই চালচিত্র, এ কথা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। এবং নিঃসন্দেহে অঞ্জনের সেরা ছবির তালিকায় একেবারে ওপরের সারিতেই থেকে যাবে ‘চালচিত্র এখন’।