রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

নেপালের ক্যাসিনোর সিঁড়িতে হ্যাট-টাই-কোটে সজ্জিত গাঙ্গুলিবাবু যখন এক বিদেশিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়েই মুখে লাখ টাকার হাসি এনে ‘হে-হে-এক্সকিউজ মিইইইই’ বলে সামাল দেন, তখন প্রতিটি বাঙালির মুখে হাসির সঙ্গে সঙ্গে মনে উঠে আসে গভীর প্রশান্তি। কী ব্যাপার? না স্বল্প পরিসরে থাকা আটপৌরে লেখক, যার বিদ্যাবুদ্ধি একেবারেই হিংসা করার মতো নয়, বিশ্বদরবারে বাংলার মুখ রাখতে সমর্থ এ যাত্রায়। সেই লোকই যখন ছোট্ট বাক্সে আমসত্ত্ব নিয়ে গিয়ে কাস্টমস-এর হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তোপসের শরণাপন্ন হন, তখন কী মজাই না লাগে। আরে, এই লোকটা তো একেবারে আমাদেরই মতো। প্রতিটি পাঠক যেন এই অবস্থার সঙ্গে নিজের জীবনের বা পরিচিত কারও, কোনও না কোনও অবস্থার মিল পান। আর সেটাই পাঠকের মনের ভিতর থেকে বার করে আনে হাসি আর আনন্দ।

আবার যখন নকল জপযন্ত্র দিয়ে ‘ঠকাস’ করে মোক্ষম আঘাতে শূকর গলি অভিযান সফল করেন তিনি, বা ব্যুমেরাং-এর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে ধরাশায়ী করেন শত্রুকে, অজান্তে নিজের মনেই একটা সন্তুষ্টি জেগে ওঠে; যাক বাবা, জটায়ু একাধারে ফেলুদা, তোপসে থেকে শুরু করে আপামর বাঙালি জাতির ভেতো বা ভীতু দুর্নাম ঘোচালেন। হাসির উদ্রেককারী ঘটনা সবই, কিন্তু সেগুলির মধ্যে দিয়ে কোথাও যেন আমরা জিতে যাই। প্রবল বিক্রমে, ওই ক্ষুদ্রদেহে কোট আর ধুতি পরে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে যাওয়ার ছবি পাঠকের চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আরেক দফা হাস্যরোল; চোরাগোপ্তা আক্রমণ সেরে দুবলা বাঙালির পিঠটান। প্রমাণ হয়, বাঙালি আর যাই হোক, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরিয়ে দু’ঘা দিতে জানে।

Jatayu Satyajit Ray

ঠিক এভাবেই নানান সিরিও-কমিকাল ঘটনা ও উপঘটনার ভিতর দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আমাদের বেঁধে ফেলেছেন লালমোহন গাঙ্গুলি তথা জটায়ুর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়।

প্রেমের পাপে

নামটাই ধরা যাক। লালমোহন গাঙ্গুলি। কী মনে হয় শুনে? বাংলার বিখ্যাত লালচে, গোলগাল, রসে টইটম্বুর মিষ্টি লালমোহন বা পান্তুয়ার কথা, যা আদ্যোপান্তভাবে জড়িয়ে বাঙালির চিরসবুজ রসনার সঙ্গে। ফেলুদা হেঁয়ালি বানিয়েছিল এই নাম নিয়ে—‘রক্তবরণ মুগ্ধকরণ’। এই নাম শুনেই মগনলালের মতো পোড়খাওয়া ভিলেন ধারণা করে নেন মানুষটার নরমসরম ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে। আর তাই বদ হেসে বলেন, ‘লালমোহন, মোহনলাল, মগনলাল, সব লালে লাল।’ মগনলাল কখনও তাকে থুরথুরে বুড়ো অর্জুনের ড্যাগারের নিশানা বানায়, আবার কখনও বা চিনিতে ড্রাগ মিশিয়ে অপদস্থ করে। বেচারি ভালোমানুয জটায়ুকে দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াতেও ছাড়েনি বদমায়েশ ডাকু গন্ডারিয়া। ফেলুদাও ভাবতে বসেন, মগনলাল কিভাবে মানুষের দুর্বলতা ধরে ফেলে? পাঠক এসব দেখে হাসেন ঠিকই, কিন্তু পুরোটা সময় লালমোহনবাবুর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে রিলেট করেন, আর তাই জটায়ু হয়ে ওঠেন নিশ্ছিদ্র হাসির এলিমেন্ট। নিছক ভাঁড় হয়ে থেকে যান না।

Jatayu Satyajit Ray

তাঁর জটায়ু নামটিও যেন ব্যক্তিত্বের একদম পরস্পরবিরোধী। তাঁর কাজকর্ম একেবারেই জটায়ুর সাহসিকতার সঙ্গে খাপ খায় না। নিরীহ, ভীতু ভদ্রলোকটির যত মস্তানি তাঁর লেখনীতে। সেখানে নিজের মনের অবদমিত উচ্চাশাগুলি পূরণ করে তার সৃষ্ট গোয়েন্দাচরিত্র প্রখর রুদ্র, এবং মাঝে মাঝে তাঁর কাণ্ডকারখানা এতটাই অতিরঞ্জিত, যে ফেলুদার গাম্ভীর্যও খান খান হয়ে খসে পড়ে। অদ্ভুত সমস্ত তথ্য দিয়ে তিনি ‘উটের পাকস্থলী’ মার্কা মশলা মাখিয়ে তৈরি করেন ‘হট কচৌরিস’, পরে যা ফেলুদার হাতে পড়ে সংশোধিত হয় আগামী সংস্করণে। সেখানে পাঠক অবাক হন, ভাবেন, আর শেষে গালে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষে জয় হয় আবার সেই হাসির, আর ভদ্রলোককে ভালো না বেসে থাকা যায় না।

শব্দ যখন ছবি আঁকে

সিনেমার পর্দায় ট্রেন কানপুরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা প্রতিটা মানুষ নড়েচড়ে বসি কোট, সবুজ মাফলার,  ধুতি, আর জাপানী সুটকেসের মালিক জটায়ুকে (সন্তোয দত্ত) দেখার উদগ্র বাসনায়। ‘শর্ট, বল্ড এন্ড মুস্টাচ’ সম্বলিত এই ছোটোখাটো মানুষটা কামরায় ঢোকামাত্র  ‘ইম্পোরটেড’ জিনিসের প্রতি অপত্যস্নেহ থেকে কুলিবিদায়, নিজের ‘সাম্প্রতিকতম পটভূমিকা’ জানাবার অননুকরণীয় স্টাইলের ভিতর দিয়ে সকল লাইমলাইট সটান নিজের উপর টেনে নেন তিনি। মেড-ইজি পুষ্ট হিন্দিতে গড়পারের ঠিকানা দিয়ে বাঙালিদের দল ভারী করে ফেলেন অচিরেই এবং কোথায় যেন ম্লান করে দেন ফেলুদার রেজ়রশার্প ব্যক্তিত্ব। উল্টোদিকের মাড়োয়ারি ভদ্রলোক মাথা নেড়েই সবটা ম্যানেজ করেন। নিজের গল্পের নায়কের ডাইমেনশন জানিয়ে ফেলুদার অপরিসীম সেন্স অফ হিউমারকে কাউন্টার করেন যে সপ্রতিভতার সঙ্গে, তার মধ্যে পরতে-পরতে হাসি থাকলেও সেটার ভিতরে মস্তিষ্কের পুষ্টির জোগান প্রচুর।

এ ছাড়াও অনেক ছোটো-ছোটো ঘটনা, যেমন এথিনিয়াম ইন্সটিটিউশনে শিক্ষাপুষ্ট লালমোহনবাবুর কাছে কবিত্বের শিখরে বসা বৈকুন্ঠ মল্লিকের অপরিণত কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব, নিজের নতুন বইয়ের অনুপ্রাসের ঝংকার সম্বলিত নাম ঠিক করার চমক, এ সবই হাসির ফোয়ারা ছোটায়। প্রচণ্ড বিপদের মুখে গাঙ্গুলিবাবুর অদ্ভূতুড়ে আচার আচরণ আমাদের হাসতে বাধ্য করায়। যেমন, জং বাহাদুর রানার ভোজালি চুরি হয়ে যাওয়ার পরও উনি নিশ্চিন্তভাবে জানান যে শুধুমাত্র খাপটি অবশিষ্ট আছে। রয়েল বেঙ্গল রহস্য গল্পে কালান্তক বাঘের সামনে গাছে উঠে তিনি এমনভাবে সংজ্ঞা হারান, যে গল্পের ওই ভয়ানক ক্লাইম্যাক্সে এসেও পাঠকের মন পড়ে থাকে তাঁর দিকে; ওনার যেন কোনও ক্ষতি না হয়। আগাগোড়া টানটান, সিরিয়াস অপরাধ ও অপরাধতত্ত্বের ঘোরপ্যাঁচের ভিতরও লালুদা সযত্নে লালিত হতে থাকেন।

Jatayu Satyajit Ray

চূড়ান্ত কনফিউজ়ড সিচুয়েশনে তাঁর মুখ থেকে যখন বেরিয়ে আসে অদ্ভুত কিছু শব্দ, যেমন ‘বেঙুর’, ‘হাঁয়েস’, বা ‘ইনপ্রমপটু’, তখন হাততালি দিয়ে, পায়ে তাল ঠুকে হাসতে দেখেছি পাঠককে, আর এখানেই সত্যজিৎবাবুর মাস্টারস্ট্রোক। নিজেদের মধ্যেই একজন হয়েই আদর ও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন গাঙ্গুলিবাবু। কখনওই তিনি লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠেননি। সাধারণ বাঙালির মতোই তাজমহল, কাশ্মীর, পুরী দেখে তাঁর অভিব্যক্তি, আর হংকং-এ গিয়ে স্নেক স্যুপের কথা শুনে, বা লন্ডনে হ্যারডস-এ গিয়ে পেন কিনে, বা নেপালে জ্যাকপট জিতে তাঁর মধ্যে দিয়ে জয়ী কে না হয়েছে?

Jatayu Satyajit Rayপ্রতিটি বাঙালি স্বপ্নের ও তথ্যের ভরপেট ভুরিভোজের পর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে পাঠক ফেলুদার ক্যারিশমা তো বটেই, তার সঙ্গে জটায়ুর দীর্ঘজীবন কামনায় দিন কাটিয়েছে। গাঢ় সবুজ রঙের গাড়ি, তার বিটকেল জাপানি হর্ন, মশলাদুরস্ত বেস্টসেলারের মালিক অবশ্য দিনের পর দিন ফেলুদার সঙ্গে থেকে কিছুটা পরিশীলিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বভাব রয়ে গেছিল একইভাবে অনাড়ম্বর, তা কোনওদিন বিন্দুমাত্র পাল্টায়নি।

তাশি গাঁওয়ে একদিন

শুধু দেখতেন তিনি, লক্ষ করতেন না। এই দোষে ফেলুদার কাছে অনেকবার বকুনি খেয়েছেন জটায়ু। কিন্তু দমে যাননি। মনখারাপ করতেন না তিনি, বরং দু’গুণ আগ্রহে লাফিয়ে পড়তেন নতুন কিছু শিখতে। আসলে সত্যজিৎবাবু ওনার চোখ দিয়ে পাঠককে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতেন, বুঝিয়ে দিতেন, আর জটায়ুর অদ্ভুত অভিব্যক্তি বা অবস্থাগুলি যেন আমাদের না হয়, তারও পুরোপুরি ব্যবস্থা করে দিতেন তাঁর অত্যাশ্চর্য লেখনীর মাধ্যমে। মগনলালের বাড়িতে পেস্তার সরবত বিষের ভয়ে মুখে তোলেননি লালমোহনবাবু। কিন্তু ‘তেরা নম্বর বক্সা’ আর কিম্ভূতকিমাকার ‘তখত’-এর সামনে দাঁড়িয়ে একটা গোটা মিনিট চেয়েছিলেন তিনি। ঘড়ি, মানিব্যাগ, এমনকি মগনলালের আস্ত ফুলদানিটাও সরিয়ে দিয়েছিলেন। পরক্ষণেই ঢকঢক করে শেষ করেছিলেন সেই সরবতের গ্লাস। এটা দেখে কারও মুখে হাসি সরেনি ঠিকই, সবাই দাঁত কিড়মিড় করেছিল ফেলুদার অপারগতায়, কিন্তু চাট্টি অভিশাপ কুড়িয়েছিল মগনলাল। কেন? কারণ গাঙ্গুলিবাবু জোকার নন, কারন উনি সামান্য এক বিদূষক নন, কারন তিনি আমাদের চোখের মণি, কারন তিনি আমাদের রুক্ষ জীবনে এক সবুজ, রসালো ওয়েসিস।

ম্যাজিকল্যাম্প ওয়েবম্যাগে প্রথম প্রকাশিতAmazon Obhijaan

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Pratik

A Ray fanatic who writes for children and picks up the paintbrush in free time. Explorer and wanderlust. Owns and operates a resort in Dooars. Photography and stepping on the adventure trail is his hobby

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *