তৈরি হল না যে ঘরে বাইরে

বড় পর্দায় ফিরছে ঘরে বাইরে। পরিচালক অপর্ণা সেন। নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের গল্প বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসছেন অপর্ণা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়ের পটভভূমিতে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন একই নামের ছবি। প্রধান চরিত্রে ছিলেন ভিক্টর ব্যানার্জী, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অপর্ণার ছবিতে নিখিলেশ, বিমলা, সন্দীপের ভূমিকায় দেখা যাবে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, তুহিনা দাস, ও যীশু সেনগুপ্তকে। নিখিলেশের চরিত্রে প্রথমে কৌশিক সেনকে ভাবা হলেও অডিশনে তার বয়স বেশি লাগায় তাকে বাদ দিয়ে অনির্বাণকে নেওয়া হয়।

সত্যজিতের পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। কিন্তু তারও প্রায় চার দশক আগে ঘরে বাইরে উপন্যাস অবলম্বনে ছবি করার কথা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ।

সেটা ১৯৪৭ সাল। সত্যজিৎ ও তাঁর বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্ত মিলে তৈরি করলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। সঙ্গে ছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও আর পি গুপ্ত। কলকাতায় আন্তর্জাতিক ছবি, বিশেষ করে ইউরোপীয় নিয়ো-রিয়ালিস্ট সিনেমা দেখার পীঠস্থান হয়ে ওঠে এই সংস্থা। বাংলা ছবির বহু বিশিষ্ট পরিচালকই ছিলেন এই সংগঠনের সদস্য।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

ফিল্ম সোসাইটিরই একটি সভায় ১৯৪৮-এ সত্যজিতের আলাপ হয় হরিসাধন দাশগুপ্তর সঙ্গে, পরবর্তীকালে তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। প্রথম আলাপেই দুই দিকপাল বুঝে গেছিলেন চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁদের চিন্তাভাবনা অনেকটাই এক। দুজনেরই মাথাতেই তখন ছবি তৈরি করার ভূত প্রায় পাকাপাকিভাবে বাসা বেঁধেছে। সত্যজিৎ তখনও বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে কর্মরত। তাঁর বাড়িতেই চিদানন্দ, বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও ছিন্নমূল ছবির পরিচালক নিমাই ঘোষের বন্ধুত্বের শুরু।

ছবি তো করতেই হবে। কিন্তু গল্প? হরিসাধন চেয়েছিলেন ঘরে বাইরে নিয়ে ছবি করতে। বেশ, সেটাই হোক তাহলে। চিত্রনাট্য লিখলেন সত্যজিৎ, পরিচালক হরিসাধন। প্রোডাকশন ডিজ়াইনে বংশী চন্দ্রগুপ্ত, সঙ্গীত পরিচালনায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, ক্যামেরায় অজয় কর। নক্ষত্র সমাবেশ সন্দেহ নেই। এই সেই অজয় কর যার পরিচালনায় পরবর্তীকালে বেরোবে শ্যামলী, হারানো সুর, সপ্তপদী, সাত পাকে বাঁধা-এর মত সুপারহিট ছবি।

Advertisement

চিত্রনাট্য তো লেখা হল। এবার চিন্তা অর্থের। টাকা আসবে কোথা থেকে? ছবির খরচের জন্য নিজের যতীন দাস রোডের বাড়ি বিক্রি করলেন হরিসাধন। এছাড়াও মায়ের কাছ থেকে ধার করলেন কুড়ি হাজার টাকা। বিশ্বভারতী থেকে উপন্যাসের ডবল ভার্শন কপিরাইট কেনা হল। ঠিক হল নিখিলেশের চরিত্রে থাকবেন রাধামোহন ভট্টাচার্য, সন্দীপের ভূমিকায় অভি ভট্টাচার্য। মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। বিমলার চরিত্রের জন্য খুঁতখুঁতে সত্যজিৎ শান্তিনিকেতন থেকে ধরে আনলেন শ্যামলা, দীর্ঘাঙ্গী সোনালি সেন-কে। ইনি ছিলেন পরিচালক বিমল রায়ের আত্মীয়া। রাধামোহন চিনতেন সোনালিকে, তিনিও রাজি হলেন।

শব্দ যখন ছবি আঁকে

ছবির বহিঃদৃশ্য গ্রহেণর জন্য নির্বাচিত হল উত্তরপাড়া রাজবাড়ি। ১৬মিমি হাতেধরা ক্যামেরায় তোলা হল কিছু প্রি-প্রোডাকশনের শট। প্রযোজক হিসেবে এগিয়ে এলেন মাখন ঘোষ। নতুন অফিসও নেওয়া হল। সত্যজিৎই প্রযোজনা সংস্থার নামকরণ করলেন কোনার্ক পিকচার্স।

কিন্তু পরিকল্পনা পর্ব থেকেই বিবিধ কারণে দেরি হতে লাগল ছবির শ্যুটিং। গড়িমসি করতে লাগলেন প্রযোজকও। এল ছোটবড় আরও নানান সমস্যা। শেষমেশ একদিন বন্ধই হয়ে গেল এই ছবির কাজ।

ঝান্ডি অভিযান

প্রথম লেখা চিত্রনাট্য, তাই দূর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। সত্যজিৎ বেশ কয়েকবার ঘরে বাইরে অবলম্বনে ছবি করতে চেয়েছিলেন। শোনা যায়, অপরাজিত ছবির শ্যুটিংয়ের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দী ছিলেন বেশ কিছুদিন। সেই সময় নাকি উত্তমকুমার দেখা করতে এসেছিলেন তার সাথে এবং সত্যজিৎ তাকে সন্দীপের চরিত্রটি অফার করেন। উত্তম ভাববার জন্য কিছুটা সময় চেয়েছিলেন এবং পরে টেলিফোন করে সত্যজিৎকে ‘না’ বলে দেন। তবে এ সবই লোকমুখে শোনা কথা। সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের কোনও অবকাশ নেই।

যে জন থাকে মাঝখানে

১৯৮৪ সালে মু্ক্তিপ্রাপ্ত ছবির চিত্রনাট্যে বেশ খানিকটা বদল এনেছিলেন সত্যজিৎ। সম্প্রতি এক সত্যজিৎ-স্মরণ অনুষ্ঠানে শর্মিলা ঠাকুর জানান, বিমলার চরিত্রের জন্য তিনি এবং অপর্ণা দুজনেই দরবার করেছিলেন পরিচালকের কাছে। দুজনকেই নিরাশ করেন সত্যজিৎ। নেন স্বাতীলেখাকে। তবে বিমলার চরিত্রে স্বাতীলেখার অভিনয় প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। বহু বিশিষ্ট চিত্র সমালোচক অভিযোগ করেন, এরকম একটি জোরদার চরিত্রে স্বাতীলেখার ভাবলেশহীন অভিনয় সৌমিত্র, ভিক্টরের মত অভিনেতার পাশে একেবারেই বেমানান।

তথ্যসূত্র: চলচ্চিত্রযাপন, হরিসাধন দাশগুপ্ত

Amazon Obhijaan

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *