জটায়ুর সাহস

তুফান মেল সবে কানপুরে এসে দাঁড়িয়েছে। জানলা দিয়ে বাইরেটা একবার দেখে নিল তোপসে। তারপর আড়মোড়া ভেঙে প্রাতরাশের খোঁজে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ফার্স্ট ক্লাস কামরায় কোট-টাই পরিহিত যে লোকটি ঢুকলেন, তিনি বাঙালি সিনেপ্রেমীদের মনে পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিলেন। সেলুলয়েডে সেই প্রথম এলেন লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। আর আবির্ভাবেই বাজিমাৎ। নির্দ্বিধায় বলা যায়, সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট ফেলু, তোপসে ও জটায়ুর মধ্যে তৃতীয়জন সবথেকে বর্ণময়।   

বিদেশী হার্ডবয়েল্ড ক্রাইম থ্রিলার কাহিনীর একেবারে বিপরীত মেরুতে হলেও, ফেলুদা সিরিজ়ে জটায়ুকে কমিক রিলিফ হিসেবেই এনেছিলেন তাঁর স্রষ্টা সত্যজিৎ। সত্যি কথা বলতে কী, ‘নয়ন রহস্য’ উপন্যাসে তো পাঠক ফেলুদাকে চিঠি পাঠিয়েছিল এই বলে: ‘জটায়ু আর আগের মতো হাসাতে পারছেন না।’ তাতে ভদ্রলোক রেগে গিয়ে বলেন: ‘আমি কি সং?’

এই রেগে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কোথাও গিয়ে হয়তো মানুষটার মনে এই তকমাটা বিঁধেছিল। বহু ফেলুকাহিনীতে জটায়ু তার সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, রহস্যের জট ছাড়াতে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই তাঁকে ‘সং’ ভাবলে তাঁর রাগ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

আরও পড়ুন: মিডলম্যানের চরিত্রে বিশ্বনাথ

‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাসের কথাই ধরা যাক। মন্দার বোসের বন্দুকটা (পরে অবশ্য জানা যায় সেটা খেলনা) জটায়ুর হাতে দিয়ে ফেলুদা বলেছিল, ‘গোলমাল দেখলে স্রেফ ট্যাঁক থেকে ওটি বার করে সামনের দিকে পয়েন্ট করে দাঁড়িয়ে থাকবেন।’ ফেলু ইঙ্গিত দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে লালমোহনবাবুর হাতেও বন্দুক চলে এসেছিল। হাত কাঁপলেও তিনি স্মার্টলি সেটা ধরে থাকার চেষ্টা করেছিলেন।

শুরুটা কমিক রিলিফ হিসেবে হলেও, জটায়ু ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন ফেলু ও তোপসের সবথেকে কাছের মানুষ। সাধে কী আর এখনও ভক্তরা তাদের ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ বলে?

জটায়ুর সাহসের উদাহরণ দিতে হলে প্রথমেই তার এক অদ্ভুত শখের কথা বলতে হয়। তা হলো অস্ত্রের সংগ্রহ। ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে ‘নেপাল কা অস্ত্র’ ভোজালি এবং ‘বাক্স রহস্য’ ও ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’তে যথাক্রমে বুমেরাং ও মিলিটারি স্মোকবম্ব। শুধু সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। শোষোক্ত দুটি অস্ত্র মোক্ষম সময়ে কাজে এসেছিল। বুমেরাংটি তিনি নিজে ব্যবহার করেছিলেন। দুটি ক্ষেত্রেই ফেলুদা তার বন্ধুর তারিফ করেছিল।

আরও পড়ুন: নিখোঁজ কন্যা সন্তান নিয়ে নতুন থ্রিলার

ফেলুদা সিরিজ়ের বিভিন্ন গল্পে জটায়ুর সাহসের প্রমাণ রয়েছে। ‘বাক্স রহস্য’-তে ফেলুদার ওপর আততায়ীর হামলা হয়েছিল দিল্লীতে। বাথরুম থেকে জল এনে ফেলুদার জ্ঞান ফিরিয়েছিলেন বেস্টসেলিং রহস্য রোমাঞ্চ লেখক। যদিও ফেলুর জ্ঞান ফেরার পর তিনি বলেছিলেন: ‘আচ্ছা, দিল্লীতে যখন রয়েছি, প্রাইম মিনিস্টারকে একটা ফোন করলে হয় না?’ হাসির উদ্রেক হলেও, জটায়ুর উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না।

‘টিনটোরেটোর যিশু’ উপন্যাসে ফেলুরা যখন হীরালাল সোমানির ঘরে বন্দী, তখন মুক্তি পাওয়ার জন্য ফেলু জটায়ুর সদ্য কেনা টেপ রেকর্ডারটা কাজে লাগায়। তারপর ফেলু যখন দুজন ভাড়াটে গুণ্ডাকে বাগে আনতে নাজেহাল, সেই সময় একটি গুণ্ডাকে প্যাকিং বাক্স দিয়ে ঘায়েল করেন লালমোহন।

এ ছাড়াও ফেলুকে নানাভাবে তদন্তে সাহায্য করেছেন লালমোহন। ছোট-ছোট সূত্র খুঁজে পাওয়ার ক্রেডিট পেতে পারেন এই ‘শর্ট, বল্ড, ডার্ক, মুশটাশ’ওয়ালা ভদ্রলোক। সে আফ্রিকার রাজাই হোক বা হলুদ লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি সোনার পাথরবাটি। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’র প্যাকেটে ঝাঁঝালো গুলবাহার সেন্টের গন্ধের সূত্রও জটায়ুই প্রথম পেয়েছিলেন। ফেলুদাকে দেওয়া জটায়ুর উপহারও তদন্তে সাহায্য করেছে ম্যাজিকের মতো। যেমন ‘গোরস্থানে সাবধান’ কাহিনীতে পেরিগ্যাল রিপিটারের পরিবর্তে কুক কেলভির ঘড়ি রাখা। ফেলু সিরিজ়ে জটায়ুর সবুজ অ্যাম্বাসাডারের ভূমিকার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরও পড়ুন: ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে চরম প্রতিদ্বন্দ্বী, মুক্তি পেল ট্রেলার

কোথাও ঘুরতে গিয়ে ফেলু তদন্তে জড়িয়ে পড়েছে এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। কাজেই, ঘটনার চালচিত্র বর্ণনার দায়ভার এসে পড়েছে তোপশে আর জটায়ুর ওপরেই। এদিকে তোপসে কাহিনীকার, কাজেই তাকে ঘটনাপ্রবাহের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেই হবে। অতএব জটায়ুর মাধ্যমেই পাঠক বহু চরিত্রের প্রেক্ষাপট ও রূপদর্শন করেছেন।

এই চিরসরল, সদাহাস্যময়, নিপাট ভদ্রলোক বেশ কিছু ক্ষেত্রে ফেলুদার হয়ে গোয়েন্দার ভূমিকাও পালন করেছেন। ‘অপ্সরা থিয়েটারের মামলা’য় ফেলুর পা মচকে যাওয়ায় সে তোপসে আর জটায়ুকে জেরা করতে পাঠায়। এই প্রথমবার ভদ্রলোক এরকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় নার্ভাস হয়ে রাতারাতি একগাদা ভিজ়িটিং কার্ড ছাপিয়ে ফেলেন। তাতে লেখা ছিল: লালমোহন গাঙ্গুলী, রাইটার। শুধু তাই নয়, চিরকাল ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষটা শুধুমাত্র প্যান্ট শার্ট পরে বহিরাঙ্গেই পরিবর্তন আনেননি। তোপসে লিখছে: ‘লালমোহনবাবু আজ আরও স্মার্ট; তার হাঁটাচলা এবং কথা বলার ঢংই বদলে গেছে।‘ এ ছাড়া ‘নয়ন রহস্য’ উপন্যাসে যখন তেওয়ারির নিয়োগ করা ডিটেকনিক এজেন্সির গোয়েন্দা প্রদোষ চন্দ্র মিটারের সঙ্গে আলাপ করতে আসে, তখন ফেলুদা অম্লানবদনে জটায়ুকে দেখিয়ে দেয়। অর্থাৎ, খোদ ফেলু মিত্তিরের ভূমিকা নেওয়াতেও জটায়ু যাকে বলে পাসড উইথ ডিস্টিংকশন। এমনকি এ ঘটনার পরে ফেলুদাকে ‘আমার তো দিন ফুরিয়ে এলো’ বলে জটায়ুর লেগপুলও করেছিল।




‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ সুলতানকে দেখতে পাওয়ার পর জটায়ুই ডিএফএর বাড়িতে ফোন করে খবর দেন। উত্তেজনার বশে অবশ্য উনি বলে ফেলেছিলেন: ‘দি সার্কাস হুইচ এসকেপড ফ্রম দি গ্রেট ম্যাজেস্টিক টাইগার’। কিন্তু তাতে কিই বা আসে যায়? অন্যদিকে ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ জটায়ুর জপযন্ত্রের ভূমিকা কে বা কবে ভুলতে পেরেছে? সেদিন শুয়োর গলিতে জটায়ু ও তোপসে যে খেল দেখিয়েছিল, তাতে ফেলুদা শুধু ‘সাবাস’ বলে দু’জনের পিঠ চাপড়েই ক্ষান্ত হয়নি। ‘গোয়েন্দাগিরিতে বীরচক্র থাকলে আমি তোদের দুজনেরই নাম রেকমেন্ড করতাম,’ বলেছিল ফেলু। আবার ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’তে চোখের সামনে বাঘ দেখে গাছের ডালে উঠে অজ্ঞান হয়ে গেলেও, মাটিতে না পড়ে ঝুলে থেকেছিলেন তিনি। জটায়ুর এহেন ক্ষমতার তারিফ করেছিল ফেলু।

আরও পড়ুন: শেষ ছবিতে খলনায়কের চরিত্রে তাপস পাল

তবে জটায়ুর সাহসের স্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতেই। চিররোগগ্রস্ত, বয়সের ভারে ন্যুব্জ অর্জুনের ছোঁড়া একটার পর একটা ছুরির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন এই সদাহাস্যময় চরিত্রটি। তার অপমানের বদলা না নিতে পারলে গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেওয়ার পণ করেছিল ফেলু। ছবির শেষাংশে লালমোহনকে দেখিয়ে ফেলুদা তার মক্কেল অম্বিকা ঘোষলকে বলেছিল: ‘এঁকে চিনে রাখুন। এঁর সাহসের সঙ্গে কোনও গপ্পের হিরোর সাহসের তুলনা হয় না। ইনি করাল কুম্ভীর লেখক, স্বনামধন্য জটায়ু।’

তাঁর সাহসের এর থেকে বড় স্বীকৃতি আর কিই বা হতে পারে?

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Diptajit

An avid reader and a passionate writer of crime fiction. Poems and verses are his second calling. Diptajit is the editor of a Bengali magazine. Nothing makes him weaker than books, films and food

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *