ফেলুপুজো ও বাঙালির হা-হুতাশ
কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে পাওয়া খবরে জানা গেল, বাংলাদেশে ফেলুদাকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ় তৈরি করছেন সে দেশের চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা-পরিচালক তৌকির আহমেদ। তিনটি পর্বের সেই সিরিজ়ে ফেলুদার ভূমিকায় থাকবেন বাংলাদেশের অভিনেতা আহমেদ রুবেল, ফেলুদার ‘নয়ন রহস্য’ গল্পে রূপদান করবেন তিনি। খবর হিসেবে অত্যন্ত নিরীহ হলেও এপার বাংলায় সেটা আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে শুরু হয়ে গেল ‘ভূমিকম্প, ঝঞ্ঝাবাত, জলোচ্ছ্বাস!’
এমনটা হওয়ারই ছিল। ফেলুদা চরিত্রের অভিনেতাকে নিয়ে দর্শকের আশা-নিরাশা-হতাশার সংঘাত নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছর ধরেই এই জিনিস চলছে। স্রষ্টা নিজে ফেলুদা হিসেবে যেমনটা চেয়েছিলেন বাস্তবে হুবহু তেমন কাউকে পাননি। ছবি করার সময় নিজের ভাবনাকে কাটছাঁট করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়েছিলেন তিনি।
সেই শুরু। সৌমিত্র ফেলুদার চরিত্রে যেভাবে বাঙালিকে আচ্ছন্ন করলেন সেই নেশার থেকে বাঙালি আর বেরোতেই পারল না। অথচ সৌমিত্র মোটে দুটো ছবিতে—‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’—ও আশির দশকে বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায় একটি টিভি ধারাবাহিকের দুটি গল্পে—‘গোলকধাম রহস্য’ ও ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’য়—ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এরপরে দীর্ঘ বিরতির পর এলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। সে সময় সোশ্যাল মিডিয়া না থাকায় জনগণ তেমন হইচই করার সুযোগ পাননি, না হলে তাকে নিয়েও নির্ঘাত ভয়ানক আপত্তি উঠত এই অভিযোগে যে ওঁর চেহারা সত্যজিতের ফেলুদার ইলাস্ট্রেশনের সঙ্গে মেলে না। সত্যজিৎ নিজে কিন্তু ছবি করার সময় সেটা নিয়ে ভাবেননি। ‘সোনার কেল্লা’ নিয়ে ছবি করবেন, এরকম চিন্তাভাবনা উনি শুরু করেন ১৯৭২ সাল নাগাদ। তার আগে, ১৯৬৫-তে ‘ফেলুদা’র গোয়েন্দাগিরি’ থেকে শুরু করে, একাধিক উপন্যাস ও ছোট গল্প প্রকাশিত হয়ে গেছে। সেই সব কাহিনীর একটা ইলাস্ট্রেশনও স্বাভাবিক কারণেই সৌমিত্রর সঙ্গে মেলে না। আর ছবি করার সময় সত্যজিৎ যদি সেই ইলাস্ট্রেশনের গোঁড়ামি ধরে রাখতেন, তাহলে বাঙালি ফেলুদার ভূমিকায় সৌমিত্রকে দেখতে পেত না।
যে মৃত্যু আজও রহস্য
যাই হোক, নব্বই দশকের মাঝামাঝি ফেলুভক্তদের উদাসীনতার সুযোগে সব্যসাচী ফেলুদা হয়ে গেলেন। টিউশন ক্লাসে বা পাড়ার ক্লাবে কচ্চিৎ কদাচিৎ যে এই নিয়ে আলোচনা হত না তা নয়। এখন হতে গেলে সব্যসাচীর পূর্বপুরুষকেও এই মহান ফেলুপূজারীরা ক্ষমা করতেন কিনা সন্দেহ। সব্যসাচীর চেহারা স্রষ্টার আঁকা ছবির সঙ্গে না মিললেও তিনিই সবচেয়ে বেশি ছবিতে ফেলুদার চরিত্র অভিনয় করে ফেললেন। বলা বাহুল্য বেশ ভালোই করলেন। বড় পর্দার ছবিগুলো প্রেক্ষগৃহে চললও। ‘বাক্স রহস্য’ টেলিফিল্ম আকারে নন্দনে দু’ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল। মনে রাখতে হবে, তার আগে ধারাবাহিকরূপে এই ছবি টিভির পর্দায় দেখে ফেলেছন দর্শক। যদিও পরবর্তীকালে অনেক দর্শকই সব্যসাচীকে ‘বেশি হাত পা চালায়’ বা ‘মগজাস্ত্রের ব্যবহার কম’ এই সব বলতে ছাড়েনি, তবু তিনি টিকে গেলেন।
কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। এক বছর অন্তর ফেলুদার চরিত্র করতে করতে অতঃপর ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন’, বা বলা যায় এমন বয়সে পৌঁছলেন যেখানে আর প্রদোষ মিত্রর ভূমিকায় তাঁকে মানায় না।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
অগত্যা এলেন আবির চট্টোপাধ্যায়। একটিমাত্র ছবিতে ফেলুদা হলেন তিনি। দর্শক মেনে নিল না। শুধু মেনে নিল না বললে ভুল বলা হয়, সে তো ছবি না চললেও মেনে নিল না বলা যেত। তা হয়নি। কিন্তু ফেলুদা নিয়ে রাতারাতি এমন ‘চলছে না, চলবে না’ শুরু হল তাতে পরিচালক সন্দীপ রায় বাধ্য হলেন অন্য কিছু ভাবতে। এই সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে আর কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাইলেন না তিনি, ‘ডবল ফেলুদা’য় আবার সব্যসাচীকে ফেরালেন । কিন্তু বয়স্ক ফেলুদাকে লোকে মেনে নেবে কেন? সব্যসাচী বাঙালির অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ। অভিনেতা হিসেবে তাঁর ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু স্থূল মধ্যদেশ নিয়ে ‘ডবল ফেলুদা’য় অন্তত তাঁকে বাঙালির অন্যতম প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রে মানায়নি। অতঃপর আরও কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেল বাঙালির হা-হুতাশ।
এসবের মধ্যে যে প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে, সেটা হল এক একবার এক একজন অভিনেতার নাম নিয়ে তাঁকে ফেলুদা করা যেতে পারে এমন একটা প্রস্তাব ওঠা এবং তারপর সেই নিয়ে প্রতিক্রিয়ার ঘূর্ণিঝড় বা সুনামি বয়ে যাওয়া। অবশ্যই এগুলো সবথেকে বেশি চলত সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেলুদা ও সত্যজিৎ গ্রুপগুলোয়। সন্দীপবাবুর সামনে গিয়ে এই সব সমালোচনা আজ অবধি বোধহয় কেউ করেননি। যে সমস্ত কারণে এক একজন অভিনেতাকে বাতিল করা যায়, তার অনেক কিছু নিয়ে স্রষ্টা নিজেও হয়ত ভাবেননি। বরং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে ফেলুদার মেকআপের ক্ষেত্রে আর একটু সজাগ থাকা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেসব কেউ শুনতে রাজি নন স্বাভাবিক কারণেই। বাঙালি যাকে ভগবানতুল্য মনে করে, তাঁকে অন্ধের মতই ভক্তিশ্রদ্ধা করে, এ কথা বার বার প্রমাণিত।
এই একই প্রবণতা দেখা গেছে জটায়ুকে নিয়েও। যতদিন ফেলুদা চরিত্রে সব্যসাচী ছিলেন ততদিন বাঙালির যত মাথাব্যথা ছিল জটায়ুর চরিত্রাভিনেতাকে নিয়ে। কারণ জটায়ু হিসেবে তখন স্থায়ীভাবে কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’র পর সমস্যা এল দুদিক থেকেই। জটায়ুরূপী বিভু ভট্টাচার্য মারা গেলেন, তাই পরের গল্প হিসেবে জটায়ুবিহীন ‘বাদশাহী আংটি’কে বেছে নেওয়া হল।
কিন্তু জটায়ুকে বাদ দিয়ে আর কতদিন ? জটায়ুকে ছাড়া যেসব গল্প আছে তার মধ্যে এক ‘বাদশাহী আংটি’ ছাড়া বড় পর্দার জন্য তেমন জমাটি গল্পই বা কোথায়? তাই এবার ফেলুদা আর জটায়ু দুজনকেই খুঁজতে হবে। আর সেখানেই সবচেয়ে বড় সমস্যা। পরিচালকও খুব বেশি পরীক্ষানিরীক্ষায় যেতে চান না, আর তারও ওপর রয়েছে দর্শকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়।
বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
মুশকিলটা হচ্ছে এই উগ্র ফেলুভক্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরা যে কোনও অভিনেতাকে শুধু অনুমানের ভিত্তিতে এক দেখায় উড়িয়ে দিতে পারেন। বাঙালি নস্টালজিয়া ভালোবাসে, পুরনোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। এখানে বলে রাখা দরকার, ইংরেজরা বাঙালির থেকে কোনও অংশে কম নস্টালজিয়া আক্রান্ত নন। ওরাও এতদিন শার্লক হোমসের ভূমিকায় ব্যাসিল রাথবোন ও জেরেমি ব্রেটকে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু তারাও এখন হোমসরূপী বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচকে মেনে নিয়েছেন। এবং শুধু মেনেই নেননি, সাংঘাতিক জনপ্রিয় হয়েছে নতুন ‘শার্লক’ সিরিজ়। তার আগে বড় পর্দা, ছোট পর্দা, মঞ্চ মিলিয়ে কিছু না হলেও আরও দশজন অভিনেতা হোমসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। হোমসকে নিয়ে ইংরেজদের আবেগ কিছু কম নয়। তবু ওরা যাচাই করে দেখতে পিছপা হয় না। কিন্তু আমরা ওসব পরখ করার ধার ধারি না। কিছু সংখ্যক বাঙালির মতে সৌমিত্রর পর আর কারোরই ফেলুদা হবার যোগ্যতা নেই। তাই আর কেউ এই নিয়ে ছবি না করলেই ভালো।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটি ওয়েব সিরিজ়ে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়েও একইভাবে সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু এই প্রচেষ্টাগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কি ফেলুদা চরিত্রটা বেঁচে থাকবে? নিয়মিত কাজ হচ্ছে বলেই তো গল্পগুলো চর্চায় আছে। যিনিই করুন তিনি তো চেষ্টাটা করছেন। চেষ্টা বন্ধ হয়ে গেলে ভালো কাজ পাওয়ার আশা এমনিও আর থাকবে না। কয়েক বছর আগেও ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু একের পর এক ছবি, টিভি সিরিয়াল বা ওয়েব সিরিজে় ব্যোমকেশ তৈরি হওয়ার ফলে মানুষের আগ্রহের পারদও বাড়তে থাকল। সুজয় ঘোষ যখন ‘অনুকূল’ করছিলেন তখন যথারীতি অনেকেই তাঁকে নিয়ে কটাক্ষ করেন। কিন্তু ছবিটা দেখার পর সবার মুখেই সেলোটেপ। নতুন আঙ্গিকে ওই সময়ের একটা গল্পকে ফেলে তিনি যে কাজটা করেছেন সেটা যথেষ্ট প্রশংসনীয় ছিল। এই কাজটাই বাংলাদেশের ওই সিরিজে পরমব্রতকে নিয়ে করতে চেয়েছিলেন নির্মাতারা। হয়ত অনেকের সেটা ভালো লাগেনি। কিন্তু সেই ভালো করার চেষ্টাটা তো করতে হবে। স্রষ্টার মৃত্যুর পর, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে নতুন কোনও কাজ হবে না, এমন তো হতে পারে না। কিন্তু কাজটা হওয়ার আগেই সেটার সমালোচনা শুরু হলে তো ভালো কাজের সুযোগটাই আর থাকবে না।
তবে এসব আলোচনায় বিশেষ কিছু লাভ নেই। কেন না আগামী বছর নতুন ফেলুদা বাছাইয়ের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও বিক্ষোভ আর অভিযোগের সুনামি আছড়ে পড়বে বাঙালির ড্রয়িং রুম থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে ও স্মার্টফোনের পর্দায়। এসি ঘরে বসে, কিবোর্ডের বোতাম টিপে সমালোচনা করতে আর কিই বা পরিশ্রম হয়!