সন্ন্যাসী রাজা, নাকি রাজকীয় প্রতারক?
বড় পর্দায় ফিরছে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর গল্প। পুজোয় মুক্তি পেতে চলেছে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘এক যে ছিল রাজা’। ছবির গল্প বিখ্যাত ভাওয়াল এস্টেট মামলা অবলম্বনে। এর আগে ১৯৭৫-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিটির সঙ্গে ভাওয়াল জমিদারীর গল্পের কিছুটা মিল থাকলেও অমিলই বেশি ছিল। যদিও পরিচালক পীযুষ বসু কোথাও দাবী করেননি যে ছবিটি ভাওয়াল মামলার ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, তবুও ছবির কাহিনী সেইদিকেই ইঙ্গিত করে। আজও বাঙালি দর্শক ভাওয়াল এস্টেটের ঘটনা বলতে সন্ন্যাসী রাজা ছবিটিই ধরে নেন।
সন্ন্যাসী রাজা ছবির গল্পটি কি ছিল?
এই ছবিতে ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ হলেন সূর্যকিশোর, রাণী বিভাবতী দেবী হলেন ইন্দু। জমিদারীর বিষয় সম্পত্তি ও সংসার নিয়ে রাজার তেমন আগ্রহ ছিল না। তিনি মদ, গানবাজনা, বাঈজী নিয়েই মশগুল থাকতেন, যদিও স্ত্রীকে তিনি যথেষ্ট ভালবাসতেন এবং অসম্ভব প্রজাবৎসল ছিলেন। এই সুযোগে রাজবাড়ির আশ্রিত ডাক্তার বিজয় ষড়যন্ত্র করে রাজাকে মৃত ঘোষণা করে এবং নিজে জমিদারীর দখল নেয়। কিছুদিন পরে সূর্যকিশোর সন্ন্যাসীরূপে তাঁর জমিদারীতে ফিরে আসেন এবং প্রজাদের মুখ চেয়ে সম্পত্তি দাবি করেন। অবশেষে রাণীর এক সাক্ষীতেই কেসের সমাধান হয়। প্রজাদের হাতে ডাক্তারের মৃত্যু ঘটে। এই ছিল ছবির মূল গল্প। সূর্যকিশোর ও রাণী ইন্দুর ভুমিকায় উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবীর অসাধারণ অভিনয় বাঙালি মনে রেখেছে আজও।
যে জন থাকে মাঝখানে
কিন্তু ভাওয়াল এস্টেটের আসল ঘটনা ছিল অনেকটাই অন্যরকম।
ঘটনার শুরু রমেন্দ্রনারায়ণের বাবা রাজেন্দ্রনারায়ণের আমলে। ঢাকা জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারী ছিল ভাওয়াল এস্টেট। ভাওয়ালদের জমিদারবাড়ি ছিল জয়দেবপুরে। তৎকালীন গ্রাম এবং অধুনা শহরতলী জয়দেবপুরে সেই সময়েও রাজবাড়ি, হাইস্কুল, কাছারি বাড়ি, সবই ছিল। জমিদারীর আয় ছিল তখনকার দিনে বছরে সাড়ে ছ’লাখ টাকা। রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ সর্বক্ষণ ভোগবিলাসে মেতে থাকতেন। জমিদারীতে তাঁর একেবারেই মন ছিল না। তার উপর এস্টেটের ম্যানেজার নিজের আখের গোছাতে রাজাকে বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে জড়াতে চাইতেন না।
অগত্যা ভাওয়াল এস্টেটের হাল ধরেন রাজেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রাজমাতা বিলাসমণি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় স্বভাবের মহিলা। তাঁর তিন পুত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতে গিয়ে রাজমাতা বুঝলেন ছেলেদের সঠিক পথে চালনা করতে গেলে আগে তাঁদের উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য তিনি মিস্টার হোয়াটনকে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হল না। জমিদারীর আগাধ টাকা হাতে আসার ফলে তিন পুত্রই বেহিসেবী জীবনযাপন করতে শুরু করল।
এক উপরি পাওনা, তারপর নিকষ কালো অন্ধকার
১৯০১ সালে মৃত্যু হল রাজেন্দ্রনারায়ণের। জমিদারীর সব দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন বিলাসমণি। এর পরের বছর মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ হল অপরূপ সুন্দরী বিভাবতীর সঙ্গে। ১৯০৩ সালে মৃত্যু হল বিলাসমণির। রাজবাড়িতে বিভাবতী যে খুব সুখী ছিলেন তা নয়। রমেন্দ্রনারায়ণ রাজসন্তান হলেও, তাঁর চালচলন একেবারেই রাজার মতো ছিল না। পড়াশোনা প্রায় জানতেনই না তিনি, শুধু নাম সই করতে পারতেন। কথাও বলতেন গ্রাম্য ভাষায়। এছাড়া অন্য দুই ভাইয়ের মতো মেজকুমারেরও নানারকম চরিত্রের দোষ ছিল। সেই সঙ্গে যোগ হয় এক কুৎসিত রোগ, সিফিলিস। সন্ন্যাসী রাজা ছবিতে এই রোগের কোনও উল্লেখ স্বাভাবিকভাবেই রাখা হয়নি। প্রিয়তম মহানায়ককে এরকম এক রোগে আক্রান্ত দেখলে বাঙালি দর্শক মেনে নিত না বলাই বাহুল্য।
ইতিহাসে ফেরা যাক। বহুদিন ধরেই এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন রমেন্দ্রনারায়ণ। ১৯০৯ সালে তাঁর হাতে বড় বড় আলসারের মতো ঘা বেরোতে থাকে এবং তা ক্রমশ খারাপের দিকে যায়। এই অবস্থায় রাজবাড়ি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে গরমের হাত থেকে বাঁচাতে মেজকুমারকে কিছুদিনের জন্য দার্জিলিঙে পাঠানো হবে। সেই সময় রমেন্দ্রনারায়ণের বয়স ছিল পঁচিশ। সেইমত ১৮ এপ্রিল মেজকুমার দার্জিলিঙের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করেন। সঙ্গে যান রাণী বিভাবতী, তাঁর দাদা সত্যেন্দ্র, পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ ও ২১ জন পরিচারক।
যে মৃত্যু আজও রহস্য
প্রথম কদিন নির্বিঘ্নে কাটলেও এরপর দিন দিন মেজকুমারের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। প্রবল জ্বর ও পেটের সমস্যায় ৬ মে রমেন্দ্রনারায়ণের শারীরিক অবস্থা গুরুতর আকার নেয় এবং পরদিন চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তিনদিনের মধ্যে দার্জিলিঙের স্থানীয় মানুষজনের সাহায্যে মেজকুমারকে দাহ করে ভাওয়ালে ফিরে আসেন বাকিরা।
এর কিছুদিন পর, ১৮ মে মেজকুমারের শ্রাদ্ধের দিন, নানারকম কথা উঠতে থাকে যে রমেন্দ্রনারায়ণের মৃতদেহটি শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা সৎকার করা হয়নি। এই গুজবকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও শোকে আত্মহারা প্রজারা এমন একটি আশার কথা হয়ত একেবারে ফেলে দিতে পারেননি। এই সময় থেকে সরকারীভাবে বিভাবতীর এজেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্র। রাণীর সম্পত্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ তিনিই দেখাশোনা করতে থাকেন। রমেন্দ্রনারায়ণের নামে যে জীবনবিমা ছিল তাও সত্যেন্দ্র খুব সহজেই আত্মসাৎ করেন।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
১৯১০ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান ভাওয়াল এস্টেটের বড়কুমার রনেন্দ্রনারায়ণ। এর পরের বছর মেজরাণীর সম্পত্তি তৎকালীন বৃটিশ সরকারের কোর্ট অব ওয়ার্ডস অধিকৃত করে। সেই সময়ে কোনও জমিদারীর মালিক এস্টেট পরিচালনায় অক্ষম হলে, সরকার আইনবলে সেই জমিদারী অধিগ্রহণ করত এবং বিনিময়ে মালিকপক্ষকে বার্ষিক ভাতা দেওয়ার নিয়ম ছিল। ১৯১১ সালে ছোটকুমার রবীন্দ্রনারায়ণকে নাবালক ঘোষণা করে সরকার তাঁর সম্পত্তিও অধিগ্রহণ করে। কিছুদিন পরে এইভাবেই বড়রাণী সরযুবালার সম্পত্তিও অধিকৃত হয়। এর কয়েক বছর বাদে ছোটকুমারও অল্পদিন রোগভোগের পর মারা যান। অর্থাৎ এমন একটা অবস্থা দাঁড়ালো যে ভাওয়াল রাজবাড়িতে আর একজনও উত্তরাধিকারী বেঁচে রইল না। তিন রাণী যদিও রাজবাড়িতেই থাকতেন কিন্তু তিনজনেরই কোনও সন্তান ছিল না। তাদের সম্পত্তিও সরকার দ্বারা অধিকৃত হয়েছিল আগেই, যদিও ছোটরাণী আনন্দকুমারী প্রায় ছ’বছর পর দত্তকপুত্র নেন।
এর মধ্যে মাঝে মাঝেই খবর আসতে থাকে যে মেজকুমার মারা যাননি। উত্তর ও পূর্ব ভারতের নানা জায়গায় তাঁকে দেখা গেছে। রমেন্দ্রনারায়ণ মারা যাবার ১২ বছর পর ১৯২১ সালে ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে বাকল্যান্ড বাঁধে এক সাধু এসে উপস্থিত হন। তার পরনে শুধুই কৌপীন, সারা অঙ্গে ছাই মাখা, মাথায় বিশাল জটা। শহরের এক নামী ধনী পরিবারের বাড়ির সামনে এসে থাকা শুরু করলেন এই সাধু। তিনি কথা বলতেন খুবই কম, এবং যেটুকু বলতেন সেটাও হিন্দিতে। এই সাধুকে নিয়ে গুজব রটে যায় যে ইনিই ভাওয়ালের মেজকুমার। সেই গুজবের ঢেউ গিয়ে পৌঁছয় জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে। এর কিছুদিন পর রমেন্দ্রনারায়ণের মেজদিদি জ্যোতির্ময়ী নিজে সাধুকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন তাঁর বাড়িতে। সেখানে তাঁকে বারবার দেখে ও নানারকম প্রশ্ন করে জ্যোতির্ময়ী নিশ্চিত হন এই সাধুই তাঁর ভাই রমেন্দ্রনারায়ণ। সাধু নিজমুখে তা স্বীকার করতে না চাইলেও, এক সময় না কি রমেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর প্রসঙ্গে কেঁদে ফেলেন আর বলেন যে রাজা ওইদিন মারা যাননি। রমেন্দ্রনারায়ণের শরীরে যে সমস্ত জন্মদাগ ছিল বা ছোটবেলায় অন্য সমস্ত চিহ্ন ছিল, তা খতিয়ে দেখা যায় সবই প্রায় মিলে গেছে।
Advertisement
দিনটা ছিল ৪ মে। তার তিনদিন পর মেজকুমারের মৃত্যুর ১২ বছর পূর্ণ হবে। সেইদিন প্রচুর প্রজা জ্যোতির্ময়ীর বাড়ীর সামনে ভিড় করেন ও মেজকুমারের নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকেন। এই সময় সাধু স্বীকার করে নেন যে তিনিই ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ। পরের দিন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিন্ডসেকে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে গোপন রিপোর্ট পাঠান ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার নিডহ্যাম।
কিন্তু প্রজারা মেনে নিলেও রাজার আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই সাধুকে রমেন্দ্রনারায়ণ বলে মেনে নিতে নারাজ। বিভাবতী ও সত্যেন্দ্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু মৃত রাজাকে ফিরে পেয়ে প্রজারা এতই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে যে এক সময় তারা ব্রিটিশ কালেক্টরকে খাজনা দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। তাদের তখন একজনই রাজা, মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ, ওরফে সেই সাধু। যদিও সাধুর হাবভাবেও ততদিনে পরিস্কার যে তিনি এখানেই থেকে যেতে চান। ইতিমধ্যেই তিনি সন্ন্যাসীর বেশ ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরা শুরুও করেছেন।
সত্যজিৎ ও রেলভূত
এই সময় বিভাবতী দেবী জয়দেবপুরে গিয়ে প্রজাদের বোঝাবার চেষ্টা করেন এই সাধু তাঁর স্বামী, ভাওয়ালের মেজকুমার নন। কিন্তু এস্টেটের প্রজারা ততদিনে রাণীর দিকেও আঙুল তোলা শুরু করেছে। কাজেই তারা বিভাবতীর দাবীকে এক কথায় নস্যাৎ করে দেয়। সন্ন্যাসী রাজা ছবিতে স্বাভাবিক কারণেই বাস্তব ঘটনার ঠিক উল্টোটাই দেখানো হয়েছিল। রাণীর ভূমিকায় সুপ্রিয়া দেবী মহানায়কের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন, তাও আবার যখন উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রটিকে শুরু থেকেই পজ়িটিভ হিসাবে দেখানো হয়েছে, সেটা দর্শক কখনওই মেনে নিত না। পরিচালক সেই ঝুঁকিও নেননি।
যাই হোক, ঢাকা কোর্টে ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল শুরু হল তৎকালীন ভারতবর্ষে সবথেক বেশিদিন ধরে চলা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা। রাণী বিভাবতী সাধুকে মেনে না নিলেও ধীরে ধীরে বড় রাণী সরযুবালা কিন্তু সাধুকে মেজকুমার বলে মেনে নেন। এই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দেন ডাক্তার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, যিনি রমেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর সময় দার্জিলিঙে উপস্থিত ছিলেন। প্রাণকৃষ্ণ কোর্টকে জানান যে তিনি যখন গিয়ে পৌঁছন তখন মৃতদেহ একটি চাদরে ঢাকা ছিল। তিনি হাত দিতে যাবেন এমন সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোক বলতে শুরু করেন, যেহেতু তিনি ব্রাহ্ম, তাই হিন্দু মৃতদেহ ছোঁওয়ার কোনও অধিকার তাঁর নেই। এই অদ্ভুত আচরণে অত্যন্ত অপমানিত হয়ে প্রাণকৃষ্ণ তখনই সেখান থেকে চলে যান। অর্থাৎ মৃতদেহ তিনি পরীক্ষাই করেননি। সরযুবালাও এই মর্মে সাক্ষী দেন যে সাধুকে প্রথম দেখেই তিনি মেজকুমার বলে চিনতে পেরেছিলেন। তবে এখানে অন্য একটি ব্যাপারও ছিল। ছোটরাণী একটি দত্তক পুত্র গ্রহণ করেছিলেন এবং তা ছিল বড় রাণীর ক্ষোভের এক কারণ। সরযুবালার নাকি একান্ত ইচ্ছে ছিল যে তাঁর ছোট ভাইয়ের ছেলেকে ছোটরাণী দত্তক নিক। কিন্তু তা ঘটেনি। তাই মনে করা হয় যে এই কারণেই তিনি সাধুকে নিজের দেওর বলে স্বীকার করেছিলেন।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
এছাড়া মেজকুমারের এক মাসিও সাক্ষ্য দেন এই মর্মে যে রমেন্দ্রনারায়ণ মারা যাবার পর তিনি বিভাবতীর কাছে জানতে পারেন, মৃত্যুর সময় বিভাবতী তার স্বামীকে দেখতে পাননি। ইচ্ছে থাকলেও তাঁকে স্বামীর মৃতদেহের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। এই সময় সাধু নিজে আদালতে দাঁড়িয়ে এমন অনেক কথা বলতে থাকেন যা একমাত্র ভাওয়ালের মেজকুমারের পক্ষেই জানা সম্ভব। তার হাত, পা ও শরীরের গড়ন ছিল পরিবারের বাকিদের মতই। এমনকি অসুস্থতার কয়েকদিন আগে মেজকুমার একটি বাঘ শিকার করেন। সেই বাঘের নখের আঁচড়ের দাগও সাধুর হাতে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি জানান গুরুতর অসুস্থতার সময় ডাক্তারের দেওয়া কোনও ওষুধেই কাজ হয়নি। উল্টে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়। মারাত্মক দুর্বলতার মধ্যে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর একদল নাগা সন্ন্যাসীকে দেখতে পান তিনি। তাঁদের সঙ্গেই উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। অমরনাথে গিয়ে তিনি গুরু ধর্মদাসের কাছে দীক্ষাও নেন।
অবশেষে ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকায় বিচারক পান্নালাল বসুর ৫২৫ পাতার রায় বেরোয়, যার মূল বক্তব্য ছিল ‘ফরিয়াদীই রমেন্দ্রনারায়ণ রায়, ভাওয়ালের প্রয়াত রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র।’
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
কিন্তু চুপ করে রইলেন না বিবাদী পক্ষ। কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করলেন বিভাবতী ও তাঁর দাদা সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯৩৮-এর ১৪ নভেম্বর থেকে আবার শুরু হল মামলা। এই মামলার রায় বেরলো ১৯৩৯ সালের ১৪ আগস্ট। এখানেও জিতলেন সন্ন্যাসী। আবারও প্রমাণিত হল তিনিই ভাওয়ালের মেজকুমার। এই সময়ে সাধুর হয়ে মামলার সমস্ত খরচ বহন করেন সরযুবালা।
কিন্তু হার মানবেন না বিভাবতী। তিনি এবার মামলা করলেন সবচেয়ে উচ্চতর আদালত, লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। ততদিনে বিভাবতী আর সত্যেন্দ্রর বিরুদ্ধে এই মত প্রচারিত হয়ে গেছে তাঁরা দুজনে মিলে মেজকুমারকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন। এর সঙ্গে আর একজনের নামও উঠে আসে। তিনি হলেন সেই ডাক্তার। বলা হয় তিনি রাণীর বিশেষ কাছের মানুষ ছিলেন। রাণীর সঙ্গে এনার নাম জড়িয়ে নানান কুৎসা রটতে থাকে চারিদিকে।
এই সময় মেজকুমারের বড়বৌদি সরযুবালা বুঝতে পারেন যে সন্ন্যাসীকে বিভাবতী তাঁর স্বামী হিসেবে কোনওদিনই আর মেনে নেবেন না। এই ভেবে সরযুবালা সাধুর বিবাহ দেন ধারা মুখোপাধ্যায় নামের একটি মেয়ের সঙ্গে। এই বিবাহ হয় কাশীতে। দুজনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন কলকাতার বিবেকানন্দ রোডের একটি বাড়িতে।
ফেলুদা হওয়ার কোনও প্রস্তাব এখনও পাইনি: যীশু সেনগুপ্ত
অবশেষে ১৯৪৬-এর ৩০ জুলাই প্রিভি কাউন্সিলের তরফে রায় বেরোয় যে এই সাধুই ভাওয়ালের মেজকুমার। আবারও হার হয় বিভাবতীর, এবং সেই সঙ্গে তাঁর অন্তিম আশাও শেষ হয়ে যায়।
কিন্তু ট্র্যাজেডির এখানেই শেষ নয়। প্রিভি কাউন্সিলের রায়ের খবর কলকাতায় পোঁছয় ৩১ জুলাই। সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা সন্ন্যাসী রাজা ঠনঠনিয়া কালিবাড়িতে পুজো দিতে যাওয়ার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরের দিন তার মৃত্যু হয়। অর্থাৎ ৩৭ বছরের মধ্যে দুবার মৃত্যু হল রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের। যদিও রাণী বিভাবতী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ওই ব্যাক্তিকে রমেন্দ্র বলে মেনে নেননি। সাধুর মৃত্যুর পর সরকারের দেওয়া আট লক্ষ টাকাও তিনি ভাতা হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল যে টাকা সরকার এতদিন দেয়নি, তা আজ ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর দেবে কেন, আর তা নিলে তো পরোক্ষে স্বীকার করা হয়েই যায় যে ওই ব্যাক্তিই রমেন্দ্র। তা তিনি কিছুতেই পারবেন না, তাই সেই টাকা তিনি ফিরিয়ে দেন। রাণীর বিশ্বাস ছিল ওই ব্যাক্তি আসলে রাজবাড়ির সহিসের ছেলে। তাই রাজবাড়ির সমস্ত খবর তার পক্ষে জানা খুবই স্বাভাবিক। আর এই ছেলেটির পিতৃ পরিচয়ের মধ্যেই রাণীর আসল সন্দেহ লুকিয়ে ছিল। তাঁর ধারণা ছিল এই ব্যক্তির পিতা হলেন রাজেন্দ্রনারায়ণ স্বয়ং, যা তখনকার দিনে অনেক রাজপরিবারে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
বিয়ের হাফ সেঞ্চুরি করলেন ভাস্বর
ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘এ প্রিন্সলি ইম্পস্টার’ বইটি অবলম্বনে ভাওয়াল রাজার মামলা নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই বড় পর্দায় আসতে চলেছে সৃজিতের ছবি। ভাওয়াল রাজাকে ঘিরে এতদিনের অনেক গল্পকথার হয়ত অবসান হবে এই ছবির মাধ্যমে। আবার অন্যদিকে নতুন করে বিতর্ক ওঠাও আশ্চর্যের নয়। এক শতকেরও বেশি সময় পেরিয়ে আজও মানুষের মনে এই মামলা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই।
ঠিক কি ঘটেছিল ১৯০৯ সালের ৬ মে? রমেন্দ্রনারায়য়ণ কি আদৌ মারা গেছিলেন? ওই সাধুই কি ছিলেন ভাওয়ালের মেজকুমার, নাকি রাণীর দাবী অনুযায়ী তিনি ছিলেন নিছকই এক প্রতারক? সত্যিটা ঠিক কি ছিল, তা আজ আর জানা সম্ভব নয় কোনওভাবেই। শুধু বিশাল এক এস্টেটের রূপকথার গল্প হয়েই মানুষের মনে আজীবন থেকে যাবে ভাওয়াল মেজকুমারের কাহিনী।