ভেবেছিলাম এত কঠিন চরিত্র আমি পারব না: মমতা শঙ্কর
অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন ১৯৭৫ সালে। প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল আজও বাংলা ছবিতে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এ বছরের শুরুতেই আসছে তাঁর নতুন ছবি ‘বিজয়ার পরে‘। অভিজিৎ শ্রীদাস পরিচালিত এই ছবিতে তিনি ছাড়াও রয়েছেন দীপঙ্কর দে ও স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। সেই ছবি ও আরও নানা বিষয়ে কথা বললেন মমতা শঙ্কর। শুনল রেডিওবাংলানেট
তুমি নাকি এই ছবিটা করতেই চাওনি
মমতা শঙ্কর: অভিজিৎ কিন্তু শুরুতে আমার কাছে আসেনি। অন্য কয়েকজন অভিনেত্রীর কাছে গেছিল। সেখান থেকে নানা কারণে প্রত্যাখ্যান পেয়ে যখন বেশ হতাশ তখন টিটোদা (দীপঙ্কর) ওকে আমার নাম প্রস্তাব করে। তারপর ও আমার কাছে চিত্রনাট্য নিয়ে আসে। আমার ওর সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল, খুবই ভদ্র এবং বুদ্ধিমান ছেলে। আর কী করতে চাইছে সেটা ওর কাছে স্পষ্ট, যেটা সবার ক্ষেত্রে হয় না। তবে প্রথমবার চিত্রনাট্য পড়ে মনে হয়েছিল খুব কঠিন চরিত্র, এটা আমি পারব না।
এতবছর ধরে অভিনয় করে তোমার এখনও এরকম মনে হয়?
মমতা শঙ্কর: এটা খুব ইন্টেন্স একটা ছবি যেটায় মনের ওপর অসম্ভব চাপ পড়বে। খুব কঠিন মনে হচ্ছিল কাজটা কারণ এই চরিত্রটা এমন যে ভেতরে একরকম বাইরে আরেকরকম। আমি নিজে এরকম নই, তাই এই চাপটা একটানা নেওয়া আমার মনে হয়েছিল বেশ শক্ত হবে। আমি আসলে সব চরিত্র নিয়েই এখনও ভয় পাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পর্দায় দেখার পর আমার মনে হয়, এত খারাপ কী করে করলাম। আমার এক্কেবারেই পছন্দ হয় না। আর হলে দেখতে গিয়ে তো মনে হয় দর্শক এই জায়গায় অন্যমনস্ক হয়ে যাক, ঘুম পেয়ে যাক, কিছু একটা হোক, কেউ যেন আমার কাজটা না দেখে। কারণ আমি জানি কাজটা জঘন্য হয়েছে।
আরও পড়ুন: এত ‘অরণ্য’ কেন?
প্রায় অর্ধশতকের অভিনয় জীবন। তোমার এখনও এত টেনশন হয়, এটা সত্যি অবাক করার মতোই। দীপঙ্করদাও বলেছেন দিব্যি ভালো অভিনয় করার পরেও তোমার সেই দৃশ্য পছন্দ হয় না
মমতা শঙ্কর: আমি ভীষণ খুঁতখুঁতে। আমার এক একটা দৃশ্য বারবার টেক করতে হয়। সেটা আমারই অনুরোধে। সবাই বলে খুব ভালো হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয় কিচ্ছু হয়নি। অবশ্য এই চরিত্রটা করে আমি অভিজিৎকে ধন্যবাদ দিয়েছি। ও জোর না করলে এই কাজটা আমার করাই হতো না। অভিনয় করতে গিয়ে চরিত্রটাকে ভালো লেগেছে। কিন্তু যে ক’দিন কাজ করেছি আমি সত্যি চরিত্রটা থেকে বেরোতে পারতাম না। বাড়ি এসেও ওই চরিত্রের ভেতরেই যেন থেকে যেতাম।
‘বিজয়ার পরে’ গল্পটা কীরকম?
মমতা শঙ্কর: এই ছবিতে আমি আর টিটোদা স্বামী-স্ত্রী। স্বস্তিকা আমার মেয়ে। আরও দুই ছেলে আছে, তাদের পরিবার আছে। সকলেই বাড়ির বাইরে থাকে। কেউ কাছে, কেউ বা দূরে। আমি সবাইকে ডেকেছি পুজোর সময়। পুজো কেটে যাওয়ার পর এক-এক করে এই পরিবারের নানা ঘটনা সামনে আসতে থাকে। আর আমার চরিত্র সারাক্ষণ নিজের সঙ্গে লড়ছে। এটা করা ভীষণ কঠিন ছিল। খুব মানসিক চাপ ছিল আমার ওপর গোটা কাজটার সময়। কারণ আমি তো ঠিক সাজিয়ে অভিনয় করি না। আমি যেমন আমি সেভাবেই একটা চরিত্র হয়ে উঠি। অনেকেই বলে আমার অভিনয়টা কখনওই অভিনয় বলে মনে হয় না। কারণ সত্যি আমি ওইভাবে কিছু করি না। আমার ভেতরে আমি চরিত্রটা গড়ে তুলি, তারপর নিজের মতো করেই সংলাপ বলি। যেটা লেখা থাকে সেটাই বলব, এটা আমার দ্বারা হয় না। মানেটা একই থাকে কিন্তু আমি নিজের মতো করে বলি।
আরও পড়ুন: ডেভিড হেয়ারের জীবনী প্রকাশ
তারপর সেটা তোমার একবারে পছন্দ হয় না
মমতা শঙ্কর: না। কারণ কাজটা ভালো না হলে কী করে ছেড়ে দেব! আগে তো র স্টকে শ্যুটিং হতো। তখন একটু খারাপ লাগত। কারণ তখন বারবার টেক করা মানে রিল নষ্ট। এখন সেটা নেই কিন্তু সময় তো যায়ই। কিন্তু যেই শট শেষ হয়ে এরা কাট বলে, আমার মুখটা ব্যাজার হয়ে যায়। মনে হয় কিচ্ছু হলো না। আমি বলি আর একটা শট দেব, ওরা বলে খুব ভালো হয়েছে। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এই প্রত্যেক শটের পরে আমার মুখের অবস্থা নিয়েই একটা ছবি করা যায়।
অভিনয়ের মতো নাচের জায়গাতেও কি তোমার একইরকম মনে হয়?
মমতা শঙ্কর: নাচের ক্ষেত্রে তো প্রতিদিন আরও ভালো করার সুযোগ থাকে। সেখানেও এক্সপ্রেশনের তারতম্য ঘটে অবশ্যই। কিন্তু সেখানে পরবর্তী শোয়ে আমি এটা শুধরে নিতে পারবো। সিনেমায় তো যা করলাম আজীবন সেটাই থেকে যাবে।
আরও পড়ুন: বেসিক গানেই ভরসা রাখছে স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস
তুমি বরাবরই খুব বেছে ছবি করো। এখন যে পরপর ছবি করছ তাতে তো তোমার নাচের শোয়ের ক্ষতি হচ্ছে
মমতা শঙ্কর: সেটা হচ্ছে ঠিকই। আসলে আমার কাছে নাচ আর অভিনয় আমার দুই ছেলের মতো। দুটোই আমি অসম্ভব ভালোবাসি। আবার যখনই যার কাছে থাকি মনে হয় ওকে অবহেলা করছি। কিন্তু কখনওই মনে হয় না কোনও একটা ছেড়ে দেব। আমি যা করছি তাতেই আমি খুব সন্তুষ্ট। আমার উচ্চাকাঙ্খা নেই কোনওদিনই। আমি সত্য সাইবাবার ভক্ত। তাই সবটা ওঁর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি।
স্বস্তিকার সঙ্গে এই ছবিতে অভিনয় করে কেমন লাগল?
মমতা শঙ্কর: ও তো আমার মেয়ের মতো। ও যখন সবে হাঁটতে শিখেছে সেই সময় থেকে আমি ওকে দেখছি। ওর জন্মের আগে থেকে আমি সন্তুদার (মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে কাজ করছি। একটানা ন’বছর আমরা ‘জন্মভূমি’ করেছি। ওদের বাড়ি গিয়ে আমি চা খাচ্ছি, আর স্বস্তিকা আমার চায়ে ডুবিয়ে-ডুবিয়ে বিস্কুট খাচ্ছে। এসব ওর কোন ছোট্টবেলার কথা। কাজেই স্বস্তিকাকে আমার মেয়েই বলা যায়। ওর সঙ্গে এই নিয়ে আমার চারটে ছবি হয়ে গেল। ‘জাতিস্মর’, ‘শাহজাহান রিজেন্সি’, ‘শিবপুর’ আর এই ছবিটা।
আরও পড়ুন: অন্তত পাঁচ বছর থিয়েটার করার পরামর্শ মনোজের
‘আবহমান’-এর পর আবার দীপঙ্করদার বিপরীতে কাজ করলে। কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
মমতা শঙ্কর: ‘আবহমান’ ছাড়াও আমরা ‘অপূর্ণ’ নামের একটা টেলিফিল্ম করেছিলাম দেবকুমার বসুর পরিচালনায়। উনি দেবকী বসুর ছেলে। ওটাতেও ভীষণ ভালো কাজ হয়েছিল। আসলে টিটোদার সঙ্গে, মিঠুনের (চক্রবর্তী) সঙ্গে, অঞ্জনের (দত্ত) সঙ্গে আমার একটা আলাদা বোঝাপড়া আছে। এটা সন্তুদার সঙ্গেও ছিল। এরা জানে আমি কীভাবে কী করতে পারি, ফলে সেইভাবেই উত্তর আসে। এটা সৌমিত্রদার সঙ্গে অতটা ছিল না। কারণ উনি অনেকটা সিনিয়র ছিলেন। আবার পরানদার সঙ্গেও হয় না, কারণ উনিও অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ। তবে সৌমিত্রদা খুব ফ্লেক্সিবল ছিলেন। আর পরানদা বিশেষ রিহার্সল পছন্দ করেন না। আর আমি বারবার রিহার্সলে বিশ্বাসী। যাঁরা আমার সঙ্গে অভিনয় করতে অভ্যস্ত তাঁরা জানে আমি কীভাবে কাজটা করব। ‘পালান’-এর সময় যেমন সাংঘাতিক ইমপ্রোভাইজ়েশন হয়েছে। আমিও করেছি, অঞ্জনও করেছে। আমরা কেউ বাঁধা সংলাপ বলি না। অঞ্জনও জানে আমি কী করব আবার আমি জানি ও কী করতে পারে। এগুলো আসলে ভীষণ মজার ব্যাপার। পুরনো চেনা অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করলে এই মজাগুলো পাওয়া যায়।
ছবি: প্রতিবেদক