‘তাহারি সঙ্গে তোমারি বক্ষে বাঁধা রব চিরদিন’

ছবি: X=প্রেম

পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, শ্রুতি দাস, অর্জুন চক্রবর্তী, মধুরিমা বসাক

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

রূপকথা মানেই কি শুধু রাজারানির গল্প? সুয়োরানি-দুয়োরানির ঘরোয়া কূটকাচালি পেরিয়ে, ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্র এসে সোনার কাঠি বা রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙালেই কি তাকে রূপকথা বলা যায়? নাকি কঠিন বাস্তব থেকে দূরে সরিয়ে যে কাহিনী শুধু ভালোবাসার, ভালোলাগার, সহমর্মিতা বা ভরসার গল্প শোনায়, সেটাই রূপকথা? তাছাড়া রূপকথা মানেই রঙিন হতে হবে, এমন কোনও মানে নেই। সেটাই বোঝাল ‘X=প্রেম’ ।



খিলাত ও জয়ী। এক সাংঘাতিক পথ দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত লেগে খিলাতের স্মৃতি লোপ পায়। ডাক্তারেরর পাশাপাশি খিলাতের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে জয়ীও। সে খিলাতের কলেজবান্ধবী, এক সময়ের সিনিয়র। পরে দুজনে গভীর প্রেমে বাঁধা পড়ে। সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী খিলাতের স্পর্ধা অচিরেই জয়ীর হৃদয় জয় করে নেয়। তারপর একে-একে সিগারেট, গাঁজা, মদের সঙ্গে হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তারুণ্যের সবরকম দুঃসাহসিকতায় নিজেদের নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দে তারা মেতে ওঠে। আংটি বদল করে বিয়ের অঙ্গীকার করার পর বেড়াতে গিয়ে আচমকা দুর্ঘটনা বদলে দেয় দুজনের জীবন।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

এই সমস্ত ঘটনা গল্পের মতো শুনিয়েও খিলাতের দৃষ্টিতে কোনও পরিবর্তন দেখতে পায় না জয়ী। তাদের একসঙ্গে কাটানো সব স্মৃতি খিলাতের মাথা থেকে একেবারে কর্পূরের মতো উবে গেছে। এই সময় ডাক্তার প্রস্তাব দেন স্মৃতি প্রতিস্থাপনের। ‘Eternal Sunshine of the Spotless Mind’ ছবির কথা তুলে তিনি বলেন, এমন কোনও মস্তিষ্ক যার ভেতর খিলাতের প্রয়োজনীয় স্মৃতি (কাজের জায়গা বা ব্যক্তিগত জীবন) রয়েছে সেই ব্যক্তি যদি তার স্মৃতি দান করতে চান, যেহেতু সেই ব্যক্তির আর তা কাজে লাগছে না, তাহলে ডাক্তার এই স্মৃতি প্রতিস্থাপনের কাজটা পরীক্ষামূলকভাবে করে দেখতে পারেন।

নিরুপায় খিলাত ও জয়ী রাজি হয়ে যায়। কিন্তু কাজের স্মৃতি পাওয়া গেলেও জয়ীকে ভালোবাসার স্মৃতি কোথায় পাওয়া যাবে? জয়ী তো খিলাতকে ছাড়া তেমন কাউকেই চেনে না যে তাকে ভালোবাসতো। শুরু হয় খোঁজ। তারপরের গল্পটা কিন্তু চেনা অঙ্ক মিলে যাওয়ার মতো সরল নয়। গল্পের মোড়ে-মোড়ে রয়েছে চমক, আছে পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা, কিছু কষ্ট ও না বলা সাদাকালো ভালোবাসা। 

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

এমন একটা ঝকঝকে ভালোবাসার ছবির অপেক্ষা থাকে সবসময়ই। কারণ জীবনের জটিল থেকে জটিলতর নানা অলিগলি ঘুরে আবারও সেই ভালোবাসার গল্পের বড় রাস্তায় এসে বাঁক নিতেই হয় গল্পের চরিত্রদের। এ এক অজানা দুনিয়ার গল্প যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেকটাই উন্নত, যেখানে জীবন কিছুটা স্বপ্নের মতো, যেখানে দৈনন্দিন রোজনামচা ভালোবাসাকে কলুষিত করে না। প্রেম মূলত দু’রকমের, এক সোচ্চার ও দুই নিরুচ্চার। এই দুই বিপরীতধর্মী মানসিক অবস্থানে থেকেও খিলাত, জয়ী, অর্ণব ও অদিতির মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়। ‘তোমার স্মৃতি তোমার কপিরাইট’, অর্ণবের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে কোথাও যেন শ্যামাকে বলা উত্তীয়র কথাই শোনা যায়, ‘প্রিয় যে তোমার বাঁচাবে যারে নেবে মোর প্রাণঋণ/তাহারি সঙ্গে তোমারি বক্ষে বাঁধা রব চিরদিন’। তবু এ উত্তীয় নিজের পরিস্থিতির হাতে অসহায়। সেও তো প্রতিনিয়ত লড়াই করে যায় সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের আশায়। অদিতির মুখ চেয়ে, নিজের মুখ চেয়েও।

অনেকদিন আগে এক অর্ণব ও জয়ীর বন্ধুত্বের গল্প ভাসিয়ে দিয়েছিল নব্বইয়ের শেষভাগের কলেজপড়ুয়াদের। সেই অর্ণব আর জয়ীকে তাঁর গল্পে আবারও ফিরিয়ে এনে সম্ভবত অঞ্জন দত্তকে গুরুদক্ষিণা দিলেন সৃজিত। কিংবা নিজের কলেজ জীবনের নস্টালজিয়াকে ঝালিয়ে নিলেন কিছু প্রায় নতুন মুখের অভিনেতাদের হাত ধরে। মৌন ভালোবাসা কতটা গভীর আর নিঃস্বার্থ হতে পারে তার প্রমাণ হয়ে রইল নতুন প্রজন্মের এই ছবি। হয়ে রইল উত্তাল ভালোবাসা উদযাপনের গল্পও।

আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি

তবে রূপকথা হলেও এ ছবি প্রাপ্তমনস্কের। তাই মিষ্টি প্রেমের গল্পের প্রত্যাশা না রাখাই ভালো। এমনই হওয়া উচিত জেনারেশন Y-এর ভালোবাসার ভাষা। নতুন প্রজন্ম মানেই আবেগহীন যান্ত্রিকতা নয়। তারা যদি বাড়ির ছাদে বসে গাঁজা টানতে পারে তবে ধুতি পরে ট্যাঙ্গো নাচতেও পারে। ভরসা রাখতে জানলে তারাই দেখিয়ে দিতে পারে ‘ভালোবাসা কারে কয়?’

মূল চরিত্রে চার অভিনেতাই যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যভাবে চরিত্রের দাবি পূরণ করেছেন। তবু অনিন্দ্য যেন একটু বেশি উজ্জ্বল। বড়পর্দায় প্রথম প্রকাশ বলে খিলাতের আত্মবিশ্বাসে কোথাও চিড় ধরতে দেখা যায়নি। ছবিতে আগাগোড়া ঝকঝকে লেগেছে শ্রুতিকে, নতুন ধারার ছবিতে মানানসই হয়ে উঠবেন তিনি আশা করা যায়। অদিতি চরিত্রের তীব্র ব্যথা মধুরিমার শরীরী ভাষায় উঠে এসেছে খুব স্পষ্টভাবে। আর অর্জুনকে নিয়ে নতুন কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ কিছু না করেও অনেকটা করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন তিনি। এখানেও সেভাবেই নৈঃশব্দ্য দিয়ে জিতে নিলেন অনেকখানি।

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

তবু এই ভবিষ্যতের গল্পে চিকিৎসার খুঁটিনাটি যদি আর একটু বিশদে দেখানো যেত তাহলে গল্পের আবেগপ্রবণ অংশের সঙ্গে যুক্তির অংশটাও হয়তো জোরালো হতো। এত সহজে ব্রেনের একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান প্রদান হয়ে যেতে পারে, এটা একটু অবাক করে। তবু বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের গল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে এটা বেশ আশার কথা।

শুভঙ্কর ভড়ের চিত্রগ্রহণ এ ছবির অন্যতম মেরুদন্ড। সাদাকালো রঙে তিনি পর্দায় কবিতা রচনা করেছেন বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। ইদানীংকালে পরপর কয়েকটি ছবি সাদাকালোয় হওয়ার কারণ ছিল পুরোনো দিনের গল্প। কিন্তু ভবিষ্যতের রঙিন ভালোবাসার গল্পে সাদাকালো এক অন্য গভীরতার ছাপ রেখে গেল।

আরও পড়ুন: রক্তবরণ মুগ্ধকরণ

সাদাকালো রঙ যদি ‘X=প্রেম’-এর মেরুদন্ড হয় তবে গান অবশ্যই এ ছবির মস্তিষ্ক। সপ্তক সানাই দাসের সুরে গানগুলো যেন ছবিকে চালনা করে নিয়ে যায়। ‘ভালোবাসার মরসুম’, ‘বায়না বিলাসী’, ‘সিন্ডারেলা মন’, প্রতিটি গানই ভারী শ্রুতিমধুর। তার রেশ রয়ে যায় বহুক্ষণ। সৃজিতের ছবিতে গান আগেও গুরুত্ব পেয়েছে। মাঝে কিছুদিন থ্রিলার ঢেউয়ে সেই প্রবাহে ভাটার টান পড়লেও আবার বেশ কিছু ভালো এবং গুনগুন করার মতো বাংলা গান এই ছবিতে পাওয়া গেল। 

তবে থ্রিলারের সুর কি এই ছবিতেও নেই? আছে। প্রশ্ন রেখে যায় ছবির শেষটুকু। যে পদ্ধতি খিলাতের মূল স্রোতে ফিরে আসতে কাজে লাগল না, তা কি সত্যিই অর্ণবের কাজে লেগেছিল? নাকি ভালোবেসে ভালোবাসাকেই উৎসর্গ করে গেল সে? 

প্রশ্ন যেমনই হোক, কয়েক চামচ বিজ্ঞান ও থ্রিলারের দ্রবণ এ ছবির প্রেমের ছন্দকে কাটতে পারেনি কোথাও। প্রেম স্বমহিমায় রয়ে গেছে ছবির শুরু থেকে শেষে। আসলে ভালোবাসায় সব হয়, জীবনের ওটাই একমাত্র ফর্মুলা। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *