সার্থক চেম্বার ড্রামা
ছবি: এই রাত তোমার আমার
পরিচালনা: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে: অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শ্রুতি দাস, রোহিত চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆
‘তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ, ও মোর ভালবাসার ধন।’ পঞ্চাশ বছর একসঙ্গে, এক ছাদের তলায়, একে অপরের সমস্ত দৈনন্দিন ওঠাপড়ায় সঙ্গী হবার পর সত্যিই কি উল্টোদিকের মানুষটার প্রতি কোনও আকর্ষণ বেঁচে থাকে? অভ্যাস হয়তো থাকে, নিরাপত্তার বোধ থাকে, নিশ্চিন্ত আশ্রয় থাকে। কিন্তু নতুন কিছু জানার থাকে কি? আগ্রহ থাকে তার কথা শোনার?
‘এই রাত তোমার আমার’ (Ei Raat Tomar Amaar) এক দীর্ঘ দাম্পত্যের কাহিনি। অমর (অঞ্জন) ও জয়ীর (অপর্ণা) পাশাপাশি পঞ্চাশটা বছর কাটিয়ে দেওয়ার স্মৃতিচারণ, বা এমন এক রিওয়াইন্ড বাটন যা কতকগুলো অপ্রিয়, আবার কিছু স্মরণীয় মুহূর্তের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এক বৃদ্ধ দম্পতিকে। প্রায় সবদিক থেকেই সার্থক চেম্বার ড্রামা বলা চলে এই ছবিকে। শুরুতে কিছুটা বাইরের দৃশ্য থাকলেও তা খুবই কম। ছবির নব্বই শতাংশ ঘটনাই ঘটে দম্পতির চা বাগানের বাড়িতে।
আরও পড়ুন: হাফপ্যান্ট পরে অভিনয়, কিশোরের প্রস্তাবে সত্যজিতের অট্টহাসি
বছর পঞ্চাশ একসঙ্গে থাকার পরেও হয়তো একে অপরের কিছু কথা অজানা থেকে যায়। চাল, ডাল, ওষুধপথ্য, শরীর, স্বাস্থ্য, সামাজিকতার রোজনামচার আড়ালে হয়তো বা হারিয়ে যায় কত অদেখা মুহূর্ত। কিংবা মনের ভেতর কাঁটার মতো রয়ে যায় কোনও এক চেপে রাখা অভিমান। বলা হয় কি সেসব কোনওদিন? বছরের পর বছর পাশাপাশি থেকেও সব কথা বলা হয়ে ওঠে কই! আমরা বলি না, এড়িয়ে যাই। ভাবি উল্টোদিকের মানুষটা ঠিক বুঝে নেবে। কিন্তু সব আশা তো মেটে না। হয়তো উল্টোদিকের মানুষটাও একই কথা ভাবছে। হয়তো বা ভুলের জায়গায় দাঁড়িয়ে সে আরও বেশি অসহায়। আবার হয়তো কখনও মনে হয় এসব বলে সময় নষ্ট করা হবে। আসলে দাঁত থাকতে তার মর্যাদা কজনই বা বোঝে!
এই ছবি কিছুটা যেন শিখিয়ে দিয়ে যায় সে কথাও। ফেলে রাখতে নেই, আমরা ভাবি বলব’খন। কিন্তু সেই ক্ষণটুকু আসতে এক জীবন পেরিয়ে যায়, বলা আর হয় না। সত্যি কথা বলতে সমস্ত দীর্ঘ দাম্পত্যেই কিছু ঘন অন্ধকারের কোণ পড়ে থাকে। কোনও জীবনভর সম্পর্কই সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে পারে না। কারণ প্রতিটা মানুষ একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। কার মনে কখন কোন বীণার তার বেজে উঠবে এক্কেবারে পাশটিতে থেকেও কেউ বুঝতে পারবে না। ভাগ্যিস, মনের ভেতরটা আমরা দেখতে পাই না। দেখতে পেলে কি এত বছর ধরে সম্পর্কগুলো টিকে যেত? প্রতিদিনের একই সকাল, দুপুর, বিকেল, রাত, একই মানুষকে দেখতে-দেখতে জানতে-জানতে অভ্যাসের সঙ্গে একঘেয়েমিও তো গড়ে ওঠে। আমরা আসলে সযত্নে এড়িয়ে যাই এসব প্রসঙ্গ। নিজেকেই আড়াল করি নিজের থেকে। সতীত্বের অভিনয় কিছুটা হলেও প্রতিটা মানুষ করে থাকে। কিন্তু তারপর? নেহাত অসহ্য না হলে, পালিয়ে যেতে না হলে কোথাও গিয়ে এটাও মানুষ বুঝে যায় এই বন্ধন ছিঁড়ে পালাবার পথ নেই। যত যাই করি, ক্লান্ত হয়ে ফিরতে হবে সেই নিজের ঘরেই। কারণ? কারণ অভ্যেস তো বটেই, আবার সেই অভ্যেসের প্রতি টানও বটে। আসলে সেটাই ভালোবাসা। শুধুমাত্র বিরক্তি আর একঘেয়েমি দুটো মানুষকে দিনের পর দিন টেনে রাখতে পারে না। ওই না বলা ভালোবাসাটুকুও থেকে যায় মনের কোনও এক কোণে। সে ভালোবাসা শরীরী নাও হতে পারে। হয়তো বা নিছক স্নেহ, প্রশ্রয় কিংবা হয়তো নিজের ভালো থাকার লোভও।
এ ছবিতে অভিনয়ের প্রসঙ্গ তোলা অবান্তর। মূল দুটি চরিত্রে অভিনয়ের দুই মহীরুহ থাকলে দুজনের বোঝাপড়া কোন স্তরে উঠতে পারে তার এক রুলবুক হয়ে থাকতে পারে এই ছবি। তবে শুধুমাত্র অভিব্যক্তি নয়, বরং সমস্ত শরীর দিয়েই চরিত্রে প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন অঞ্জন ও অপর্ণা। বয়স্ক দম্পতির একান্ত মুহূর্তে একে অন্যের প্রতি নির্ভরতা, শাসন, সমর্পণ সমস্ত কিছুই এত স্বাভাবিকভাবে ছবিতে উঠে এসেছে যাকে অতুলনীয় বললে কিছুই বলা হয় না। সঙ্গে রয়েছে ছোট্ট একটি মনুষ্যেতর প্রাণীর উপস্থিতিও, যার ভেতর দিয়ে রূপকের মাধ্যমে ফুটে ওঠে স্নেহ ভালোবাসার আর একরকমের রূপ।
আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ
ছবির ট্রেলার মুক্তির সময় অপর্ণা বলেছিলেন, একজন বাণিজ্যিক ছবির নায়িকার পক্ষে মারাত্মক অসুস্থ কোনও চরিত্র যেখানে তাকে দেখতে ভালো লাগবে না, সেটা মেনে নেওয়া বেশ কঠিন। অথচ ছবির অধিকাংশ অংশেই তিনি এত সুন্দরভাবে নিজেকে তুলে ধরেছেন যে মুগ্ধতা কাটতে চায় না। এমনকী বিছানায় শুয়ে থাকা খুব সাধারণ পোশাকেও তিনি অনন্যা। এই বয়সে এসেও এমন ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য ধরে রাখা, তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। অঞ্জন প্রত্যাশামতোই শরীরী ভাষায় তারুণ্য বজায় রেখেছেন, যেমনটায় তাঁকে দেখতে দর্শক অভ্যস্ত। হয়তো মনে হতে পারে এই দুই মহারথী থাকতে পরিচালকের কাজ আর কতটুকু থাকে! কিন্তু সেটাই সবচেয়ে কঠিন, দুই বটবৃক্ষকে পাশাপাশি এনে হাত ধরিয়ে দেওয়ার কাজটা বড় সহজ নয়। সে কাজে পরমব্রত চূড়ান্ত সফল।
ছবিতে আলোর ব্যবহার চরিত্রের মানসিক অবস্থার ওঠানামাকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। আবহ এবং বেছে নেওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত সমস্তই অরুণ ও জয়ীর ভালোবাসাকে আরও বেশি করে মূর্ত করে তুলতে সাহায্য করে। আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিয়ে যায়, ‘তুমি যে আমারে চাও আমি সে জানি, কেন যে মোরে কাঁদাও আমি সে জানি।’