সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

বাড়ি ফিরেছেন হরিহর। কাজের খোঁজে দরিদ্র ব্রাহ্মণ বহুদিন ঘরছাড়া। তাই ফিরেই প্রথমে ছেলেমেয়ের খোঁজ করলেন তিনি। কাছেই ছিলেন স্ত্রী সর্বজয়া। এগিয়ে দিলেন পা ধোয়ার জল, বসার পিঁড়ি। তবে হরিহরের সে সবে কোনও আগ্রহ নেই। অ্যাদ্দিন ঘোরাঘুরি করে রাণাঘাটে এসে তার কপাল ফিরেছে। তাই চড়কের মেলা থেকে কেনা কাঁঠাল কাঠের বেলনচাকি, কাচ দিয়ে বাঁধানো লক্ষ্মীর পট দেখাতে ব্যস্ত তিনি। সর্বজয়া যেন দেখেও দেখলেন না। তারপর হরিহর মেয়ে দুর্গার জন্য আনা শাড়িটা এগিয়ে দিতেই সেটা বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সর্বজয়া।

কিন্তু শব্দ? শব্দ কই? মেয়ের মৃত্যুতে মা কাঁদছেন, তার কোনও শব্দ থাকবে না? না, সব কান্নার শব্দ হয় না। রবিশঙ্করের নির্বাচনে পটদীপ রাগে, বিশিষ্ট দিলরুবা বাদক দক্ষিণামোহন ঠাকুরের জাদুতে বেজে উঠল তারসানাই। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ছবির এই দৃশ্য ভেঙে দিয়েছিল সমস্ত প্রচলিত ফর্মুলা। সেলুলয়েডে মূর্ত হয়ে উঠল নির্বাক সর্বজয়ার শোক, মুক্তির ৬৫ বছর পর যে দৃশ্য আজও নাড়িয়ে দেয় একাধাকিবার এই ছবি দেখা দর্শককেও।  

মাত্র ১২ বছর বয়সে দাদা উদয়শংকরের দলে বাজিয়ে হিসেবে আত্মপ্রকাশ। তারপর প্রায় আশি বছর ধরে পৃথিবীজুড়ে সুধাবর্ষণ করেছেন রবীন্দ্রশংকর চৌধুরী, পণ্ডিত রবিশংকর নামে যিনি গোটা বিশ্বে পরিচিত। আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে বারাণসীর এক বাঙালি পরিবারে তাঁর জন্ম। দশ বছর বয়সে দাদা উদয়শংকরের নাচের দলে যোগদান করেন। দলে থাকাকালীনই ১৩ বছর বয়সে প্রথম বিদেশযাত্রা, প্যারিসে। এইসময়েই পশ্চিমী ধ্রুপদী ও জ্যাজ় সঙ্গীতের সংস্পর্শে আসেন রবিশংকর।

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

দেশে ফেরার পর ১৯৩৭ সালে কিশোর রবিশংকর মাইহার ঘরাণার সঙ্গীতগুরু আলাউদ্দিন খাঁ-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিনের কঠোর অনুশাসনে রবিশংকর অধ্যয়ন করেলন ভারতীয় রাগসঙ্গীত, শিখলেন সেতার ও সুরবাহার, পরিচিত হলেন ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল ও সঙ্গীতের বিভিন্ন অঙ্গসমূহের সঙ্গে। শিখলেন রুদ্রবীণা, রবাব, সুরশৃঙ্গারের মতো প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রও। এর প্রায় দু’বছর পর আলাউদ্দিনের পুত্র, গুরুভাই আলি আকবর খানের সরোদের সঙ্গে দ্বৈতবাদনে রবিশংকরের সেতার প্রথম শুনল বিশ্ব।

কেমন ছিলেন মানুষ রবিশংকর?

দেশে ও বিদেশে একাধিক কনসার্টে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন বিশিষ্ট তবলাবাদক কুমার বোস। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সঙ্গীতের পাশাপাশি সমসাময়িক বিজ্ঞান, খেলাধূলা সব বিষয়েই ওঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। বিভিন্ন বিষয়ের রবিশংকরের আগ্রহ প্রকাশ পেত তাঁর কাজের মধ্যেও। এটাই তাঁর সঙ্গীতকে একটা ভিন্ন মাত্রা এনে দিত। যে কোনও বিষয়েই উনি আন্তর্জাতিক স্তরে ভাবনাচিন্তা করতেন। এই জন্যেই তিনি রবিশংকর, এই জন্যই তিনি অনন্য।

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

ভাইঝি মমতাশংকরের কাছে তাঁরা কাকা ছিলেন এক দারুণ মজার মানুষ। তিনি হাসতে এবং হাসাতে ভালোবাসতেন। অমলাশংকরকে একবার একটা চিঠি লিখেছিলেন রবিশংকর। শেষে লিখেছিলেন ইতি-রবু। তার নীচে এঁকে দিয়েছিলেন সূর্য, জোকার আর একটা হাতের ছবি। পাশে লিখেছিলেন সূর্য=রবি, জোকার=সং, হাত=কর।

বিনা পারিশ্রমিকে যে সুরের সাধনা করা যায় না, সেটাও উঠতি শিল্পীদের বুঝিয়ে দিতেন তিনি। প্রথমবার পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর গান শোনার পর দুই হাজার টাকা দিয়ে রবিশংকর তাঁর থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন যে এর চেয়ে কম সাম্মানিকে তিনি কখনও গাইবেন না।

‘পথের পাঁচালী’র মাঝ খামাজ আজও বুকের মাঝে ঢেউ তোলে জ়াকির হুসেনের স্মৃতিচারণে। অ্যালবার্ট হলে একবার মল্লার বাজিয়েছিলেন রবিশংকর। অনুষ্ঠানের শেষে এক শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, উনি যখন স্লো টেম্পো (আলাপ) বাজাচ্ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল প্রেক্ষাগৃহে মেঘ ডাকছে, আর যখন ফাস্ট টেম্পো (ঝালা) বাজাচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল বৃষ্টি ঝড়ে পড়ছে চারদিকে।

আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে

এমনই এক স্মৃতিকথায় পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ বলেছিলেন, তখন কলকাতায় এলে রবিশংকর গুরুজীর (জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ) বাড়ির দোতলায় থাকতেন। দুজনে খুব বন্ধু ছিলেন। উনি এলেই বলতেন, আয়, একটু লড়ালড়ি করি (রেওয়াজে বসি)। ওনার সঙ্গে রেওয়াজ করতে করতেই একদিন উনি শঙ্করকে একটা অনুষ্ঠানে বাজাতে বলেন। সেবার বাজনা খুব ভালো হয়েছিল। এর ক’দিন পর ওনার জন্মদিন ছিল, তখন তিনি লালা শ্রীধরের বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই  ছোট করে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের পর তিনি শঙ্কর ঘোষকে তাঁর সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তখন ওঁর সঙ্গে বাজাতেন ছোটুলালজি। তারপরে আল্লারাখা খান। ‌তবে আল্লারাখার আগেই রবিশংকরের সঙ্গে বিদেশে বাজান শঙ্কর।

ছোটখাট ঘটনাও যে তাঁর নজর এড়াতো না, তার আভাস পাওয়া যায় বিশিষ্ট পারকাশনিস্ট বিক্রম ঘোষের কথায়। দীর্ঘ ১৩ বছর রবিশংকরের সহশিল্পী ছিলেন তিনি। সাতশো না হাজার, কত কনসার্টে তাঁর সঙ্গত করেছেন ভুলে গেছেন বিক্রম। কতদিন ওনার বাড়িতে প্রাতরাশ করেছেন। হয়তো সকালে ওনার সঙ্গে রেওয়াজে বসেছেন, রবিশংকর জানতে চাইলেন চান হয়েছে কি না। হয়তো তখনও হয়নি। চান করে এলেন বিক্রম, তারপরে সারাদিন চলল রেওয়াজ।

সাধনার মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন রবিশংকর। বিশ্বাস করতেন, অভ্যাসের দুটো স্তর: রেওয়াজ আর তপস্যা। তাঁর সমগ্র জীবনটাই ছিল তপস্যার বাস্তব প্রতিফলন।

গ্র্যামি, ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ সহ অজস্র সম্মানে ভূষিত এই সঙ্গীতসাধক ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রেখে যান অজস্র গুণমুগ্ধ সঙ্গীতপিপাসু ভক্ত, শোকাকুল ছাত্রমণ্ডলী এবং তিনটি অমূল্য গ্রন্থ: ‘মাই মিউজ়িক, মাই লাইফ’, ‘লার্নিং ইন্ডিয়ান মিউজ়িক: এ সিস্টেম্যাটিক অ্যাপ্রোচ’ এবং তাঁর আত্মজীবনী ‘রাগমালা’।

ছবি: সাউথব্যাঙ্ক সেন্টার

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Subhadip

Student of mathematics, writer and a Hindustani classical vocalist. Mad about food, nightowl, rhyming poetry enthusiast, and a lover of football. 'Tech freak is probably what best describes him. A perfectionist about language and grammar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *