যে বাস্তব থেকে যায় বন্ধ দরজার আড়ালেই
সিরিজ়: সম্পূর্ণা
পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল
অভিনয়ে: সোহিনী সরকার, রাজনন্দিনী পাল, প্রান্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুভব কাঞ্জিলাল, লাবণী সরকার, রজত গঙ্গোপাধ্যায়, অরিজিতা মুখোপাধ্যায়, পারমিতা মুখোপাধ্যায়
সময়: ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিট (৬ পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
স্যানালবাড়ির ছোটছেলে রক্তিম অর্থাৎ রুকুর (অনুভব) বিয়ে। বাড়ির বড়বউ সম্পূর্ণা (সোহিনী) একা হাতেই সামলাচ্ছে বিয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি। সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত নন্দিনীর (রাজনন্দিনী) বাড়িতেও চলছে বিয়ের তোড়জোড়। আপাতদৃষ্টিতে দুটি পরিবার সুখী। হঠাৎ করেই রুকুর মা তার ছেলের সঙ্গে নন্দিনীর বিয়েতে অমত প্রকাশ করেন, কারণ পাত্র-পাত্রীর জোটক বিচার করে জানা যায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে ভবিষ্যতে রক্তিমকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এদিকে প্রথম দেখাতেই বাড়ির সকলের পছন্দ করা মেয়ে নন্দিনীকে রুকুর মনে ধরে। রুকু জানিয়ে দেয় নন্দিনীকে ছাড়া আর কাউকেই সে বিয়ে করবে না। বৌদির হাতযশে রুকুর বিয়েটা উতরে যায়।
বিয়ের আগে দু’-একবার রক্তিমের সঙ্গে নন্দিনীর দেখা হয়েছিল বটে। তবে নন্দিনী একটু-একটু করে রক্তিমকে চিনতে শুরু করে মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে। বয়সে অপরিণত নন্দিনী দিদিভাইকে বলতে পারে না তার প্রথমরাতের অভিজ্ঞতার কথা। পুরুষ মানুষের ইচ্ছের জোর বেশি, এ কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস না করলেও, বিয়ের পর নন্দিনীর উপর রুকুর প্রথমরাতের অধিকারবোধ নিয়ে তলিয়ে ভাবতে চায়নি সম্পূর্ণা।
মায়ের আদরের ছোটছেলে, পিকুর ভাই, বৌদির খুনসুটি করার একমাত্র সঙ্গী, নম্র, মেধাবী, বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত রক্তিম আর বেডরুমের ভিতরে নন্দিনীর বর রুকু কতটা আলাদা মানুষ, তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। সম্ভ্রান্ত, বনেদি এবং পাড়ায় সকলের নেকনজরে থাকা সান্যাল পরিবারের গৃহকর্ত্রীর মতে তাঁর বাড়ির মানুষগুলোর ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বা স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আলোচনা করা তাদের রুচিবিরুদ্ধ। খবরের কাগজ খুলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া গার্হস্থ্য হিংসা, বৈবাহিক ধর্ষণের খবর পড়ে দামি শাড়ি কিংবা প্রসাধনী দিয়ে নিজের গায়ের কালশিটে ঢাকা দেওয়াই তাদের রেওয়াজ।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
সোনার আংটি বাঁকা হলেও যে তার দর কমে না, তা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেন রুকুর মা। অবসরপ্রাপ্ত বাবা, সংসারের জোয়াল টানতে-টানতে ক্লান্ত মাকেও পাশে পায় না নন্দিনী। প্রভাবশালী আইনজীবীর হাতযশে জেল থেকে ছাড়াও পেয়ে যায় রুকু কারণ হাসপাতালে শয্যাশায়ী নন্দিনীকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয় সেদিন রাতের ঘটনাটি সামান্য দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী নাবালিকা স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর বলপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা অপরাধ হলেও, বৈবাহিক সম্পর্কে স্ত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামীর শারীরিক সম্পর্ক আসলে কোনও অপরাধই নয়।
‘সম্পূর্ণা’ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের চেনা ছবি। অত্যন্ত সহজ, সাবলীলভাবে সমাজের এই কঠিন দিকটি তুলে ধরেছেন পরিচালক সায়ন্তন ঘোষাল। এ বাস্তব থেকে যায় বন্ধ দরজার আড়ালেই। থ্রিলারধর্মী ছবি হলেও সরলতাই এই ছবির ইউএসপি।
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান
সম্পূর্ণার চরিত্রে সোহিনীর অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। তুলনায় নতুন রাজনন্দিনী যেন না-কাটা হিরে। দুটি সত্তাকে নিজের মধ্যে প্রকটভাবে ফুটিয়ে তোলা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। রুকুর চরিত্রের সঙ্গে অনুভবের বাহ্যিক চেহারার মিল থাকায় তাঁকে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ মনে হয়েছে। মা-বাবার বাধ্য বড়ছেলের চরিত্রে প্রান্তিক উত্তেজনায় সংলাপ জড়িয়ে ফেললেও চরিত্র অনুযায়ী দেখতে ভালো লাগে। ছেলে অন্তপ্রাণ মায়ের চরিত্রে লাবণী ও ধৃতরাষ্ট্র বাবা রজত তাঁদের চরিত্রে যথাযথ। সমাজকর্মী স্নেহার চরিত্রে অরিজিতা দৃপ্ত। পায়ের মাটি শক্ত হলেই যে সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখানো যায় না, তা বুঝিয়ে দিলেন কঠিন ধাঁচের পুলিশ অফিসার পারমিতা।
প্রতিবাদস্বরূপ কাহিনীকার অনুজা চট্টোপাধ্যায় এবং সৌম্যব্রত রক্ষিত এই গল্পের মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক তুলে ধরেছেন। পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক এই সমাজ ছোট থেকেই মেয়েদের শেখায় মানিয়ে নিতে, মেনে নিতে, পুরুষ মানুষদের চাহিদার সামনে নিজেদের ইচ্ছেকে গলা টিপে খুন করতে। রক্তমাংসের মানুষ থেকে প্রতি রাতে স্বামীর বাঁধনছাড়া শারীরিক চাহিদা পূর্ণ করার যন্ত্রে পরিণত হতে শেখায় এই সমাজ। আবার সেই চাহিদা পূর্ণ করতে না পারলে এই সমাজের দলদাসরাই একে অপরের বিরুদ্ধে কানাকানি করে। লোকের বাড়িতে খেটে খাওয়া, ফুটপাথে চা বিক্রি করা সহজ সরল ছায়াদি, লক্ষ্মী কাকিমাদের কাছে বৈবাহিক ধর্ষণ এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ভারতীয় দণ্ডবিধির ‘৪৯৮এ’ সত্যিই বিলাসিতা।
অনুজার চিত্রনাট্যে কিছু-কিছু গরমিল থাকলেও প্রতিটি সংলাপ মনে করিয়ে দেয়, সোশ্যাল স্টেটাসে ভেদাভেদ থাকলেও সমাজের সকল স্তরের মেয়েদের অবস্থা, শরীরে ক্ষতচিহ্নগুলো কিন্তু এক।
অমিত-ঈশানের তৈরি আবহ ভালো এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ব্যবহারও যথাযথ। সম্পাদনার ক্ষেত্রে কিছু দৃশ্যে কাটছাঁট করতে পারতেন শুভজিৎ সিংহ। রুকুর আগের অফিসে তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে কানাঘুষো বা চায়ের দোকানে পুলিশের সামনেই স্ত্রীর উপর স্বামীর অত্যচারের দৃশ্যগুলি একটু নাটকীয় মনে হয়।
এই গল্প যতটা নন্দিনীর, ততটা পৃথার, ততটাই প্রতি রাতে স্বামীর সোহাগে জর্জরিত, নির্যাতিত প্রতিটি মেয়ের। আবার সেই অর্থে নির্যাতিতা না হয়েও নন্দিনীদের প্রতিবাদ করতে শেখানোর অপরাধে নিজের স্বামী, পরিবার ছেড়ে আসতে পিছপা না হওয়া সম্পূর্ণাদেরও। বিয়ে দুটো মানুষের একসঙ্গে থাকার আইনি স্বীকৃতি হলেও স্ত্রীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করার অধিকার আইন দেয় না। কোনও স্ত্রী তাঁর স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সমাজকে সাক্ষী রেখে স্বামী নামক প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্রিতদাসীরূপে বিক্রি হয়ে যাওয়ার নাম বিয়ে নয়। বিয়ে মানে ধর্ষণকে আলিঙ্গন করা নয়। আইনের চোখে সবকিছু বৈধ এই ধারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পদক্ষেপ ‘সম্পূর্ণা’।