শেষ না করে ওঠা যায় না

সিরিজ়: শব্দজব্দ (সিজ়ন ১)

পরিচালনা: সৌরভ চক্রবর্তী

অভিনয়ে: রজত কাপুর, পায়েল সরকার, মুমতাজ সরকার, সুব্রত দত্ত, কঙ্কনা চক্রবর্তী, সলোনি পান্ডে, কৌশিক রায়

দৈর্ঘ্য: ৩ ঘন্টা ৬ মিনিট (৭ পর্বে)

RBN রেটিং: ৪/৫

ধরুন কাল রাতে এক অচেনা ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন একজনের সঙ্গে দেখা করতে। আজ সকালে খুঁজে-খুঁজে সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে যদি জানতে পারেন সেখানে কেউ থাকে না, বরং সেই ফ্ল্যাটটা আপনারই বহুদিন আগের কেনা, আর আপনি সেটা ভুলে গেছেন তাহলে কেমন হবে? কিংবা তিরিশ বছর আগে যার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হতো—যার নামটাই হয়ত আর মনে নেই—সে যদি হঠাৎ সামনে এসে বলে, আপনার জন্যই তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে, কেমন লাগবে আপনার? প্রথমেই মনে হবে, আমি কি পুরোনো কথা ভুলে যাচ্ছি? তারপর মনের অবস্থা যা হবে তাকে এককথায় বলে ‘আতঙ্ক’! এই আতঙ্কই সারাক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সৌরভের ওয়েব সিরিজ় ‘শব্দজব্দ’তে। 




লস এঞ্জেলেসে বসবাসকারী লেখক সৌগত সিনহা (রজত) ইংরেজিতে উপন্যাস লেখেন। তার গল্পের প্রেক্ষাপট ভারতীয়। প্রথমদিকে সেভাবে সফল না হলেও তার সাম্প্রতিক উপন্যাস বেস্টসেলার হওয়ায় পরবর্তী কাহিনীটি লেখার আগেই ভারতের এক বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা অনেক বেশি মূল্যে তা কিনে নেয়। সেই সূত্রে সৌগত কলকাতায় আসে স্ত্রী অদিতি (পায়েল) ও মেয়ে রাকাকে (সলোনি) সঙ্গে নিয়ে। অদিতি প্রতিবছর একবার কলকাতায় এলেও সৌগত শহরে এল প্রায় কুড়ি বছর পরে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ডাক্তার বন্ধু অমিতাভর (সুব্রত) সঙ্গে গাড়ি করে বাড়ি যাওয়ার পথে আচমকা উইন্ডস্ক্রিনে অচেনা একটি মেয়ের মুখ এসে আছড়ে পড়ে। আতঙ্কিত সৌগত ভাবেন তিনি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। অমিতাভও জানায় সে কিছু দেখেনি। হতবাক ও বিভ্রান্ত সৌগত মন থেকে এই ঘটনা সরিয়ে দেয়।

পরদিন সকলে মিলে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে বার কাউন্টারে সেই মেয়েটির সঙ্গে আবার মুখোমুখি হয়ে যায় সৌগতর। চমকে উঠে কিছু বোঝার আগেই অদৃশ্য হয়ে যায় মেয়েটি (মুমতাজ)। আবার পরদিন তার বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ অনুষ্ঠানেও হাজির হয় সেই মেয়েটি। যেন কতকালের চেনা এমন অভিযোগে সে প্রশ্ন করে, সুলগ্নাকে কীভাবে ভুলে গেল সৌগত?

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

বেস্টসেলার লেখক যেন এক ধাঁধার অনুসন্ধান করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কে এই সুলগ্না? কী তার পরিচয়? কানাইয়ের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল? সুলগ্না কী মারা গেছে? নিজের মনের ভেতর থেকে উঠে আসা একাধিক জটিল প্রশ্নে জেরবার সৌগত অমিতাভর কাছে চিকিৎসার জন্য যায়। অমিতাভ তাকে আশ্বাস দেয় সামান্য ভুলে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনও সমস্যা নেই। সৌগত আগে থেকেই অ্যালঝ়াইমার্সের রোগী, তাই এ জিনিস অসম্ভব নয়।

অদ্ভুত এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে পাহাড়ে বেড়াতে যায় সকলে মিলে। কিন্তু সেখানে গিয়ে কী সমস্যা মেটে? নাকি আবারও সুলগ্না তার অভিযোগের ঝাঁপি নিয়ে এসে দাঁড়ায় সৌগতর সামনে? জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে কবরস্থানে একটি ম্যানেকুইন দেখতে পায় সৌগত, যার অর্ধেকটার মুখ পোড়া। মৃত্যু নিয়ে গল্প লেখা সৌগত আর যাই হোক ভীতু নয়। কিন্তু এই সমস্ত অদ্ভুত ঘটনা কেন বার বার তার সঙ্গেই ঘটছে? কী ভাবছে অদিতি রাকা আর অমিতাভ? সৌগত কী পাগল হয়ে যাচ্ছে? 

আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে

এই একই প্রশ্ন আর প্রতি পদে এক অজানা আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায় সিরিজ়ের প্রতিটা পর্বে। এক অদ্ভুত আকর্ষণে পর্দার সামনে থেকে সরতে দেয় না যেন। সাতটা পর্ব শেষ না করে ওঠা যায় না কিছুতেই। অজানা ভয় আর মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহলকে কাজে লাগিয়ে গল্পের ভেতরের সাস্পেন্সকে ঠাসবুনোটে সাজিয়েছেন সৌরভ। একের পর এক পর্ব দেখতে-দেখতে একটা সময় বোঝা যায় গল্প ‘হুডানইট’ থেকে ‘হোয়াইডানইট’-এর দিকে মোড় নিচ্ছে। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শেষ পর্ব অবধি স্ক্রিনের সঙ্গে আটকে থাকতে বাধ্য করেছেন সৌরভ।

কিছু প্রশ্ন তবুও থেকে যায় শেষে। যেমন রাকা কীভাবে সব মেনে নিলো? কবে লেখা হলো দ্বিতীয় চিত্রনাট্য? তবে সেগুলোর উত্তর খুঁজতে ‘শব্দজব্দ’র দ্বিতীয় সিজ়নের অপেক্ষায় থাকতে হবে। 

অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। নিজের ভূমিকায় রজত কাপুর অনবদ্য। কোথাও তাঁকে সৌগত সিনহা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায়নি। সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের ডাব করা কন্ঠস্বর তাঁর সঙ্গে অসম্ভব ভালো মিলে গেছে। কোথাও তাঁর থেকে রজতকে আলাদা করা যায়নি। এর জন্য সুদীপ্তর প্রশংসা প্রাপ্য। মুমতাজের বাস্তব ও কল্পনা মেশানো চেহারায় ফুটিয়ে তোলা ভয়ের আবহকে এই সিরিজ়ের প্রাণ বলা চলে। অমিতাভর ভূমিকায় সুব্রত সপ্রতিভ ও বিশ্বাসযোগ্য। চরিত্রটি যেন তাঁকে ভেবেই লেখা হয়েছে। পায়েল তাঁর ভূমিকায় যথাযথ। রাকার চরিত্রে সলোনিকে দেখতে ভালো লাগে। গোটা সিরিজ় জুড়ে শুভদীপ দের দক্ষ ক্যামেরার কাজ সাসপেন্সকে বজায় রাখতে সাহায্য করে। অমিত বোস ও যশ গুপ্তর সঙ্গীতে প্রজ্ঞার গাওয়া ‘বোকা পাহাড়’ গানটি শ্রুতিমধুর।

সব মিলিয়ে প্রত্যাশামতোই সিরিজ়ের শেষ অবধি আগ্রহ ও উত্তেজনা ধরে রাখে ‘শব্দজব্দ’। বাংলায় চেনা ছকের থ্রিলারের গন্ডির বাইরে রহস্য ও ভৌতিক আবহে টানটান উত্তেজনার স্বাদ পেতে হলে দেখতেই হবে এই সিরিজ়। সেই সঙ্গে মনের কোণে উঁকি দেওয়া কিছু অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী সিজ়নের।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *