সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই দূরদর্শনে সংবাদ পাঠিকার চাকরি। তারপর অভিনেত্রী হিসেবে এক দশকেরও কম সময়ে গোটা দেশের হৃদয় জয় করে মাত্র একত্রিশেই মাতৃত্বজনিত শারীরিক জটিলতায় জীবনযুদ্ধে পরাজিত, এমন দুরন্ত গ্রাফ যাঁর জীবনে, তিনি যে মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পরও মানুষের মনে অমলিন স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করবেন তা বলাই বাহুল্য। স্মিতা পাতিল। আজও যাঁর অভিনীত ছবির প্রিন্টে ওই গভীর কালো চোখের আবেদনকে অস্বীকার করা যায় না, পর্দায় যাঁর উপস্থিতি সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিতে বাধ্য, তিনি তিরিশেরও কম বয়সে জয় করেছেন দুটি জাতীয় পুরস্কার, তিনটি ফিল্মফেয়ার এবং দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মশ্রী। এছাড়া অজস্র পুরস্কারের মনোনয়নের তালিকা না হয় বাদই রইল। যথার্থভাবেই স্মিতার জীবন এতটাই ঘটনাবহুল ও চমকপ্রদ যে তা নিয়ে উপন্যাস লেখা যেতে পারে, হতে পারে বায়োপিকও।
আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে, ১৯৫৫ সালে আজকের দিনে পুনেতে জন্ম হয় এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর। তাঁর কাজের জগতে পা রাখার ঘটনা ছিল বড় অদ্ভুত। খুব কম বয়সে মারাঠি ভাষায় দূরদর্শনে সংবাদ পাঠিকার চাকরি পান স্মিতা। কিন্তু সেই চাকরি করার কোনও পরিকল্পনাই তখন তাঁর ছিল না। স্মিতার বোন অনিতার বান্ধবী জ্যোৎস্না দূরদর্শনে চাকরি করতেন। স্মিতা সেদিন তাঁর বোন ও তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে গিয়েছিলেন মুম্বই (তৎকালীন বন্বে) দূরদর্শনের কাজ কিভাবে হয় দেখতে, স্বাভাবিক কৌতূহলবশে। আর ঠিক সেদিনই সেখানে সংবাদ পাঠক ও পাঠিকাদের অডিশন হচ্ছিল। জ্যোৎস্নার আগ্রহে স্মিতাও অডিশন দিলেন এবং একবারেই সংবাদ পাঠিকারূপে নির্বাচিত হলেন। কিন্তু তিনি তো তখন কলেজপড়ুয়া। দূরদর্শনের চাকরি করতে গেলে তো প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। অগত্যা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর না করিয়ে তাঁকে দৈনিক পারিশ্রমিকের শর্তে কাজে নিয়োগ করা হলো।
আরও পড়ুন: তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
সংবাদ পাঠিকা হিসেবেই দর্শকদের নজর কাড়েন স্মিতা। এই সময় তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিদীপ্ত সৌন্দর্য চোখে পড়ে যায় বিশিষ্ট পরিচালক শ্যাম বেনেগলের। তাঁর ‘চরনদাস চোর’ ছবির জন্য তিনি স্মিতাকে বেছে নেন। তবে স্মিতার বাবা মা কেউই এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবু ছোটদের ছবি ভেবেই তাঁরা সম্মতি দেন। কিন্তু তাঁদের মত বদলে যায় ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর। ছবিতে রানীর ভূমিকায় স্মিতাকে দেখে তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে মেয়েকে ছবিতে অভিনয় করতে দিয়ে তাঁরা কোনও ভুল করেননি।
শুরু হয় শ্যাম বেনেগলের পরের ছবি ‘নিশান্ত’। কিন্তু এবার বাধা এলো অন্যদিক থেকে। স্মিতার কলেজের অধ্যক্ষ কিছুতেই রাজি নন বিএ পরীক্ষার তিনমাস আগে স্মিতাকে হিন্দী ছবিতে অভিনয় করতে দিতে। পরিচালক তাঁকেও বোঝালেন যে ‘নিশান্ত’ ঠিক গড়পড়তা সিনেমা নয়, বরং একেবারেই অন্যধারার একটি ছবি। অবশেষে রাজি করানো গেল অধ্যক্ষকে, ছবিতে কাজ করলেন স্মিতা। মুক্তি পেল ‘নিশান্ত’, এবং এবার সেন্ট জে়ভিয়ার্সের অধ্যক্ষও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করলেন যে এমন ছবির জন্য কিছু ক্লাস বাদ দেওয়া যেতেই পারে।
আরও পড়ুন: আবারও একসঙ্গে সৃজিত-অনির্বাণ
স্মিতার সঙ্গে করা শ্যাম বেনেগলের তৃতীয় ছবি ‘ভূমিকা’ স্মিতাকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পরিচিতি এনে দেয়। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। এরপর স্মিতার সামনে খুলে যায় হিন্দী ছবির দরজা। একের পর এক মূলধারার ছবির জন্য ডাক পেতে থাকেন তিনি। কিন্তু স্মিতা তখনও বাজার চলতি হিন্দী ছবির নায়িকা হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। স্বভাবের দিক থেকে চিরকাল নারীবাদী স্মিতা কিছুতেই নারীদের দুর্বল হিসেবে দেখাবার কোনও মাধ্যমকে মেনে নিতে পারতেন না। তাই তিনি তথাকথিত বাণিজ্যিক হিন্দী ছবির মুখ হয়ে উঠতে চাননি কোনওভাবেই। তাঁর মত ছিল, নারীর জীবনসংগ্রামকে ছোট করে দেখিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছবিকে তুলে ধরাই যে ছবির উদ্দেশ্য সেখানে তিনি কিছুতেই অভিনয় করবেন না।
পরবর্তীকালে অবশ্য নিজের মত পাল্টেছিলেন তিনি, বা বলা ভালো আদর্শগত নানা পরিস্থিতি তাঁকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে ‘মন্থন’, ‘আক্রোশ’, ‘সদগতি’, ‘চক্র’, ‘শক্তি’, ‘নমকহালাল’, ‘মন্ডি’, ‘বাজার’, ‘মির্চ মসালা’, ‘অর্থ’ স্মিতাকে নানান রূপে দর্শকের সামনে হাজির করে। ভাগ্যিশ তিনি সিদ্ধান্ত বদল করেছিলেন, নাহলে এতরকম চরিত্রে স্মিতাকে দেখতে পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতেন দর্শক। মূলধারার ছবির জগতে প্রবেশ করে সেই আশির দশকে স্মিতা আচমকা ভেঙে দিলেন হিন্দী ছবির সবথেকে বড় মিথ—নায়িকা হতে গেলে ফর্সা ও সুন্দরী হওয়া আবশ্যক। স্মিতা দেখিয়ে দিলেন এ দেশের সনাতন ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শ্যামবর্ণা ও প্রথাগতভাবে সুন্দরী না হয়েও একের পর এক ছবিতে নায়িকারূপে পর্দা কাঁপানো যায়, কাঁপিয়ে দেওয়া যায় আপামর ভারতবাসী পুরুষের হৃদয়ও।
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
নানান গল্প আছে স্মিতাকে নিয়ে। অভিনয় নিয়ে বরাবর অত্যন্ত সচেতন স্মিতা প্রয়োজনে মুম্বইয়ের বস্তিতে গিয়েও সময় কাটিয়েছেন, ‘চক্র’ ছবি করার সময়। তেমনই জানা যায় একবার ‘গলিয়ো কা বাদশা’ ছবির শ্যুটিং এর সময় সহশিল্পী রাজকুমারকে শোয়া অবস্থায় মেক আপ নিতে দেখে স্মিতাও জেদ ধরেছিলেন তাঁকেও ওইভাবে মেক আপ করাতে হবে। যদিও সেই সময় তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন মেকআপ আর্টিস্ট দীপক সাওয়ান্ত। তবে পরে স্মিতার অকাল মৃত্যুতে তিনিই স্মিতাকে ওইভাবে মেক আপ করে দিয়েছিলেন তাঁর কথা রাখার জন্য।
এখানেই শেষ নয়। স্মিতার জীবনের সবচেয়ে উত্তাল সময় আসে অভিনেতা রাজ বব্বরের সঙ্গে সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ার পর। রাজও তখন স্মিতার মতোই উঠতি তারকা। দুজনে একে অন্যের প্রেমে হারিয়ে গেলেন। রাজ তাঁর স্ত্রী নাদিরা ও দুই সন্তানকে ছেড়ে স্মিতার সঙ্গে লিভ ইন করতে শুরু করেন। পরে বিয়েও করেন তাঁরা। যদিও রাজ তাঁর পূর্ব পত্নীর সঙ্গে বিচ্ছেদে যাননি, বরং তিনি স্মিতার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা দোটানায় ছিলেন বলা যায়। রাজের এই প্রতিনিয়ত টানাপোড়েন স্মিতার জীবনেও শান্তি ব্যাহত করেছিল। স্মিতার অভিনয়ে মুগ্ধ আপামর ভারতবাসী কিন্তু রাজ ও স্মিতার এই সম্পর্ককে ভালো চোখে দেখেনি। রাজের ঘর ভাঙার জন্য বারবার দোষারোপ করা হয়েছে স্মিতাকেই। যেন রাজের তরফে কোনও আগ্রহ ছিল না। ঘরে বাইরে এই যুগ্ম সমস্যা স্মিতাকে সামাজিকভাবে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলেন তিনি। রাজ তখনও মনস্থির করে উঠতে পারেননি। তবে তিনি ছেড়ে যাননি স্মিতাকে এও সত্যি।
আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে
বিয়ের পরে স্মিতা চেয়েছিলেন তাড়াতাড়ি মা হতে। সেই মতো ছেলে প্রতীকের জন্ম হলো ১৯৮৬-এর ২৮ নভেম্বর। মাতৃত্বজনিত নানান জটিলতায় স্মিতার অবস্থার অবনতি হতে লাগলো। অবশেষে মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করলেন তিনি, পুত্রের জন্মের ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় ১৩ ডিসেম্বর বিদায় নিলেন স্মিতা। হয়তো অনেকগুলো সম্পর্কের জটিলতার বন্ধনকে এভাবেই মুক্ত করে দিয়ে গেলেন তিনি। স্মিতার মৃত্যুর পর রাজ আবার নাদিরার কাছে ফিরে যান। প্রতীক মানুষ হন তাঁর দাদু দিদার কাছে। একটা সময় মা বাবার অনুপস্থিতি তাঁকে ড্রাগের অন্ধকার দুনিয়ায় ঠেলে দিয়েছিল, পরে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন ও বর্তমানে হিন্দী ছবিতে সুঅভিনয়ের জেরে যথেষ্ট পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে প্রতীক স্মিতাকে স্মরণ করে বলেন, তাঁর মা যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন ও বাবা যদি তাঁকে একটু সময় দিতেন তাহলে হয়তো তাঁর জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।
হতে তো পারতো অনেক কিছুই। কিন্তু হয় কি? স্মিতার মতো তারারা উজ্জ্বলতর হতে হতে হঠাৎ যে কখন খসে পড়ে কেউ জানতেও পারে না। তবে তারা খসে গেলেও যেমন তার আলো থেকে যায় কয়েক আলোকবর্ষ ধরে, তেমনই স্মিতার আলোও ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতকে আলোকিত করতে থাকবে আরও বহু দিন, বহু দশক ধরে। সিনেমার মতোই ছিল তাঁর জীবন।