‘‘মন্টু পাইলট’-এর শুটিং করে এক একদিন কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি ফিরতাম’

কখনও গিটার হাতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা সল্লু, কখনও বা প্রযোজককে চিত্রনাট্য শোনাতে চাওয়া জয়, আবার কখনও প্রেমিকাকে স্বপ্ন দেখানো পাবলো। তারপর হঠাৎই একদিন মন্টু পাইলট হয়ে গড়পড়তা দর্শককে বেশ চমকে দিয়েছেন সৌরভ দাস । বাংলায় হয়ত খুব একটা চেনা মানুষ নয় মন্টুর মতো চরিত্রেরা। নানাধরণের চরিত্রের ভিড়ে কীভাবে গড়ে তুললেন মন্টুকে, রেডিওবাংলানেট-কে উত্তর দিলেন অভিনেতা।  

‘মন্টু পাইলট’-এ তোমার চরিত্রটা একজন দালালের, যে পতিতাপল্লীতে নারীশরীর কেনাবেচা করে। এছাড়া মন্টু একজন অনাথ। তার অতীতের স্মৃতি তাকে হতাশায় ডুবিয়ে রাখে। সবদিক থেকেই চরিত্রটা বেশ ডার্ক। এরকম একটা চরিত্র বেছে নিলে কেন?

উত্তরটা তুমিই বলে দিলে। ওই যে বললে ডার্ক। আমার কাছে ওই ডার্ক ব্যাপারটাই খুব প্রিয়। আমি নিজে একটু ডার্ক সিরিজ় দেখতেই ভালোবাসি। একটা সময় দর্শক আমাকে কমেডিয়ান হিসেবেই চিনত। শুরুর দিকে বেশিরভাগ কাজই করেছি কমেডির ওপর। আমি নিজেও সারাক্ষণ মজা করতে ভালোবাসি। তাই কমেডি করাটা আমার কাছে স্বাভাবিক। তবে আমি মনে করি একটা ডার্ক চরিত্রে কাজ করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং, কেননা এরকম চরিত্রে প্রচুর স্তর থাকে। যেহেতু আমি নিজে সেরকম নই, তাই এই ধরণের চরিত্র করতে আমাকে অনেকটা খাটতে হয়। একজন অভিনেতা তো চ্যালেঞ্জ নিতেই ভালোবাসবে, আমিও ব্যতিক্রম নই। এখনও অবধি করা চরিত্রগুলোর মধ্যে মন্টুই সবথেকে কঠিন ছিল।




মন্টুর মতো চরিত্র তো আর রাস্তাঘাটে দেখা যায় না। হোমওয়র্ক করলে কীভাবে?

এটার জন্য পুরো কৃতিত্বই পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্যের। দেবালয়দা আমাকে যেভাবে চরিত্রটা বুঝিয়েছিল, তাতে মন্টু আমার কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাকিটা নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছি। আমি যে কোনও চরিত্রের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাই। বলতে পারো হোমওয়র্কটা সেখানেই হয়ে যায়। এছাড়া কিছু পুরনো চরিত্রের কথাও মাথায় ছিল।

সাধারণত কাউকে দেখে তো একটা চরিত্রকে রূপ দিতে হয়। মন্টুর ক্ষেত্রে কোন চরিত্রকে দেখেছিলে?

অনেকদিন আগে রাজ চক্রবর্তীর ‘রাগে অনুরাগে’ ধারাবাহিকে কাজ করেছিলাম। সেখানে একটা বিশেষভাবে হাঁটতাম আমি। সেটাকে আবার রপ্ত করেছিলাম। এছাড়া কিছু ছবিতে কয়েকটা চরিত্রের শরীরী ভাষা দেখে শেখার চেষ্টা করেছি। আমার নিজেরই করা একটা চরিত্র থেকে বড়-বড় চোখে তাকানোটা আবার ফিরিয়ে এনেছি। একটা সময় বন্ধুরা মিলে সোনাগাছির দিকে এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতাম। তখন মন্টুর মতো কিছু লোককে দেখেছি। তবে এসবের বাইরে গিয়ে যে জিনিসটা বুঝতে হয়েছে সেটা হলো পতিতাপল্লীর একজন দালাল হলেও মন্টু একজন সাধারণ মানুষ। তাই তার দুঃখ, হতাশা বা ক্রাইসিস একজন সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা হবে না। আমি সেভাবেই বুঝে নিয়েছিলাম চরিত্রটা। দেবালয়দা একটা জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছিল যে মন্টুর আসল কষ্টটা ওর মাকে নিয়ে। মন্টুর কাছে গাড়ি আছে। ও চাইলেই নীলকুঠি থেকে পালাতে পারে। কিন্তু পালায় না, কারণ এটাই ওর জগত। এই চরিত্রটার অসহায়তাটাকে আমি নিজের মতো করে ছুঁতে পারছিলাম, তাই বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

আবার চরিত্রের বিপরীতে গিয়ে মন্টু তো ভ্রমরকে ভালওবাসে

হ্যাঁ, এটাই মন্টুর একেবারে আলাদা একটা দিক। মেয়েরা তো ওর কাছে ব্যবসার জিনিস, তাহলে কীভাবে সে প্রেমে পড়তে পারে? এটা আমারই একটা সংলাপে ছিল, ‘যেখানে তুমি ধান্দা করছ, সেখানে প্রেম করলে সেটা আর ধান্দা থাকে না।’ তবুও প্রেম হয়ে যায়। তবে কোথাও মন্টু ভ্রমরকে ‘ভালবাসি’ বলে না। একটা ভালোলাগা আছে। তার আড়ালে রয়েছে নিরুচ্চার প্রেম। যখন নীলকুঠিতে একটা মেয়ে আত্মহত্যা করে তখন মন্টু শুধু ভ্রমরকে গিয়ে বলে ‘তুই কি আমার সঙ্গে যাবি?’ মানে ও চাইছে এই নীলকুঠির বাইরে গিয়ে নিজেদের মতো করে বাঁচতে কিন্তু সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতা ওর নেই। মন্টুর মধ্যে ওর মতো করেই ভালোবাসাটা আছে, তবে গদগদ প্রেম নেই।

এই যে এতদিন ধরে মন্টু করলে, এর আগে ‘চরিত্রহীন’ করেছ, সিরিজ় মানে তো অনেকদিনের ব্যাপার। টাইপকাস্ট হয়ে যাবার ভয় থাকে না?

আসলে টাইপকাস্ট তখনই হয় যখন তুমি দিনের পর দিন একই ধরণের চরিত্র করবে, আর দর্শক তোমাকে সেই চরিত্রে পছন্দ করবেন। এই জন্য দেবালয়দাকে কুর্নিশ। ‘চরিত্রহীন’ আর ‘মন্টু পাইলট’, এই দুটো সিরিজ়ে ও আমাকে দুরকমভাবে আমাকে ভেবেছিল। আরও আছে। যেমন ‘মন্টু পাইলট’-এ তৌফিকের চরিত্রে কাঞ্চনদাকে (মল্লিক) ভাবা। ওটা আর কেউ ভাবত না। লোকটার মধ্যে কী পরিমাণ অভিনয়ের খিদে আছে, সেটা আমরা শটের পরে বুঝতাম। কেউ তো ওকে ব্যবহারই করল না। সারাজীবন এক ধরণের কমেডি চরিত্রে অভিনয় করিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

‘চরিত্রহীন’-এ সতীশ আর এদিকে মন্টু, দুটো চরিত্রের মধ্যেই ক্রাইসিসটা ভীষণভাবে প্রকট

একদম তাই। শুধু ক্রাইসিসের ধরণটা আলাদা। একজনের প্রেম, আর অন্যজনের অস্তিত্ব। আমাকে এটা বারবার বলে দেওয়া হয়েছিল যে মন্টুর মধ্যে কোথাও যেন সতীশকে না দেখা যায়। সেটা আমি করতে পেরেছি, মন্টু হিসেবে দর্শক আমাকে পছন্দ করেছেন এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

নায়ক হওয়ার ইচ্ছে ছিল না কোনওদিন? নাকি চরিত্রাভিনেতাই হতে চেয়েছিলে বরাবর?

আমি নিজে তেমনভাবে না ভাবলেও, মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল আমি হিরো হব। আমার ডাকনাম বুবান। মা সবসময় বলত, ‘বুবান, এবার তুই হিরো হ। তোকে হিরো হতেই হবে।’ আসলে মায়েদের তো অনেক স্বপ্ন থাকে। তবে একটা ছবি আসছে ‘কড়াপাক’। সেটায় ওরকম হিরো না হলেও মোটামুটি নায়কের চরিত্রই করেছি বলতে পারো। আসলে আমার কোনওদিনই সলমান, শাহরুখদের মতো নায়ক হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। আমার পছন্দের অভিনেতা রণদীপ হুদা। ‘সরবজিত’ দেখলে বোঝা যায় লোকটার অভিনয়ের প্রতি ডেডিকেশন কতটা। আমার কাছেও অভিনয়টা ওরকমই একটা প্যাশনের জায়গা।

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

তোমার কাজগুলো পরপর দেখলে একটা অদ্ভুত গ্রাফ লক্ষ্য করা যায়। ‘ফাইনালি ভালবাসা’, ‘সোয়েটার’, ‘ঘুণ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘মন্টু পাইলট’ কোথাও তোমার চরিত্র নেগেটিভ, কোথাও বা মিলিয়ে মিশিয়ে আবার কোথাও নিপাট ভালোমানুষ। এই কন্ট্রাস্টটা কি সচেতনভাবে করা?

একেবারেই সচেতনভাবে করা। দুটো একরকম চরিত্রে পরপর কখনওই অভিনয় করতে চাই না। তবে এ ব্যাপারে আমি খুব ভাগ্যবান, এ কথা স্বীকার করেতই হবে। আমার প্রথম কাজ ছিল টেলিভিশনে ‘বয়েই গেল’ বলে একটা ধারাবাহিক। সেই সময় টানা দেড় বছর শুধু কমেডি করেছি আমি। এরপরেই ‘রাগে অনুরাগে’ ধারাবাহিকে ভিলেনের চরিত্রে কাজ করলাম। ব্যস, ওই নেশাটা আমাকে পেয়ে বসল। একটার পর একটা আলাদা চরিত্রে অভিনয় করার মজাটা পেয়ে গেলাম। তবে এখন একটু বেছে কাজ করি। পরপর দুটো মন্টুর মতো চরিত্র আমি করতে পারব না। একটা কথা বলি, আমি যেভাবে চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যাই তাতে আমার ব্যক্তিগত জীবনেও তার ছাপ পড়ে।

তোমার সহশিল্পীরা সবসময়েই বলে তুমি নাকি সেটে খুব মজা করো সকলের সঙ্গে। এদিকে আবার শটের আগে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে যাও। তখন তুমি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। এই সুইচ অন-সুইচ অফটা কীভাবে সামলাও?

দেখো, মজাটা করতে হয় ওই শটের হ্যাংওভার থেকে বেরোনোর জন্য। ওই যে বললাম চরিত্রটার মধ্যে ভীষণভাবে ঢুকে যাই, তাই নিজের মতো করে ভাবতে থাকি চরিত্রটাকে। তবে এটা কোনও মেথড অ্যাক্টিং নয়। আমার নিজের একটা মেথড বলতে পারো। আসলে চরিত্রটা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। পরের শটের জন্য নিজেকে তৈরি করার আগে একটু মজা করি। মন্টুর সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম যে এক একদিন বাড়ি ফিরতাম কাঁদতে-কাঁদতে। আমি তো তখন সৌরভ নই, আমি তো মন্টু। একটা সময় অনিন্দিতা দেবালয়দাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিল ‘তোমাদের শুটিংটা আর কতদিন চলবে গো?’ দেবালয়দা বুঝেছিল ব্যাপারটা। তারপর থেকে সেটে মজা করে, জোকস বলে আমাকে হালকা রাখার চেষ্টা করত।

মন্টুর পরে কী আসছে? টেলিভিশনে আর ফিরবে না?

একটু রয়ে সয়ে কাজ করতে চাই। একটা বড় কাজের পরে ক’টা দিনের ছুটি পেলে পরের কাজটা ভালো হয়। টেলিভিশনে এখন একটা মিউজ়িক্যাল শো সঞ্চালনা করছি। তবে মেগাসিরিয়াল করতে গেলে যে সময়টা দিতে হবে, সেটা এখন আমার হাতে নেই। আর আমি কোন কাজ নিজের ৫০ শতাংশ দিয়ে করতে পারব না। এই একই কারণে থিয়েটারও করছি না। যখন করব, তখন নিজের ১০০ শতাংশই দেব। তাছাড়া সব একসঙ্গে করতে গেলে কোনওটাই ভালো করে করতে পারব না। তবে ছবির কাজ একটা আসবে শিগগিরই, কথাবার্তা চলছে।

ছবি: প্রতিবেদক

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *