রুদ্ধশ্বাস গতি, কল্পনার মোড়কে চাঞ্চল্যকর সত্য ঘটনা
সিরিজ়: লালবাজার
পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল
অভিনয়ে: কৌশিক সেন, গৌরব চক্রবর্তী, সৌরসেনী মিত্র, হৃষিতা ভট্ট, সব্যসাচী চক্রবর্তী, সুব্রত দত্ত, রব দে, অনির্বাণ চক্রবর্তী, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, অরিন্দোল বাগচী, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, রঞ্জিনী চক্রবর্তী
দৈর্ঘ্য: ৬ ঘন্টা ২৮ মিনিট (১০ পর্বে)
RBN রেটিং: ৪/৫
রাতের অন্ধকার চিরে ছুটে যায় পুলিশের একটি জিপ। হঠাৎই সামনে ঘটে যায় এক ভয়ঙ্কর বিষ্ফোরণ। জিপ থেকে নেমে অদৃশ্য কোনও আততায়ীর দিকে পিস্তল তাক করে এক পুলিশ অফিসার। সঙ্গে-সঙ্গে পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে হুমকি, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে শত্রুতা ভালো নয়। ততক্ষণে কিছু দূরে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আরেক অফিসার আবিদাকে।
এক ঝটকায় ভয়ানক স্বপ্ন ভেঙে বিছানায় উঠে বসে কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সুরঞ্জন সেন (কৌশিক)। এই স্বপ্ন সে আগেও বহুবার দেখেছে। সহকর্মীকে বাঁচাতে না পারার হতাশা প্রতিবার গ্রাস করে তাকে।
এদিকে শহরে অপরাধ চক্রের চাঁই হয়ে বসেছে রচপাল। তার সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লাগে সুরঞ্জন। সমান্তরালভাবে চলতে থাকে ওয়াটগঞ্জ এলাকায় এক যৌনকর্মী মৃত্যুরহস্য। খুন করার পর সেটা আত্মহত্যা বলে চালানোর পেছনে কার হাত রয়েছে, তা জানতে রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমে পড়ে ওয়াটগঞ্জ থানার ওসি সাবির আহমেদ (গৌরব)। একের পর এক ঘটে চলা অপরাধের জট ছাড়াতে মাঠে নামে লালবাজার হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের মীরা (সৌরসেনী), গৌরাঙ্গ (অনির্বাণ), আনিসুর (বিজয় সিং) ও ঋজু (রব)। সুরঞ্জনের প্রেমিকা সাংবাদিক মায়াও (হৃষিতা) হাজির হয় মঞ্চে।
ওয়াটগঞ্জ রহস্য ঘনীভূত হতেই এই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে এসি পোর্ট গৌরব দত্ত (সুব্রত), ফরজ়ানা (রঞ্জিনী), আব্বাস গাজী (দিব্যেন্দু) ও আরও নানা চরিত্র।
আরও পড়ুন: যন্তর মন্তর কক্ষের নেপথ্যে
১৯৮৪, ডিসি (পোর্ট) বিনোদ মেহতার হত্যাকাণ্ড; ১৯৯৩, নিজের বাবা, সৎমা ও সৎভাইকে খুন করা সজল বারুই; ২০১৫, রবিনসন স্ট্রিট কঙ্কালকাণ্ড। কলকাতা পুলিশের এরকম আরও বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলা উঠে এল দশ পর্বের ‘লালবাজার’-এ। সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিরিজ়টি লিখেছেন রঙ্গন চক্রবর্তী। একই রহস্যের পেছনে ধাওয়া করে দর্শক যাতে ক্লান্ত না হয়ে পড়ে, সেই জন্য রঙ্গন একাধিক মামলা এনেছেন এই সিরিজ়ে। কাহিনীর বহুমুখীতা আনার পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের কর্মঠ অফিসারদের ট্রিবিউটও দিলেন তিনি। তবে একাধিক তদন্ত আর অগুনতি চরিত্রের ভিড়ে মাঝেমাঝে রহস্যের সূত্র ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
অভিনয়ের দিক থেকে কেউ কাউকে এতটুকু জমি ছাড়েননি। নিজেদের চরিত্রের একেবারে ভেতরে ঢুকে গেলেন কৌশিক, সৌরসেনী, গৌরব, রঞ্জিনীরা। এছাড়া মনসুরের ভূমিকায় ভিকি ও গৌরাঙ্গর চরিত্রে অনির্বাণ অন্যরকমভাবে হাজির। নিজেদের স্বভাবসিদ্ধ অভিনয়শৈলী দিয়ে চরিত্রগুলি ফুটিয়ে তুললেন তাঁরা। ‘ধানবাদ ব্লুজ়’, ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস’ ও ‘জামতারা’র পর আরও একবার অনবদ্য দিব্যেন্দু। ছোট পরিসরে শান্তিলাল, সব্যসাচী ও সুব্রত যথাযথ।
দশটি পর্ব জুড়ে বারবার নানা নির্মম খুনের সাক্ষী হন দর্শক। কোনওরকম রাখঢাক না করে নির্মমতার শিখরে পৌঁছে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখিয়েছেন সায়ন্তন। তার সঙ্গে কলকাতার মাফিয়ারাজ ও যৌনপল্লীকে ঘিরে দৃশ্যপটের নির্মাণ সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এছাড়াও কাহিনীর সঙ্গে জড়িত প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এই সব ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রভাব ঠিক কতটা পড়ে, বা আদৌ পড়ে কি না, সেই বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রেখে চরিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
রুদ্ধশ্বাস এই সিরিজ়ের নাটকীয়তা আরও বাড়িয়ে দেয় দেবজ্যোতি মিশ্রর আবহ। অনুপম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও নিকিতা গান্ধীর গাওয়া শীর্ষসঙ্গীতটি এড়িয়ে মূল কাহিনীতে ঢোকা অসম্ভব। নানা স্থানের মানচিত্র বোঝানোর জন্য ও কলকাতার অলিগলিতে বিভিন্ন চেজ় সিকোয়েন্সে ড্রোনের সুচারু ব্যবহার প্রশংসার দাবি রাখে।
অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়েছে ‘লালবাজার’-এর কাহিনী। তবে তার জন্য ঘটনাপ্রবাহে কোনও প্রভাব পড়েনি। সম্পাদনায় গৌরব দত্তর পারদর্শীতা লক্ষ্যনীয়।
কাহিনীর ঠাসবুনোট দর্শককে এই সিরিজ়ের পরবর্তী সিজ়নের জন্য অপেক্ষায় রাখবে।