অভিনয়গুণে সমৃদ্ধ, উত্তরণের গল্পও
ছবি: তীরন্দাজ শবর
পরিচালনা: অরিন্দম শীল
অভিনয়ে: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, শুভ্রজিৎ দত্ত, নাইজেল আকারা, চন্দন সেন, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা কুমার, রম্যাণী মন্ডল, অরিন্দম শীল
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৩ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
১২ মার্চ রাত সাড়ে ন’টা। চৈত্রের অকাল বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে শহর কলকাতা। কাচের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলোও ঝাপসা। সিঁথির মোড় থেকে তিনজন যাত্রী উঠলেন একটি ট্যাক্সিতে। যাত্রীদের মধ্যে দুজন পুরুষ, একজন মহিলা। যথাসময়ে গন্তব্যে নেমে গেলেন দুজন। কিন্তু শেষ যাত্রীকে নিয়ে ট্যাক্সিচালক সুমিত (নাইজেল) পৌঁছে গেল ভবানীপুর থানায়।
সুমিত ওরফে পাড়ার সকলের বুলুদা অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হলেও পরিস্থিতির চাপে সে দেউলিয়া। বাবার ব্যবসা ডুবেছে, মায়ের কর্কটরোগের চিকিৎসায় শেষ সম্বল বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। রয়ে গেছে শুধু নিজেদের গাড়িটা, যা এখন ট্যাক্সিতে পরিণত হয়েছে। বুলু নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। গায়ের জোরে নয়, মানবিকতাকে হাতিয়ার করে বস্তির সকলের কাছে সে মুশকিল আসান হয়ে ওঠে। অথচ এমন একজন মানুষ একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মূল অভিযুক্ত। তদন্তভার গিয়ে পড়ে শবর দাশগুপ্তের (শাশ্বত) ওপর।
আরও পড়ুন: অর্ধশতক পেরিয়ে আবারও বড়পর্দায় ‘আনন্দ’
লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার শবরের এক ছায়াসঙ্গীও আছে, ইন্সপেক্টর নন্দ (শুভ্রজিৎ)। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, হোমস, পোয়ারোর মতো প্রত্যেক গোয়েন্দারই রহস্য সমাধানের নিজস্ব একটি ধারা থাকে। শবরেরও আছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা সমস্ত অপরাধীকেই সে তার হিটলিস্টে রাখে কিন্তু খাঁচায় বন্দী করে না।
মধ্যবয়সী সীতানাথ সমাদ্দার (অরিন্দম) কেন হঠাৎ স্থায়ী সরকারি কেরানীর চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে গেলেন, মেঘনাদের সঙ্গে সীতানাথ এবং পাপিয়া সমাদ্দারের (দেবযানী) মেয়ের কী সম্পর্ক, জাহ্নবীবাবুর মেয়ে সোনালী কে, সুকান্ত কেন তার কাকাকে হুমকি দিল, সর্বোপরি সীতানাথের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সমরেশের মেয়ে রুমকির (দেবলীনা) অবস্থানটা ঠিক কীরকম, এইসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যের সমাধান। শবরের ছোঁড়া তীর পাখির চোখে লাগলে তবেই একে-একে জট খুলবে।
আরও পড়ুন: প্রযুক্তিতে বিপ্লব এলেও প্রেক্ষাগৃহের বিকল্প কখনও হবে না, মত পরিচালকদের
দিন আনা-দিন খাওয়া, বস্তিতে থাকা নিম্নমধ্যবিত্ত, স্বল্পবিদ্যার মানুষগুলোর কাছে বার-ব্রত-পার্বণ যেমন আনন্দের তেমনই ভয়ের। তা যদি আবার শনিদেবের পুজো হয় তাহলে তো কথাই নেই। অন্যান্য মাসের শনিবারে সাধারণ পুজো হলেও শ্রাবণ মাসের শনিবারগুলোতে হয় উৎসব। কারণ শ্রাবণ হলো শনিঠাকুরের জন্মমাস। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা মূল গল্পে ঘটনার বর্ণনা শুরু হয় ১৭ জুলাই অর্থাৎ বাংলার শ্রাবণ মাস। সেই অর্থে ছবিতে দেখানো ঘটনার দিন ১২ মার্চ, বড়বাবার পুজো, বালভোজন বা সেই উপলক্ষে বস্তিতে রাতব্যাপী জলসা কতটা যুক্তিপূর্ণ সে প্রশ্ন থেকে যায়।
গোয়েন্দা গল্প হিসেবে শীর্ষেন্দুর ‘তীরন্দাজ’ তেমন জোরালো নয়। কিছুটা একমাত্রিকও বলা চলে। এরকম কোনও গল্পকে ছবির উপযুক্ত করে তুলতে গেলে, ক্ষতচিহ্ন মেরামত করার দায়িত্ব এসে পড়ে চিত্রনাট্যকারের ওপর। সেই কাজে সফল পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ও অরিন্দম। শীর্ষেন্দুর গল্পে বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা একটি কঠিন বই পড়ছিল দর্শনের ছাত্র, ট্যাক্সিচালক সুমিত। তবে ছবিতে তা বদলে গেছে এস্থার ডাফলো এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা অর্থনীতির বইতে। সময়োপযোগী বদল নিঃসন্দেহে।
ঠিক চার বছর পর আবার দর্শকের সামনে এল শবর। মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময়, কেটেছে লকডাউন। গল্পে বর্ণিত ‘রোগা ছিপছিপে’ শবর তাই বোধহয় এখন পর্দায় একটু স্থূলকায়। তবে দর্শকের মনে শাশ্বতই শবর। তাঁর অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কতকটা তাঁর কল্যাণেই বাংলা সাহিত্যে ফেলু-ব্যোমকেশ-কিরিটিদের পাশে আজ শবরের স্থান পাকা। মূল গল্পে নন্দর অনুপস্থিতি যে খামতি তৈরি করেছিল, ছবিতে তা পূরণ করেছেন শুভ্রজিৎ। শবর এবং নন্দের মজার কথোপকথন ছাড়া এই ছবি তৈরি হতে পারত না। দর্শকের চাহিদা মেনে পরিচালক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
অরিন্দম আগে অভিনেতা, পরে পরিচালক। সীতানাথের চরিত্রটি তাঁর থেকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে হয়ত আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারত না। তাঁর বিপরীতে দেবযানী যথাযথ। নাইজেলের অভিনয় বরাবরই খুব সাবলীল। এ ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। সুমিতের চরিত্রে তাঁকে ভীষণ জীবন্ত, বাস্তব মনে হয়। সুমিতের প্রতি দুর্বলতা, সীতানাথের প্রতি ঘৃণা, আবার বর্তমান স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিটি স্তরেই যথাযথ রুমকি (দেবলীনা)। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও সুকান্তর (জয়দীপ কুন্ডু) অভিনয় দর্শক বেশ উপভোগ করবেন। অন্যদিকে ধীর, স্থির, আলগা সুন্দরী, অন্তরের শিক্ষায় শিক্ষিত, বস্তির অন্যান্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা দিয়া (রম্যাণী), যেন একেবারে বই থেকে তুলে আনা সেই চরিত্রটিই। বোঝাই যায় না এটি তাঁর প্রথম ছবি। তবে সোনালী (পৌলমী) বড়ই ফিকে। বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করা, নিরীহ, নিস্পৃহ পরেশনাথের মনের গভীরে যে রোগ বাসা বেঁধেছিল, তা বোধহয় চন্দন ছাড়া আর কোনও অভিনেতা বুঝতে পারতেন না।
গোয়েন্দা গল্প মানেই রহস্য। সেই রহস্য ঘনীভূত করার কাজটি আবহের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছেন বিক্রম ঘোষ। গোয়েন্দা গল্পে গানের ব্যবহার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আরোপিত মনে হয়। আবার এও ঠিক, বস্তিতে বারের পুজো বা কারখানায় বিশ্বকর্মা পুজো, হুলাবিলা ডান্স বিট ছাড়া যেন এরকম উৎসব জমে না। উজ্জয়নী মুখোপাধ্যায় এবং তিমির বিশ্বাসের কণ্ঠে গান দুটি খুব একটা মনে না ধরলেও এর ব্যবহার সঠিকভাবেই করেছেন বিক্রম।
অয়ন শীলের চিত্রগ্রহণ ভালো। তবে সম্পাদনার ক্ষেত্রে সংলাপ ভৌমিক একটু রাশ টানতে পারতেন।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
অভিনয়গুণে সমৃদ্ধ ‘তীরন্দাজ শবর’ আসলে সমাজের সকল স্তরের ছবি। এই ছবির নায়ক যতটা শবর, ততটাই সুমিত। কোনও অংশে কম নয় পরেশনাথের অবদান। সংসারধর্ম ব্যাপারটা সুমিতের কাছে ইউটোপিয়া। তার নিজের কোনও সংসার নেই। অথচ সে বস্তির অন্যান্য সকলের জীবনযুদ্ধের নায়ক। সমাজ চায় এমন বুলুদের, যাঁরা সব জেনেও আরও একবার বিশ্বাস করবে, আরও একবার ভুল শোধরানোর সুযোগ দেবে। সকলের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সরকারের উর্দিধারী অফিসার হয়েও ‘আনঅফিশিয়াল’ মানবিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ শবর, আজকের দিনে যা বিরল।
হারজিত, অপরাধ, মনস্তত্ত্ব, মানবিকতার মিশেলে এই ছবিকে ঠিক গোয়েন্দা গল্পের তকমা দেওয়া যায় না। তবু গোয়েন্দা হিসেবে শবরের তীর সঠিক নিশানায় লাগল কিনা তা যাচাই করার জন্য এই ছবি একবার দেখে আসাই যায়।