শেখর-শার্লকে সাবাশ
সিরিজ়: শেখর হোম
নির্মাণ/পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ গুহ, রোহন সিপ্পি
অভিনয়ে: কে কে মেনন, রনবীর শোরে, রুদ্রনীল ঘোষ, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, রাসিকা দুগল, কীর্তি কুলহারি, কৌশিক সেন, সমিউল আলম, শেহনাজ প্যাটেল, মীর আফসার আলি, শ্রুতি দাস
দৈর্ঘ্য: ৪ ঘণ্টা ১৫ মিনিট (৬ পর্বে)
RBN রেটিং: ৬/১০
সাহিত্যের পাতায় আজও বিশ্বের অন্যতম এবং সর্বোচ্চ চর্চিত গোয়েন্দা শার্লক হোমস। ১৮৮৭ সালে তার জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে আজ অবধি বহুজনে, বহুবিধভাবে, বহু মাধ্যমে হোমসকে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম এবং জনপ্রিয় ছিল ‘শার্লক’ সিরিজ়, যেখানে শার্লক হোমস আধুনিক। সেই বিবিসির সঙ্গেই যৌথ উদ্যোগে শার্লক হোমসের ভারতীয়করণ করে নির্মিত হয়েছে নতুন সিরিজ় ‘শেখর হোম’ (Shekhar Home)।
ভারতীয় প্রেক্ষাপট ও সাম্প্রতিক সময়ে আনতে গেলে মূল কাহিনিতে কিছু বদল অবশ্যম্ভাবী। তাই নব্বইয়ের দশকের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই সিরিজ়ে শার্লক হোমস হয়ে যান শেখর হোম (কে কে) এবং ওয়াটসন এখানে জয়ব্রত সৈনি (রনবীর)। হোমসের বাড়িওয়ালি মিসেস হাডসন হয়ে যান মিসেস হেনরিক (শেহনাজ়) এবং হোমসের সহকারী বিলি হয়ে ওঠে পিন্টু (সমিউল)। ইন্সপেক্টর লেসট্রেড এখানেও হোমসের সাহায্য চাইতে আসেন, তবে ইন্সপেক্টর লাহা (রুদ্রনীল) রূপে। হোমস যার অনুরাগী সেই আইরিন অ্যাডলার এখানে ইরাবতী (রাসিকা) এবং হোমসের দাদা মাইক্রফট এখানে মৃণ্ময় (কৌশিক)।
ঘটনাস্থলেও বদল হয়েছে। লন্ডন হয়ে গিয়েছে লোনপুর এবং ডার্টমুরের মতো জায়গা হয়ে গিয়েছে ডাটগঞ্জ। শেখর বেহালা বাজায় না। বাজায় রবাব এবং শার্লকের মতো ধূমপানের স্বভাব তার নেই।
মোট ৬২টি হোমসকাহিনির মধ্যে থেকে দুটি উপন্যাস ও দুটি ছোটোগল্প দিয়েই কাহিনি বুনেছেন অনিরুদ্ধ। তার সঙ্গে অতিরিক্ত কাহিনি যোগ করেছেন নীহারিকা পুরী। ‘A Study in Scarlet’, ‘The Adventures of the Red-Headed League’, ‘A Scandal in Bohemia’ এবং ‘The Hound of the Baskervilles’ অবলম্বনেই এগিয়েছে এই সিরিজের প্রথম চারটি পর্ব। শার্লক হোমসের এই তুমুল জনপ্রিয় কাহিনিগুলি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই চারটি পর্ব হয়ে ওঠে যেন শেখর হোম এবং তার আশপাশের মানুষগুলি সম্পর্কে গৌরচন্দ্রিকা। প্রতিটি পর্বের শেষেই দেখা যাচ্ছিল এক রহস্যময় ‘M’-কে। হোমসানুরাগীরা অনায়াসেই যাঁকে মরিয়ার্টি বলে চিহ্নিত করতে পারেন। তবু সেই মানুষের পরিচয় পেতে শেখরের জীবনের এক রহস্যের জট খুলতে থাকে শেষ দুটি পর্বে। শেখর হোম কে? সেই প্রশ্নই বরং বেশি করে আচ্ছন্ন করে দেয় দর্শককে।
আরও পড়ুন: বাদ যাওয়া দৃশ্য সমেত ‘অথৈ’
প্রতিটি পর্বের কাহিনির মধ্যে বিবিসি সিরিজের গল্প বলার ধরণের ছাপ স্পষ্ট। বিশেষ করে তা ধরা দেয় প্রথম এবং চতুর্থ পর্বে। তবে চিরপরিচিত কাহিনিগুলিকে যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়ে নব্বইয়ের দশকের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানানসই করে তোলেন চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক।
গোটা সিরিজ় জুড়ে কে কে মেনন অনবদ্য। দ্বিতীয় পর্বে শেখরের ব্যাপারে জয়ব্রতর উক্তি ‘জিনিয়াস হ্যায়!’ যেন কে কে মেননকেই সাজে। তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন রনবীর এবং রাসিকা। রুদ্রনীল তাঁর নিজের ভূমিকায় যথাযথ। কিন্তু অবাঙালি হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেক বাঙালি চরিত্রাভিনেতা যেমন নিজেদের বাংলা উচ্চারণকে যথাসম্ভব ভালো করার চেষ্টা করলেও রুদ্রনীলকে অবাঙালিদের মতো বাংলা বলতে দেখে একটু বিরক্তিই জাগে।
আরও পড়ুন: কলকাতায় আসছেন ব্রায়ান অ্যাডামস
একেকটি পর্বে একেক দল অভিনেতা আসার ফলে প্রশস্তির তালিকা কিঞ্চিৎ বড়। তবে তার মধ্যেও দেবুর ভূমিকায় দিব্যেন্দু, দাসবাবুর চরিত্রে মীর এবং ঊর্মিলারূপী শ্রুতি বিশেষভাবে দাগ কাটেন।
সৌরভ প্রভুদেশাইয়ের সম্পাদনা যথাযথ। তবে শেষ দুই পর্বে কাটছাঁট করার সময় আরও একটু কম নিষ্ঠুর হলে পারতেন। অনির্বাণ সেনগুপ্তের সাউন্ড ডিজ়াইনের পাশাপাশি জোয়েল ক্র্যাস্টোর মূল আবহ রহস্যের আমেজ বজায় রাখে। সংলাপ রচনার জন্য বৈভব বিশালের কথা উল্লেখ করতেই হয়। অনিরুদ্ধ-নিহারীকা জুটির টানটান চিত্রনাট্যের সঙ্গে তার বাংলা-হিন্দি মেশানো সংলাপ একদম খাপে খাপ মিলে যায়। শীর্ষ রায় ও শানু সিংহ রাজপুতের চিত্রগ্রহণ যথাযথ। দশ সেকেন্ডেরও কম সময়ে যে একেকটি পর্বের আকর্ষণীয় ইন্ট্রো করা সম্ভব, তা প্রমাণ করে দেয় এই সিরিজ়।
আরও পড়ুন: কাটা মুণ্ডুর রহস্য নিয়ে কলকাতা ঘুরে গেলেন শ্রদ্ধা-রাজকুমার
কিন্তু এতকিছুর পরেও এখটু খারাপলাগা থেকেই যায়। বিশেষ করে তা আসে শেষ দুই পর্বে। এই দুটি পর্বের কাহিনি সিরিজ়ের প্রয়োজনে আলাদাভাবে লিখেছেন নীহারিকা। তাতে আগের পর্বগুলির তুলনায় এই দুই পর্ব একটু ধীরগতির মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে চোখে লাগে পরিচালনার পরিবর্তন। সৃজিতের বদলে রোহনের পরিচালনায় রয়ে যায় প্রচুর ফাঁকফোকর। সবথেকে বেশি চোখে লাগে প্রপ এবং সেট নির্মাণ। কলকাতার বহুল পরিচিত বেশকিছু জায়গার ভুল নির্মাণ এবং দেওয়ালের পোস্টারে ভেঙে যাওয়া হরফে বাংলা দেখলে ভ্রুজোড়া সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, শুধুমাত্র গল্পের সূত্র ছাড়া দুই পরিচালকের মধ্যে আর কোনও মিল ছিল না। যার প্রভাব চিত্রগ্রহণেও পড়েছে। এ বিষয়ে কড়া সমালোচনা করতে গেলে সৃজিত মুখোপাধ্যায়েরই ছবি ‘ভিঞ্চিদা’র নামভূমিকায় থাকা চরিত্রের সংলাপ মনে পড়ে: ‘…তার চেয়েও জঘন্য হচ্ছে আর্ট। একটুও প্রপ-টপ নিয়ে রিসার্চ নেই বোধহয়, তাই না?’
এই খামতিগুলো উড়িয়ে দিলে ‘শেখর হোম’ একটানা বসে দেখার মতোই এক সিরিজ় এবং বলাই যায়, বহুদিন বাদে সৃজিতের পুরোনো পরিচালকসত্তাকে দর্শক দেখতে পাবেন। সিরিজ়ের সমাপ্তি দেখে পরবর্তী সিজন আসা নিয়ে সামান্য দোলাচল থাকলেও আশাবাদী থাকা যেতেই পারে।