আদিম অরণ্য ক্ষমা করে না
সিরিজ়: রক্তপলাশ
পরিচালক: কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: শিলাজিৎ মজুমদার, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, দেবদূত ঘোষ, অনন্যা সেনগুপ্ত, রোজা পারমিতা দে, উৎসব মুখোপাধ্যায়, মৌমিতা পণ্ডিত, শুভজিৎ কর, অসীম রায়চৌধুরী, দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়, মৌসুমী দালাল, কোয়েল মিত্র, বেবি তামান্না, সুব্রত দাশগুপ্ত
দৈর্ঘ্য: ৮ পর্ব
RBN রেটিং: ৩/৫
‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা/চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা পংক্তি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। একশ্রেণীর মানুষ না খেতে পেয়ে করুণা অর্জন করবে, কাজ না পেয়েও প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রাখবে, দিনের পর দিন বঞ্চনার শিকার হবে, ভিক্ষা পেয়ে অপ্রাপ্তি ভুলে থাকবে। অথচ আধপেটা খেয়ে, কলুর বলদের মতো দিন কাটিয়ে, জীবনের কাছে কোনও প্রত্যাশা না রেখেও আনুগত্য প্রদর্শন করে যাবে আজীবন। স্পর্ধায় মাথা তুলবে না কোনওদিন, স্রেফ কিছু অভিজাত মানুষের আঁতে ঘা লাগবে বলে। আর উচ্চকোটি সমাজ সেই গরীব মানুষের শ্রমের উপর বসে আয়েশ করবে, ইচ্ছেমত তাদের টাকা নয়ছয় করবে, তাদের ব্যবহার করবে নিজের প্রয়োজনে, আর কাজ মিটে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। এ যেন এক অলিখিত নিয়ম। কিন্তু কতদিন চলবে এ নিয়ম? আর কত সংগ্রাম করতে হবে সামাজিক সমতার দাবিতে? আদৌ কি সে সংগ্রামের কোনও স্বীকৃতি আছে?
ঘটনার প্রেক্ষাপট জঙ্গলমহলের কোনও এক কুসুমঝোরা এলাকার ফক্সহোল রিসর্ট। সমাজের ওপরতলার প্রতিনিধি, প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার মৃগাঙ্ক (দেবদূত), তার স্ত্রী অভিজাত ক্লাবের সদস্য মানসী (অনন্যা) ও তাদের মেয়ে তিতির (তামান্না), সমাজকর্মী পৃথা (রোজা) ও দিগন্ত (উৎসব), ব্যবসায়ী আদিনাথ (অসীম) ও ব্যান্ড গায়ক নিলয় (শুভজিৎ) সেখানে বেড়াতে আসে। আদিনাথ একা নয়, সে সঙ্গে করে নিয়ে আসে উচ্চবিত্ত সমাজের দামী এসকর্ট গার্ল মায়াকে (মৌমিতা)। এদের সকলের কাছেই ফক্সহোল রিসর্টের তরফে বিশেষ অফার দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। রিসর্টে সকলকে অভ্যর্থনা জানায় ম্যানেজার শংকর (দীপঙ্কর) ও নির্মলা (মৌসুমী)। সকলের আলাপ পরিচয়ের ফাঁকেই মায়ার পরিচয় নিয়ে কিছুটা ছুঁতমার্গ কাজ করে অতিথিদের মধ্যে। যদিও মায়ার এসবে কিছু যায় আসে না। আদিনাথ তাকে নিয়ে দিনরাত ফুর্তি করতে চাইলেও মায়া তার মক্কেলকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। সে তখন জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে ব্যস্ত। অন্যদিকে মৃগাঙ্ক-মানসী, দিগন্ত-পৃথার মধ্যে ব্যাক্তিত্বের সংঘাত ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। যদিও নিলয় তার কুকীর্তির জন্য খুব একটা অনুতপ্ত নয়।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
সেদিনই পিকনিকের মাঝে উপস্থিত হন রিসর্ট মালিক দীপঙ্কর (শিলাজিৎ)। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, যতক্ষণ না রাতের বিশেষ ককটেল ডিনারে অতিথিদের এক অদ্ভুত খেলার প্রস্তাব দিলেন দীপঙ্কর। স্পিন দ্য বটল খেলায় একে-একে অতিথিদের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। সকলের প্রবল আপত্তি থাকা সত্বেও কিছুটা সত্যি উঠে আসে সকলের সামনে। তবে দীপঙ্কর খেলা ভেঙে দিতে বাধ্য হয়, স্থানীয় জঙ্গলমহলের চরমপন্থী বিপ্লবী নেতা দিবাকর সান্যালের (কমলেশ্বর) গ্রেফতারের খবরে। ক্ষেপে উঠেছে আদিবাসী সমাজ, যে কোনও মুহূর্তে অতিথিরা আক্রান্ত হতে পারে। তাই বন্ধ করে দেওয়া হয় রিসর্টের মূল গেট। পরের দিনই চরমপন্থী বাহিনীর হাতে পণবন্দী হন অতিথিরা। এরপর শুরু হয় একদল শহুরে মানুষের বাঁচার লড়াই বনাম নিপীড়িত মানুষের অধিকারের সংগ্রাম।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
কাহিনীর প্রেক্ষাপট হিসেবে জঙ্গলমহলের ভেতর রিসর্ট সত্যি চমকে দেবার মতো। দিবাকরের লড়াই দর্শককে ভাবতে বাধ্য করবে। আসলে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার ঠুনকো অহঙ্কার ফিকে হয়ে যায় অরণ্যের আদিমতার কাছে, কিন্তু তার ঝাঁঝটা থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। নাহলে ওরকম চূড়ান্ত বিপদের সময়ে দাঁড়িয়ে এই তথাকথিত ভদ্রলোকেরা মায়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতেন না। ভিখু মূর্মুর (সুব্রত) মতো শয়তানের থেকে এই শহুরে শিক্ষিতরা কিসে আলাদা তাহলে?
কিছু খটকা থেকে যায় আটটি পর্বের শেষে। যেহেতু ওয়েব সিরিজ়ে সময়ের বাঁধন নেই তাই অতিথিদের অন্ধকার অতীত আরও একটু পরিষ্কারভাবে দেখানো যেত। তাতে গল্প আরও প্রাঞ্জল হতো।
আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন
দ্বিতীয়ত, রিসর্টের অতিথিরা যেভাবে প্রথমদিনই একসঙ্গে মিলেমিশে গেলেন, বাস্তবে তেমনটা হয় না। আজকের যুগে বেড়াতে গিয়ে কেউই অন্য পরিবারের সঙ্গে আলাপে খুব একটা আগ্রহী হন না।
তৃতীয়ত, গল্পের মাঝামাঝি গিয়ে জানা যায় এই অতিথিদের মধ্যে ছ’জনকে পরিকল্পিতভাবে ডেকে আনা হয়েছে। কিন্তু নিলয়কে তো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তার বাবার কাছে প্রস্তাব গিয়েছিল, বাবা মায়ের ইচ্ছেতে নিলয় এখানে আসে। সেক্ষেত্রে বিচারের অঙ্ক মেলে না। তাছাড়া দিবাকরকে গ্রেফতার করা হয় রিসর্টে অতিথিদের আগমনের দ্বিতীয় রাতে, এবং তারপরেই তাদের পণবন্দী করা হয়। কিন্তু তাদের শহর থেকে ডেকে আনার কারণ স্পষ্ট হয় না। যদি এমনটাই হয় যে দিবাকরের দল ‘যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া’ মন্ত্রে বিশ্বাসী, তাহলে মাত্র এই কয়েকজন কেন? সভ্য সমাজে তো ভদ্রবেশী দুষ্কৃতীর অভাব নেই। আর এই ঘটনার পরে ফক্সহোল এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে, তাহলে একটাই যেখানে সুযোগ, সেখানে শাস্তি দেওয়ার জন্য মাত্র এই কয়েকটা মুখ কেন? আর সবশেষে বলা যায় ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে দিবাকর ও স্বরূপের বোঝাপড়া আর একটু পরিষ্কারভাবে দেখালে সাধারণ দর্শকদের পক্ষে বোঝা সহজ হতো।
আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
অভিনয়ের ক্ষেত্রে সকলেই যথাযথ। তবে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় কমলেশ্বর ও শিলাজিতের কথা। দুজনের কাউকেই চরিত্র থেকে আলাদা করা যায় না। অনন্যার অভিনয় আলাদাভাবে মনে দাগ কাটে। দেবদূত অভিজ্ঞ অভিনেতা, সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। মৌমিতার অভিনয়ে একটা রুক্ষতা আছে, যেটা তাকে অন্য অভিনেতাদের থেকে আলাদা করে। মায়ার মূল সামাজিক স্তর আর তার কাজের জায়গায় স্তরের ফারাক স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে তুলে ধরেছেন মৌমিতা, নতুন কোনও অভিনেতার পক্ষে যা যথেষ্ট কঠিন। রোজার অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য, ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন অধ্যাপিকা হিসেবে মানানসই হয়ে উঠেছেন তিনি। ছোট চরিত্রে সুব্রতকে ভালো লাগে।
শিবাশিস বন্দোপাধ্যায়ের আবহ মনে রাখার মতো। আদিবাসী সুরে ‘জীবন হায় রে’ গানটি প্রতিবার পর্দায় এক অশ্রুত চাবুকের অনুভূতি এনে দেয়। টুবানের চিত্রগ্রহণ প্রশংসার দাবি রাখে। ঝাড়গ্রাম সংলগ্ন এলাকার রুক্ষতাকে সিরিজ়ে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। গতানুগতিক সিরিজ় ও ছবির গল্প থেকে বেরিয়ে এসে দুই ভিন্ন সামাজিক স্তরকে সামনে রেখে এমন একটি আপাত নিষ্ঠুর গল্প উপহার দেওয়ার জন্য কমলেশ্বরকে ধন্যবাদ।
ঘটনার প্রেক্ষাপট আর প্রাসঙ্গিকতার বিচারে ‘রক্তপলাশ’ এক সামাজিক বার্তা দিয়ে যায় যাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা এই সাজানো, শহুরে সভ্যতায় বসেও কঠিন। মনের গভীরে কোথাও আমরা প্রত্যেকে প্রতিনিয়ত করে চলা অপরাধের কথা জানি। তবু হিসেব থেকে যায়। দিকে দিকে মানুষ ফুঁসছে, তারা বদলা নেবে। আদিম অরণ্য ক্ষমা করে না।