বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’, অর্থাৎ শুরু সেই দয়া পরবেশ ক্ষমাশীল খোদাতলার স্মরণ করে। ইসলাম মতে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কোনও শুভ কাজের শুরুয়াৎ, এমনকি খাদ্যগ্রহণের সময়ও নিষ্ঠাভরে খোদাকে স্মরণ করা হয় ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণে, নিয়মিত। আবার রোজকার ব্যবহারিক জীবনে কোনও কাজ শুরুতেই বিফল হলে বলা হয় বিসমিল্লায় দ। অর্থাৎ সূচনাতেই গলদ।
যতখানি সময় সোশাল মিডিয়াতে ব্যয় করেছি অদ্যাবধি, তার কিয়দাংশ অনন্য উপহার হয়ে ফিরে আসছে ইদানীং। এমনই এক উপহার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী অসীম মৌলিক। আমার পাশের জেলা নদীয়ার মানুষ, বর্তমানে কলকাতাবাসী। চাক্ষুস আলাপ নেই এখনও, তবে ফোনালাপ হয়েছে বারকয়েক। তাঁর কন্ঠের উষ্ণতায় অনুভব করেছি তিনি আমায় স্নেহ করেন বড় দাদার মত। ব্যক্তিজীবনে আমি পরিবারের প্রথম সন্তান, বড়দাদা বা বড়দিদির অভাব এবং তাদের সান্নিধ্যের একটা নিভৃত আকাঙ্খা নিরন্তর কাজ করে আমার অন্তরে। তাই বড়দা তুল্য অসীমবাবুর উষ্ণতার আঁচে হৃদয়ে মনকেমন করা ভালোলাগা বাসা বাঁধে, বুঝি আমি। অসীমবাবু বেনারস ভ্রমণের কথা শুনে যখন বলেন, “ভাই জাহির, বেনারস কিন্তু শুধু বাবা বিশ্বনাথের নয়, বেনারস বিসমিল্লাহ খানেরও, আমার ইচ্ছে তুমি একবার ওনার বাসায় যাও, শ্রদ্ধা জানিয়ে এসো, তোমার কলমে ওনার প্রতি তোমার অনুভূতি আমি অনুধাবন করতে আগ্রহী,” বিশ্বাস করুন, আমি কুন্ঠিত হয়ে পড়ি এমন মরমি প্রত্যাশায়।
আমার যে খানকতক শুভাকাঙ্খী পাঠকবন্ধু রয়েছেন, তাঁরাও জেনে গেছেন ইত্যবসরে যে আমি মূলত পথিক, পথ চলতেই ভালোবাসি। বেনারসের গলি, তস্য গলি এবং অলিগলি পদ সঞ্চালনে ঘোরার চক্করেই আমি আর বন্ধু শিবাজির বেনারস যাত্রার পরিকল্পনা। এটা জেনেই অসীমবাবুর আন্তরিক ফরমায়েস আর আমার উচ্চচাপের সূত্রপাত। এমন নয় যে বিসমিল্লাহ খানের নাম শুনিনি ইতিপূর্বে। শুনেছিলাম, ধরে রাখতে পারিনি আসলে। পড়েছিলাম বিশ্বনাথ মন্দিরের কোনও একটি অনুষ্ঠানের সূচনা খান সাহেবের সানাই পরিবেশন বিনা ছিল অসম্ভব অথবা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্যায়, তাঁরই সানাইয়ের মূর্ত মূর্ছনায়। শুধু সেই জানাটুকু ভর করে দাদাকে কথা দিলাম, যদিও রাগ, সঙ্গীত ও সানাইয়ের সমঝদার শ্রোতা নই আমি, তবুও একবার চোখ মেলে আসব সেই উর্বর অঙ্গনে যেথায় একদা হুটোপুটি করেছেন ভারতরত্ন বিসমিল্লাহ।
খেল দিখা সকোগে না?
২৮ জানুয়ারী সকাল দশটা নাগাদ গঙ্গাস্নান সেরে রওয়ানা দিলাম ওস্তাদজির ভিটের পানে। নয়াসড়ক থেকে যে রাস্তাটি চলেছে সানাই সম্রাটের বাড়ির পথে, তার নাম ‘ভারতরত্ন ওস্তাদ বিসমিল্লা খান মার্গ’। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে বোঝা গেল ঘোরাঘুরির সময় বহুবার এ রাস্তার আশেপাশে এসেছি, শুধু বোঝা যায়নি এ অঞ্চলেই তাঁর আবাস। এলাকাটি দশাশ্বমেধ ঘাট হতে সর্বাধিক মিনিট পনেরোর হাঁটাপথ। রাস্তা হতে একটি গলি ধরে কিছুটা এগিয়েই এক দুধসাদা দোতলা বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত, সন্নিবিষ্ট লেটারবক্স ওস্তাদ নায়ের হুসেন খানের নামে, ঠিকানা: সি কে ৪৬/৬২, সারাই হারাহা, বারাণসী। ছবি তোলার দ্বিধায় যখন দ্বিধান্বিত, এক কিশোর দরজা খুলে আহ্বান জানাল। উন্মুক্ততার আলোয় নজরে এলো ঘরের দেওয়াল জুড়ে নানান আলোকচিত্রের প্রদর্শনী। এক ভদ্রলোক ব্যস্ত রয়েছেন সেগুলির যত্নে। পরবর্তী চল্লিশ মিনিট এমনই নিরুচ্চার অভিজ্ঞতার মগ্ন মূহূর্ত, যা সহসা আসে না জীবনাকাশে।
তৈরি হল না যে ঘরে বাইরে
জুতো পায়ে প্রবেশের অনুমতি থাকলেও, মনের সায় ছিল না। তাই জুতো রইল বাইরে। অদ্ভূত এক অজ্ঞাত আবেশে প্রবেশ করলাম ওস্তাদজির বৈঠকখানার অন্দরে যার প্রতিটি অংশে এই ভারতরত্নের স্পর্শময়তার অদৃশ্য অস্ত্বিত্ব। পুরনো একটি চৌকি, একটি দিন-যাওয়া সোফা, খান দুই গদি আঁটা চেয়ার আর ঘরময় ফ্রেমবন্দী ওস্তাদজির জীবনবোধের নানান সোনালি সফর। আলাপ হল তাঁর নাতি ওস্তাদ নাসির আব্বাস খানের সাথে। আমার মা বলেন, বাচনভঙ্গি আর তার লয়েই ধরা পড়ে পারিবারিক শিক্ষাদীক্ষা ও রুচিশীলতা। আব্বাসজির কথামালায় সেই ঐতিহ্যেরই আবহমান তরঙ্গ।
বাবা পয়গম্বর খান ও মা মিঠান দ্বিতীয় সন্তানকে প্রথম ডেকেছিলেন আমিরুদ্দিন নামে। কিন্তু পিতামহ নবজাতককে দেখে উচ্চারণ করলেন ‘বিসমিল্লাহ’। আর এইভাবেই আমিরুদ্দিন হয়ে গেলেন বিসমিল্লাহ খান। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বিহারের ডুমরাও রাজ্যের রাজ সঙ্গীতজ্ঞ। সঙ্গীতগুরু প্রয়াত আলী বকস্ বিলায়াতু, সম্পর্কে ওস্তাদজির মামা, যিনি ছিলেন বিশ্বনাথ মন্দিরের প্রখ্যাত সানাই বাদক। প্রাত্যহিক জীবনে একজন অত্যন্ত ধার্মিক শিয়া মুসলমান হলেও বিসমিল্লাহ খান জ্ঞান ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীরও আরাধনা করতেন সুনিপুন নিষ্ঠায়।
যে মৃত্যু আজও রহস্য
বিসমিল্লাহর সাঙ্গীতিক নিষ্ঠা, জীবনবোধ ছিল বহতা গঙ্গার মতোই সাবলীল, পবিত্র। তাঁর সঙ্গীত ও বেনারসী গঙ্গা যেন একে অপরের পরিপূরক, আত্মজ। বেনারসের অলিগলি, আকাশ বাতাস, ধূলিকণা, পথ প্রান্তর, সবই ছিল ওস্তাদজির বড় আপনজন। রামনগর রাজবাড়ির দিগন্ত থেকে কখনও বা মেঘ জমছে আকাশে, একটু-একটু করে কালোয় ছেয়ে যাচ্ছে বেনারসের নীলাকাশ। গঙ্গার ওপর দিয়ে বইছে আসন্ন বৃষ্টির পূর্বাভাস, নদীতে ভাসমান পল্টন ব্রীজে লাগল দোলা সেই প্রবাহী পবনের মৃদু সংঘাতে। অনুভবে ওস্তাদেরও মন ছুঁয়ে গেল মেঘবালিকার আকুতি, তার ঝরে পড়ার অভিপ্রায়ে বিসমিল্লাহর হৃদয় হতেও হয়ত উৎসারিত হল সুর, উঠল ঝড় তাঁর সঙ্গীত মননে । মেঘমল্লারের সুর মূর্ছনায় মুখরিত হতে থাকল তাঁর প্রিয় বেনারস। নিশি কালো মেঘ কখন যেন তরল হয়ে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারায় ঝরতে থাকল ধরণীর বুকে। স্নিগ্ধ শীতল হল ওস্তাদদির বাসভূমি। একদিকে প্রকৃতির খেয়ালী সুর, গঙ্গার সাথে বৃষ্টির জলকেলির সুখশ্রাব্য ধ্বনি, অন্যদিকে সানাইয়ের হৃদয়লালিত সঙ্গত একাত্ম হয়ে সৃষ্টি করল এক অদ্ভূত সুরেলা জগৎ, যাঁর অধীশ্বর বিসমিল্লাহ নিজে, যাঁর ভিটেতে আমরা দুই বঙ্গবাসী, আত্মবিভোর দাঁড়িয়ে।
যে জন থাকে মাঝখানে
সানাইকে ভারত তথা বিশ্বমঞ্চের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগতের কৌলিন্যে এক অমূল্য বাদ্যযন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার একক কারিগর বিসমিল্লাহ খান। ১৯৩৭ সালে কলকাতা অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সানাই বাজিয়ে তিনি একে ভারতীয় সঙ্গীতের মূল দরবারে দেন প্রতিষ্ঠা। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭, স্বাধীনতার স্বাদে উদ্বেল ভারতবাসীর সামনে লালকেল্লায় সানাই বাদনের বিরল কৃতিত্ব তাঁরই। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০, সেই লালকেল্লাতেই অনুষ্ঠিত ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁর অন্তরের মাধুরী ঢেলে রাগ কাফি পরিবেশন, মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করেছিল তামাম স্বাধীন ভারতসন্তানকে। তাঁর সুযোগ্যতার নিরিখে সানাই এবং ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান প্রায় সমার্থক। দূরদর্শনের স্বাধীনতা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সেথায় তাঁর সানাইয়ের সঙ্গত এক অবিচ্ছেদ্য শ্রুতিময়তার বৈভব। লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরপরই দূরদর্শনে সানাইগুরুর মেহফিল সম্প্রচারিত হত সরাসরি জওহরলাল নেহেরুর সময় হতেই তরঙ্গিত এই রাগ পরম্পরা।
আফগানিস্তান, ইউরোপ, ইরান, ইরাক, কানাডা, পশ্চিম আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, হংকং-সহ পৃথিবীর নানান দেশ আন্দোলিত হয়েছে ওস্তাদ বিসমিল্লাহর সাঙ্গীতিক পরশে। ইরান তাঁকে প্রদান করেছে সে দেশের সঙ্গীত বিষয়ক শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। নিজ দেশ আপন করে নিয়েছে তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ হিসেবে। এছাড়াও দেশবিদেশ থেকে পেয়েছেন অজস্র সম্মান। তাঁর বাঙালি যোগও আছে বৈকি, কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘরে।
এত সুনাম ও খ্যাতি অর্জন সত্ত্বেও অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বিসমিল্লাহ। সবসময়ই রইতেন বারাণসীর পুরোনো পৃথিবীর অলিন্দে। সাইকেল রিকশাই ছিল তাঁর চলাচলের মূল বাহন। অত্যন্ত অন্তর্মুখী, বিনম্র এই সঙ্গীতগুরু বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত শ্রবণের বিষয়, দেখার বা দেখাবার নয়।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
সে কথায় বিশ্বাস রাখেন তাঁর বর্তমান প্রজন্মও। আব্বাসজীর গলায়ও আতিথেয়তার উষ্ণতা। চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। আমাদের অসম্মতিতে বললেন, দাদাজি বলতেন, ‘আগর মেহমান আয়ে ঘর মে তো উনহে বৈঠনে কা জগহ দো, ঔর কুছ নেহি মিলে তো থোড়া পিনে কা পানি দো, তুমহে ঔর মেহমান দোনো কো হি এক সকুন মিলেগা।’
আমাদের জন্য চা নিয়ে এলেন আব্বাসজীর পুত্র রামিস হাসান। কথা চলতে থাকে আর আমরা বিহ্বল হতে থাকি। এতবড় মানুষ, এতবড় ঐতিহ্যের অধিকারী এক ভিটেয় বসে রয়েছি অচঞ্চল, ভাবতেই শিহরিত হচ্ছি। নাসির জানালেন, তাঁর বাবা সানাই বাজাতেন, পরিবেশন করেন তিনি নিজেও, আমাদের অনুরোধও জানালেন কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নানান উৎসব অনুষ্ঠান বা বিয়ে শাদিতে তাঁদের আমন্ত্রণের জন্য, কেননা তাঁর ইচ্ছা যে সানাইয়ের সুর তাঁর দাদাজির হাত ধরে তাঁদের পরিবারকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদা, সেই সুরধারা প্রবাহিত হোক আগামী প্রজন্মের জীবনতরীতেও।
সবচেয়ে গভীর মুহূর্ত ঘনাল সেই সময়, যখন আমি প্রস্তাব রাখলাম ওস্তাদজির পারিবারিক জীবন নিয়ে প্রকাশিত হোক ছোট একটি পুস্তিকা এবং তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতেই গড়ে উঠুক অভিনব এক পারিবারিক সংগ্রহাগার। প্রয়োজনে আমরাও এব্যাপারে কায়িক শ্রমদানে উৎসাহী বলার সময়ই নিকটবর্তী মসজিদ হতে ভেসে এল যোহরের আজান। অদ্ভূত চাঞ্চল্যের খেলা তখন নাসির আব্বাস খানের মুখমন্ডলে। আমার দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাতচিত কি ওয়ক্ত যব আজান কি আওয়াজ সুনাই দেতি হ্যায়, সমঝ লো খোদা ভি ইয়হি চাহতে হ্যায়।’
শব্দ যখন ছবি আঁকে
২১ আগষ্ট ২০০৬, বিসমিল্লাহ খান ইহলোক ত্যাগ করেন বরাণসীর পুণ্যভূমিতেই। গঙ্গা অন্তপ্রাণ ওস্তাদজিকে সমাহিত করা হয় পুরনো বারাণসীর কবরস্থানে, এক নিম গাছের ছায়াময়তায়। সঙ্গে দেওয়া হয় একটি সানাই, স্ত্রীর মূত্যুর পর যে সানাইকে তিনি তাঁর ‘বেগম’ বলে মানতেন। তাঁর নশ্বর দেহ বিলীন হয়ে গেছে প্রায় একদশক, তবুও তিনি ভাস্বর হয়ে রয়েছেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক উজ্বল উদাহরণ স্বরূপ জনমানসের মনে, মননে, আজও। বেনারসে যতদিন রইবেন বিশ্বনাথ, ততদিন রইবেন বিসমিল্লাহ আর রইবে তাঁর বিশ্বাস, “Even if the world ends, the music will still survive।”
ছবি: লেখক