প্রকৃতির জলছবি অন্যতম প্রাপ্তি
ছবি: প্রাপ্তি
পরিচালনা: অনুরাগ পতি
অভিনয়ে: সমদর্শী দত্ত, প্রত্যুষা রোজলিন, দেবদূত ঘোষ, অনন্যা পাল ভট্টাচার্য
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
মানুষ তার দীর্ঘ জীবনকালে বহু সম্পর্কে জড়ায়, তার কিছু মনে রয়ে যায়, কিছু আবার তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। তবে অনেক সময় বিশেষ কেউ থেকে যায় হৃদয়ের গহীনে। যাকে বছরের পর বছর না দেখলেও বিস্মরণ হয় না, মনে হয় মানুষটা তো আমার খুব আপন। না হয় দূরেই আছে, তবু আমি যেমন তার কথা ভাবি, হয়তো সেও ভাবে। কথায় বলে তুমি যাকে ভাবো সেও আড়ালে অবসরে তোমাকে ভাববেই। সেই আড়ালে থাকা মানুষটার জন্য কেমন তুচ্ছ হয়ে যায় বাস্তবের সমাজ, সংসার, সমস্ত পারিপার্শ্বিক।
সেই বিশেষ একজনের প্রতীক্ষাতেই কেটে যায় বিহার প্রবাসী সোমার (প্রত্যুষা) দিনরাত। আশির দশকের কোনও এক শুভ লগ্নে সুনন্দর (দেবদূত) সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর বাংলা ছেড়ে বিহারে পাড়ি দিতে হয় তাকে। সবুজ শ্যামল চেনা বাংলাকে ছেড়ে সোমাকে ঘর বাঁধতে হয় রুক্ষ, শুষ্ক ধুলো ওড়া লালচে মালভূমির একপ্রান্তে। স্বামী সুনন্দ ভালো মানুষ। তবু সোমার হৃদয় যার কাছে বাঁধা তাকে বহু চিঠি লিখেও উত্তর আসে না কখনওই।
একদিন হঠাৎই সেই মানুষটা সশরীরে এসে হাজির হয় সোমার দরজায়। কর্মসূত্রে সুনন্দ সেদিনই বাড়ি নেই। সুনন্দ নেই শুনে সেদিনই ফিরে যেতে চায় অতিথি। কিন্তু যে বেদেদার (সমদর্শী) একটা চিঠির অপেক্ষায় সোমা দিনের পর দিন প্রহর গুনেছে সেই মানুষটাকে সামনে পেয়ে তার প্রতিক্রিয়া কী? একদিন সে সোমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সোমা তো জানে বেদেদা তাকে ভুলতে পারে না। পাহাড় সমান অভিমান নিয়েও হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানায় সোমা।
আরও পড়ুন: আইনি পথে হাঁটার হুঁশিয়ারি দিলেন যশ
আপাতদৃষ্টিতে ত্রিভুজের মতো এ গল্পে তিন মূল চরিত্র সোমা, সুনন্দ ও বেদেদা হলেও কাহিনীর আপাত অদৃশ্য চতুর্থ কোণ হলো প্রকৃতি। দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকৃতি কতটা ছাপ ফেলে তা শহুরে জীবনে খুব একটা বোঝা না গেলেও শান্ত, নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবনে বোঝা যায় বইকি। অন্তত সে যুগে যেত। আজকের দিনে হলে হয়তো এ গল্পই গড়ে উঠত না, কারণ ইন্টারনেটের সর্বব্যাপী থাবায় কেউই আর লুকিয়ে থাকতে পারে না।
সে ছিল চিঠির যুগ। একটা চিঠিই তখন হয়ে উঠতো লেখকের মনের আয়না। তবে সব চিঠির তো উত্তর আসে না। হয়তো উত্তর হয়ও না। তাই একদিকে সোমার প্রতীক্ষা আর অন্যদিকে ছোটুয়ার অপেক্ষা কোথাও গিয়ে যেন মিলে যায়। তবু কিছু অপেক্ষার শেষ না হওয়াই ভালো বোধহয়। যেমন করে সোমার মনে হয় সব চিঠি খুলতে নেই।
আরও পড়ুন: ১২ বছর পর বাংলা ছবিতে বরখা
বিষয়ের বিচারে এ গল্প তেমন সিনেম্যাটিক নয়। এ গল্প পাঠ করার, অনুভব করার। বুদ্ধদেব গুহর গল্পে প্রকৃতি এক বিশেষ চরিত্র হয়ে ধরা দেয় চিরকাল। এই ছবিতে সেই প্রকৃতিকে পাওয়া গেল বিরাটভাবে। ভারী সুন্দরভাবে ক্যামেরায় ধরা পড়েছে শিমুলতলা সংলগ্ন এলাকার মাঠ ঘাট মালভূমি কিংবা জলা জমি। খুব কম ছবিতে বৃষ্টিকে এত সময় নিয়ে ধরা হয়। অঝোর বৃষ্টিতে ঢেকে যাওয়া পথ প্রান্তরকে খুব যত্নে ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে ছবিতে। তুমুল বর্ষণে এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে সমদর্শী ও প্রত্যুষার হাত ধরার দৃশ্য মন ছুঁয়ে যায়।
সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যামেরায়, অনুরাগের পরিচালনায় যেভাবে পর্দায় প্রকৃতি উঠে এসেছে তার তুলনা সাম্প্রতিককালের ছবিতে কমই পাওয়া যাবে। বুদ্ধদেবের কাহিনীকে চিত্রায়িত করার সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্যই প্রকৃতি। সেই জায়গায় সফল পরিচালক। তবে ছবির গল্প তেমনভাবে দর্শককে বসিয়ে রাখতে পারে না। রেখা ভরদ্বাজের গলায় গানটি উপভোগ্য হয়ে উঠলেও কিছু জায়গায় উচ্চারণ কানে লাগে।
কাহিনীর প্রেক্ষাপট সুন্দর হওয়া সত্বেও বেশ কিছু জায়গায় অভিনয় কিছুটা বাধার সৃষ্টি করে। দেবদূত ও সমদর্শী নিজেদের দায়িত্ব পালন করলেও প্রত্যুষা তাঁর চরিত্রে তেমন মানানসই হয়ে উঠতে পারেননি। ছোটুয়ার মায়ের ভূমিকায় অনন্যাকে ভালো লেগেছে। ছোট্ট ছোটুয়ার অভিনয় চমকে দেওয়ার মতো। কিছু জায়গায় সংলাপের গতি সেই জায়গার পরিস্থিতির তুলনায় বেমানান লাগে। তবে আশির দশকের প্রেক্ষাপটে সোমা সুনন্দর নিটোল ঘরোয়া সংসার যাপন দেখতে ভালো লাগে।
এ ছবির অন্যতম প্রাপ্তি প্রকৃতির জলছবি। তবে অন্যান্য বিষয়ে আর একটু সতর্ক হলে ভবিষ্যতে অনুরাগের পরিচালনায় আরও ভালো ছবির আশা থাকবে।