যেটা নেই সেটা হলো থ্রিল

ছবি: হত্যাপুরী

পরিচালনা: সন্দীপ রায়

অভিনয়ে: ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, অভিজিৎ গুহ, আয়ুশ দাস, পরান বন্দোপাধ্যায়, সাহেব চট্টোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, ভরত কল, সন্দীপ চক্রবর্তী, অসীম রায়চৌধুরী, সুপ্রিয় দত্ত

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆

‘অলিগলি চলি রাম
ফুটপাথে ধুমধাম
কালি দিয়ে চুনকাম…’

‘একটু ধুমধাম হলে খুশিই হতুম মশাই!’

সেই ধুমধামেরই কিঞ্চিৎ অভাব দেখা গেল নতুন ফেলুদা টিমের ‘হত্যাপুরী’ অভিযানে। ছবি ঘোষণার দিন থেকেই ফেলুদা চরিত্রে নতুন অভিনেতার নির্বাচন নিয়ে বরাবরের মতোই তর্কবিতর্ক এগিয়েছিল জোরকদমে। যদিও গল্প সকলের জানা তবু সময়কাল বদলের কারণে একটু ভূমিকা করে নেওয়াই যায়।

গল্পের প্রেক্ষাপট ২০১৯-এর পুরী। তাই সেখানে লোডশেডিং এবং স্কাইল্যাব থাকবে না জানা কথা। রইল না লিমেরিক, এমনকি নেই পুরী এক্সপ্রেসও। একেবারে জটায়ুর সবুজ চারচাকা নিয়েই পুরী রওনা দিল থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। সেখানে পৌঁছে একে-একে আলাপ হলো ডিজি সেন, বিলাস মজুমদার, মহেশ হিঙ্গোরানি, লক্ষণ ভট্টাচার্য ও নিশীথ বোসের সঙ্গে। তারপর ভাগ্যগণনা, পুঁথি চুরি, ম্যানেজার নিখোঁজ ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে ছবির কাহিনী। সন্দীপ যেমন চেনা ছকে সরলরেখায় গল্প বলতে ভালোবাসেন এ ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। 



ফেলুদার গল্প একদিকে যেমন রহস্যের তেমনই অ্যাডভেঞ্চারেরও। কাজেই জায়গার বর্ণনা, প্রয়োজনীয় তথ্য এসবের পাশাপাশি বরাবরই তাতে বেশ কিছুটা রোমাঞ্চ জড়িয়ে থাকে। ঘটনার পরতে-পরতে জড়ানো থাকে নতুন কিছু জানার আগ্রহ, আচমকা কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা। সিনেমার ফর্মে গল্প বলতে গেলে তার অনেকটাই বদলে যাবে এ জানা কথা। তাও শেষমেশ কিছু ‘তবু’ থেকে যায়।

‘হত্যাপুরী’ ফেলুদা সিরিজ়ের অন্যতম জনপ্রিয় ও রোমাঞ্চকর কাহিনী। সেই সঙ্গে একে অ্যাকশনধর্মী গল্পও বলা যায়। শুরুতে ‘ডুংরুর কথা’ এ কাহিনীর অন্যতম আকর্ষণ। সেখানে ডুংরুর গান আছে, বাজনা আছে, তার ছাগল চরানোর মতো ভুট্টা ক্ষেত আছে, শান্ত প্রকৃতি আছে, আর তারপর আছে এক আকাশভাঙা দুর্ঘটনা। এইসব কিছুই এল না ছবিতে। হয়তো বা সময় বাঁচাতেই এমন একটি সাংঘাতিক সিনেম্যাটিক অধ্যায়কে প্রায় কেটেছেঁটে নেই করে দেওয়া হলো। ২০১৯-এর কাহিনী যতটা ঝকঝকে হওয়া উচিত ছিল, তেমনটা হলো না। কাহিনীর সময়কালকে এগিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় বদল যদি স্মার্টফোন হয়, তাহলে জটায়ুর ধুতির ক্ষেত্রেও সেটা ভাবার দরকার ছিল। পারিপার্শ্বিকতা মাথায় রেখে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেই পারতেন তিনি। 

আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার

‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ জটায়ু বলেছিলেন, যেটা চাই সেটা হলো থ্রিল। সেই রেশ ধরে বলতে হয়, ‘হত্যাপুরী’ ছবিতে যেটা নেই সেটা হলো থ্রিল। ছবির আগাগোড়া কোথাওই সেই গতি বা এনার্জি পাওয়া গেল না যেটা ফেলুদা ছবিতে বরাবর দর্শক পেয়ে এসেছেন। ‘সোনার কেল্লা’ বা ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ তো বটেই, পরবর্তীকালে সন্দীপের ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘টিনটোরেটর যীশু’তেও সেই এনার্জি ভরপুর ছিল। আগাগোড়া এই ছবির দৃশ্যপট বেশ ফিকে ও গতিহীন। উত্তেজনা বলে কোনওকিছুই যেন গোটা ছবিতে কারও মধ্যেই নেই। এমনকি ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যেও কোথাও হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার মতো মোচড় নেই, দর্শককে চমকে দেওয়ার মতো জাম্পকাট নেই। অথচ সত্যজিৎ রায়ের মূল গল্পে ওই ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য কী সাংঘাতিকভাবে পাঠককে টেনে রাখে! ক্লাইম্যাক্স পরবর্তী দৃশ্যে যেখানে ভুজঙ্গ নিবাসে বসে ফেলুদা সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে, সেই দৃশ্য দেখতে বেশ একঘেয়ে লাগে। দু’ঘণ্টার ছবিকেও মনে হয় বড্ড বড়। সব উপকরণ এবং মশলা দেওয়ার পরেও যদি নুনটুকু কম হয় তবে রান্নায় স্বাদ পাওয়া যায় না। সেই নুনেরই যেন অভাব থেকে গেল ‘হত্যাপুরী’তে।

প্রথমবার ফেলু-তোপসে-জটায়ুর ডিজি সেনের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তার পুঁথির সংগ্রহ দেখা। মূল কাহিনী অনুযায়ী সেই সময় নিশীথ বোসের ঘরের একাংশ ফেলুদাদের নজরে আসে। কিন্তু কোনও তদন্তের কারণে যখন ফেলুদা সেখানে যায়নি তখন নিশীথবাবু যেচে নিজের ঘর খুলে দেখালেন কেন তা বোঝা গেল না। আবার হাতের কাছে ইন্টারনেট থাকতেও ডায়াপিড নিয়ে ফেলুদার এত চিন্তার কী কারণ সেটাও বোঝা গেল না।

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফেলুদার আঙ্গিক বদলাবে, এটা এমন কিছু অবাক করা ঘটনা নয়। কিন্তু আসল ফেলুই যদি বদলে যায় তাহলে তাকে মেনে নেওয়া কঠিন হয় বইকি! ফেলুদার ব্যক্তিত্ব, তার হাঁটাচলা, কথা বলা, তাকানো, হাসি, অর্থাৎ তার সমস্ত শরীরী উপস্থিতির কোনওটাই হালকা নয়। সত্যজিতের ফেলু যে আর পাঁচটা পথচলতি সাধারণ লোকের থেকে অনেকটাই আলাদা, সেটা তার চেহারায় না হলেও, হাবেভাবে স্পষ্ট বোঝা যাবে এমনটাই কাম্য। বই হোক বা ছবি, ফেলুদাকে চেনার বা দেখার মাইলফলক এগুলোই। তারপর আসে তার মগজাস্ত্রের কথা। কিন্তু এ ছবিতে কোথাওই যেন শরীরী ভাষা দিয়েও ফেলুদাকে ছুঁতে পারলেন না ইন্দ্রনীল। কোনও সন্দেহ নেই, তিনি যথেষ্ট ভালো অভিনেতা। এর আগে কিরীটি রায় বা হানি আলকাদির চরিত্রে ইন্দ্রনীলকে দেখা গেছে। সেই চারিত্রিক ধার পাওয়া গেল না তাঁর ফেলু অবতারে। পাওয়া গেল না মগজাস্ত্রকেও। সত্যজিৎ ফেলুদাকে বিশেষ কেউ হিসেবে তৈরি করেননি। ফেলু আর যাই হোক প্রখর রুদ্রের মতো সুপারহিরো নয়। তবু ফেলুদা মানে বিশেষ কেউ, পর্দায় তার উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা থাকে, এমনটাই হয়ে এসেছে। এই প্রথম সেটার অভাববোধ হলো। ইন্দ্রনীল চেষ্টা করেছেন নিশ্চয়ই, তবে ফেলু হয়ে উঠতে তাঁর আরও সময় লাগবে। 

জমল না ফেলু-তোপসে-জটায়ুর রসায়নও। চরিত্রের অত্যধিক চাপের কারণেই হয়তো কোথাও তেমন খোলামেলাভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারলেন না জটায়ুরূপী অভিজিৎ। জটায়ুর সহজ সারল্যের হালকা মুহূর্তগুলো মজা দিল না সেভাবে। তোপসের চরিত্রে আয়ুশ চেষ্টা করেছেন বলা যায়। তিনজনের একসঙ্গে থাকার দৃশ্যের সেই আনন্দের মুহূর্ত কিংবা টানটান সাসপেন্স কোনওটাই জমে উঠল না। 



দুর্গাগতির চরিত্রে বিশেষ কিছু করার সুযোগ পাননি পরান। তাঁকে স্বমহিমায় পাওয়া গেল না এই ছবিতে। বিলাসের ভূমিকায় সাহেব বেশ ভালো এবং সপ্রতিভ। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে বা শেষে ঘটনা বিশ্লেষণের সময় প্রত্যাশিতভাবেই জ্বলে উঠলেন তিনি, যা প্রশংসার দাবি রাখে। লক্ষণের চরিত্রে শুভাশিস বেশ ভালো, তবে ছবির দুর্বল নির্মাণের শিকার হয়েছেন তিনিও। 

গোটা ছবি জুড়ে সেই চেনা ফেলুদা মেজাজ পাওয়া না যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ ফেলুদা থিমের অনুপস্থিতি। আগাগোড়া সমস্ত ছবিতেই যে সুর শুনতে ফেলু অনুরাগীরা অভ্যস্ত এখানে কেন তা বাদ গেল জানা নেই। যে কারণে কোথাওই সেই বেড়ানো এবং অ্যাডভেঞ্চারের মেজাজটা তৈরি হলো না। আনকোরা নতুন টিম নিয়ে ফেলু কাহিনীর নির্মাণ এবারের শীতের মতোই তেমন জমে উঠতে পারল না। তবে আগামীদিনে সময় দিলে হয়তো এরাই উপহার দেবেন এক ঝকঝকে ছবি, এমন আশা করাই যায়। তবু বড়দিনের ছুটির মরশুমে একবার দেখাই যায় ‘হত্যাপুরী’।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *