একেবারে ব্যতিক্রমী বিষয়, তবুও কিছু খটকা রয়েই গেল
ছবি: লাভ আজ কাল পরশু
পরিচালনা: প্রতিম ডি গুপ্ত
অভিনয়ে: অর্জুন চক্রবর্তী, মধুমিতা সরকার, পাওলি দাম, অভিজিৎ গুহ, অনিন্দিতা বসু, অনির্বাণ চক্রবর্তী
RBN রেটিং: ৩/৫
ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ এলেই চারিদিকে বেশ একটা প্রেম-প্রেম ভাব তৈরী হয়। মুখে অবশ্য অনেকেই বলেন, প্রেমের জন্য আলাদা কোনও দিন হয় না। তা সত্বেও প্রেম দিবসটা আলাদা ভাবে উদযাপন করতে ভালোই লাগে। তাই এই প্রেমের মরশুমেই প্রতিম নিয়ে এসেছেন তাঁর নতুন ছবি ‘লাভ আজ কাল পরশু’। তবে একেবারে নিরামিষ প্রেমের গল্প যে প্রতিম বলবেন না, সেটা ট্রেলার দেখেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। বেশ পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল তাতে।
একেবারে ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে ছবি করেছেন প্রতিম। হিপনোথেরাপি বা সম্মোহনের মতো জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয়কে অত্যন্ত সরলভাবে দেখানোর জন্য পরিচালককে কুর্নিশ। একই মানুষের ভিন্ন নামের আড়ালে বারবার দেখা হওয়া প্রেমে পড়া এবং অবশেষে প্রেমের আদিম উষ্ণতায় ভেসে যাওয়া নিয়ে এই ছবির গল্প। পুরোটাই ঘটছে সুদৃশ্য হোটেলের সুসজ্জিত ঘরে, কফিশপে, কখনও বা পুলের ধারে। কিন্তু কিভাবে? এখানেই আসল খেলা।
সম্মোহনের মাধ্যমে নিজের রিয়েলিটি শো-কে আরও বাস্তবধর্মী বানাতে দুজন মানুষকে দিনের পর দিন সম্মোহিত করে রাখছেন কল্কি মৈত্র (পাওলি)। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আধুনিক পদ্ধতিতে মগজধোলাই। নিত্যনতুন দিনে, নিত্যনতুন রূপে অভিরূপ-তৃপ্তি, অভিজিৎ-তৃণা অথবা অভিষেক-তাপসী এভাবেই প্রেমে পড়ছে নিজেদের অজান্তেই। বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র ছিন্ন করার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক। বারংবার তাদের জানানো হয়, বাইরে বনধের কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ, তাই হোটেলে দিনযাপনই একমাত্র উপায়।
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
খটকার শুরু এখানেই। এত বড় একটা হোটেলের ঘরে টেলিভিশন নেই? যেখানে আজকের যুগে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের ঘটনাও টেলিভিশনের মাধ্যমে লোকজন জানতে পারে, সেখানে চরিত্রদের মনে এই প্রশ্নের উদয় হলো না কেন?
খটকা দুই: সম্মোহিত হয়ে থাকা চরিত্রদের প্রথম দর্শনেই এত চৌখস বার্তালাপ? ঠিক যেন মুখস্থ সংলাপ ঝরঝর করে আউড়ে যাচ্ছেন তারা। একে অপরকে ইমপ্রেস করাটাই যেন তাদের মূল লক্ষ্য। রিয়েলিটি শো-কে আরও বাস্তব করে তুলতে গিয়ে গল্পের চরিত্রদের সাজিয়ে দেওয়া ঘটনাই যদি দর্শকেরও সাজানো মনে হয়, তাহলে সেই শো কতটা ‘রিয়েল’, তা নিয়ে প্রশ্ন আসবেই।
খটকা তিন: এক বিমান দুর্ঘটনায় দুজন মানুষের স্মৃতিভ্রমকে কাজে লাগিয়েছে কল্কি। কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও কল্কি কী ভাবে জানল সেই মানুষ দুটির পছন্দ-অপছন্দের কথা? স্মৃতিশক্তি হারানো সেই দুজন ব্যক্তি নিশ্চয়ই নিজে থেকে কল্কিকে তা জানাবেন না।
ফিকশন ভেবে নিয়ে লজিকের কচকচানি বাদ দিলেও, আরও অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন, গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে হঠাৎ করে এক গ্রামে গিয়ে পৌঁছানো থেকে শুরু করে ফের হোটেলে ফিরে আসার ঘটনাগুলি বেশ আতিনাটকীয় মনে হয়।
আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল
অভিনয়ে প্রত্যেকেই নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছেন। একাধারে হোটেল ম্যানেজার এবং এক দাপুটে রিয়েলিটি শো-এর মালিক কল্কির ভূমিকায় পাওলি অনবদ্য। অর্জুন বরাবরের মতো এখানেও সাবলীল। তবে এই ছবিতে অভিনয়ে বলে-বলে গোল দিয়েছেন মধুমিতা। বড় পর্দায় প্রথমবার অভিনয় করতে এসে তাঁর চোখমুখের অভিব্যক্তি দৃপ্ত। পাওলির মতো দাপুটে অভিনেত্রীর পাশে রীতিমতো নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ভিন্ন ধরণের গল্পে একেবারে টাটকা অর্জুন-মধুমিতার জুটি দারুণ লাগে দেখতে। অন্তরঙ্গ দৃশ্যেও আড়ষ্টতাহীন অভিনয়ে ভালোভাবেই উতরে গেলেন দুজনে। ভালো লাগে হিপনোথেরাপি স্পেশালিষ্ট বটুকবাবুর চরিত্রে অভিজিৎকেও। অনিন্দিতা ও ‘একেনবাবু’ খ্যাত অনির্বাণের অভিনয়ও সাবলীল। শুভঙ্কর ভড়ের ক্যামেরার কাজ প্রশংসনীয়।
চেষ্টা ভালোই করেছিলেন প্রতিম। কিন্তু চিত্রনাট্যে কিছু অসঙ্গতি থেকে গেল। তবে পরিচালকের ভাবনাকে সাধুবাদ। ভালোবাসার মানুষকে বারংবার নতুনরূপে পাওয়ার এমন অ্যাডভেঞ্চার সচরাচর পাওয়া যায় না। কাছের মানুষকে নিত্যনতুন আবিষ্কার করার আবদারেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ/ও মোর ভালোবাসার ধন।”