পিঁপড়ের খাদ্যে পরিণত ডায়েরী একেবারে সিনেমার পর্দায়

ছবি: প্রোফেসর শঙ্কু ও এল্‌ ডোরাডো

পরিচালনা: সন্দীপ রায়

অভিনয়ে: ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, শুভ্রজিৎ দত্ত, উদয়শঙ্কর পাল, এডুয়ার্ডো মুনিজ়, জ্যাকলিন মাজ়ারেলা, রিকার্ডো দাঁতে

দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

‘যে জিনিসটাকে অক্ষয় অবিনশ্বর বলে মনে হয়েছিল, সেটা হঠাৎ পিঁপড়ের খাদ্যে পরিণত হল কী করে সেটা আমি এখনও ভেবে ঠাহর করতে পারিনি।’ শঙ্কুর প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রী’র শেষ কয়েকটা লাইন এতই চমকপ্রদ ও অদ্ভুত যে সেই বিস্ময়ের ঘোরেই বাকি কাহিনীগুলো না পড়ে আর উপায় থাকে না। এ কথা বোধহয় শঙ্কুর একনিষ্ঠ পাঠক মাত্রেই মানবেন। সেই শঙ্কুকে ছবির পর্দায় দেখতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা থাকবে না এমন তো আর হতে পারে না।




প্রতি সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া ছবির ভিড়ের মাঝে মধ্যে এমন কিছু ছবিও থাকে শুধুমাত্র বিষয়ের গুণেই যার প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ অনুভব করা যায়। সেই সূত্রেই ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও এল্‌ ডোরাডো’ ছবিটার প্রতি একটি আলাদা ধরণের টান বহু দর্শকই অনুভব করবেন। বছরের এই সময়টায় সত্যজিৎ রায়ের লেখা কাহিনী অবলম্বনে কোনও ছবি এলে তার চাহিদা বরাবরই আকাশছোঁয়া হয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষত এবার বিষয়বস্তু শঙ্কু বলেই উৎসাহ যেন আর একটু বেশিই। কেন না এর আগে ছবির পর্দায় শঙ্কুকে দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় এবং আমাদের কল্পনার জগতে। এই প্রথমবার তাঁকে বড়পর্দায় নিয়ে এলেন সন্দীপ। যে কোনও কাহিনী বা উপন্যাসকে সিনেম্যাটিক রূপ দিতে গেলে গল্প বলার ধাঁচে কিছু পরিবর্তন করা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। নাহলে তা সিনেমা হয়ে দাঁড়ায় না। সেটুকু পরিবর্তন পরিচালক করেছেন, কারণ সেটা জরুরী ছিল।

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

১৯৮০ সালে প্রকাশিত শঙ্কুর তুলনায় ২০১৬-এর শঙ্কু যে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এগিয়ে থাকবেন সে কথা ছবি দেখার আগেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। তাই সময়ের শর্ত মেনেই তাঁর হাতে উঠল অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন। তবে যে সে ফোন নয়, এ হলো শঙ্কুর নিজের আবিষ্কৃত ফোন যা রূপ ও কাজের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বাজারে চলা যে কোনও স্মার্টফেনকে বলে বলে দশ গোল দেবে। এছাড়াও তাঁকে দেখা গেল হলোকনে জেরেমি সন্ডার্স ও উইলহেলম ক্রোলের সঙ্গে কথা বলতে। হলোগ্রাফিক কনফারেন্স বা হলোকন জিনিসটা অনেকটা ভিডিও কলের মতো হলেও এখানে যোগাযোগ করতে চাওয়া কাঙ্খিত ব্যক্তিটি একেবারে সামনে এসে বসেন।

এছাড়া যেটি পাওয়া গেল তা হলো মিরাকিউরলের গুণসমৃদ্ধ একটি মলম, যা যে কোনও ব্যথা বা ক্ষততে লাগালে খুব তাড়াতাড়ি উপশম হয়। কতটা তাড়াতাড়ি তা আমরা নিজে চোখেই দেখলাম, এবং এতে করে শঙ্কুর আবিষ্কৃত এই সর্বরোগনাশক ওষুধটির প্রতি আবারও যেন বিস্ময় বেড়ে গেল। বলা বাহুল্য, বেশ কয়েকটা প্রজন্ম ধরে বাংলা সাহিত্যের পাঠক পাঠিকারা মনের কোনও এক গোপন কোণে এ বিশ্বাস সযত্নে লালন করেন যে প্রফেসর শঙ্কু আছেন, হয় টাফা গ্রহে, আর নয়তো কোনও অজানা জায়গায় আত্মগোপন করে রয়েছেন ভীষণ এক জরুরী গবেষণার কাজে। সময় হলেই তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। বইয়ের পাতায় দেখা সেই ঋষিতুল্য ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর ছবির পর্দায় আত্মপ্রকাশ করাটাও কিছু কম বড় ব্যাপার নয়।

আরও পড়ুন: যে মৃত্যু আজও রহস্য

ছবির গল্প শুরু হয় ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রী’র সূত্র ধরে, যেখানে ২০১৯-এ সমরেশ (শুভ্রজিৎ) একটি লাল ডায়রী পায় তারকবাবুর থেকে, যেটা নাকি তিনি সুন্দরবন অঞ্চলে এক উল্কাপাতের ফলে তৈরি হওয়া বিশাল গর্তের মধ্যে পেয়েছেন। প্রথমে তেমন আমল না দিলেও, ডায়রীতে কালির রং পাল্টানো দেখে সমরেশের মনে আগ্রহ জাগে সেটির প্রতি এবং এখান থেকেই শঙ্কুর কাহিনী আরম্ভ। ২০১৬ থেকে নিরুদ্দেশ এই বৈজ্ঞানিক সম্পর্কে যাবতীয় ভূমিকা তিনি নিজেই দেন তাঁর আত্মকথনের মাধ্যমে, যেমনটা আমরা বইয়ে পড়েছি। তবে শঙ্কুর প্রথম গল্পের সঙ্গে যোগাযোগ এখানেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, পরে আর বর্তমান সময়ে ফিরে আসা হয় না। পুরো ছবিটাই ২০১৬-এর প্রেক্ষাপটে ঘটে চলে। 

ছবির গল্প সকলেরই জানা, তবু সারসংক্ষেপ করলে এটুকু বলা যায় যে শঙ্কুর আবিষ্কৃত সমস্ত গ্যাজেট ও ওষুধপত্রের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় সাও পাওলোতে। সেখানে যাবার আগে শঙ্কুর কাছে এসে উপস্থিত হন মাকড়দার নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস। আচমকাই এক ঝড়জলের সকালে বল লাইটনিংয়ের সংস্পর্শে এসে নকুড়বাবু এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন, যার দ্বারা তিনি যে কোনও মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ দেখতে সক্ষম হন। এ যাত্রায় তিনিও শঙ্কুর সঙ্গী হয়ে যান তাঁর আসন্ন বিপদের কথা ভেবে। যদিও নকুড়ের যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা ও শঙ্কুর তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যাওয়া ছবিতে একটু কৃত্রিম ঠেকে। সাও পাওলো গিয়ে শঙ্কুর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু সন্ডার্স ও ক্রোলের সঙ্গে দেখা হওয়া ও নানান ঘটনার উত্থান পতন বইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে। এরপরে সলোমন ব্লুমগার্টেন নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে শঙ্কুর সাক্ষাৎ ও তাঁর বেয়াড়া আবদারে শঙ্কুর কর্ণপাত না করা দিয়ে মূল গল্পের অবতারণা হয়।

আরও পড়ুন: পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

সন্ডার্স ও ক্রোলের চরিত্রদুটি যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। দুজনেরই অভিনয় যথাযথ। কিছুটা ধাক্কা লাগে ব্লুমগার্টেনকে দেখে। কথিত চরিত্রটির সঙ্গে মেলালে ইনি যেন ঠিক ততটাও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন না। এনার অবাক হওয়া থেকে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠায় সর্বত্রই যেন এক কৃত্রিমতা কাজ করে। চেহারার দিক থেকে ব্লুমগার্টেনের বর্ণনার সঙ্গে কিছুটা মিলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও সাদৃশ্য ইনি তৈরি করতে পারলেন না। প্রোফেসর রডরিগেজের ভূমিকায় জ্যাকলিন ও তাঁর সেক্রেটারি লোবোর ভূমিকায় এডুয়ার্ডো মানানসই।

এবার আসা যাক শঙ্কু প্রসঙ্গে। ট্রেলারে শঙ্কুরূপী ধৃতিমানকে দেখে অনেকেরই ধাক্কা লেগেছিল। শঙ্কু মানেই এক আপনভোলা সদাশয় ব্যক্তি, যিনি অনেকক্ষেত্রেই কারোর উপরোধ এড়াতে পারেন না, মুখের ওপর ‘না’ বলা যার ধাতে নেই। মানে এক কথায় অত্যন্ত ভালোমানুষ, পন্ডিত এক ব্যক্তি যিনি জাগতিক বিষয়সমূহের প্রতি ততটাও মনোযোগী নন, নিজের গবেষণাই যার কাছে একমাত্র মনোযোগের বিষয়। ছবির পর্দায় কিন্তু একটু অন্যভাবেই শঙ্কুকে দেখা গেল। তাঁর প্রায় পঞ্চাশ বছরের অভিনয়ের অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিচার করলে ধৃতিমান সেদিকে কোথাও খামতি রেখেছেন এমন বলা চলে না, কিন্তু তবু যেন তিনি বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা শঙ্কু নন। সেই আত্মভোলা ভালোমানুষ মহাজ্ঞানী প্রফেসরকে ছবিতে কোথাও পাওয়া গেল না। বরং ইনি অনেক বেশি সচেতন, একটু গম্ভীর ও রাগী ধরণের শঙ্কু। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকবোধও যেন পর্দার শঙ্কুর মধ্যে খানিক কমই পাওয়া গেল। স্বাভাবিক পেলবতার বদলে একটু বেশিই কঠিন হয়ে উঠলেন পর্দার তিলুবাবু। বরং বইয়ের নকুড়কে পর্দায় জীবন্ত করে তুললেন শুভাশিস। বস্তুত তাঁর আর নকুড়ের মধ্যে বিশেষ ফারাক বোঝা গেল না। তবে এল ডোরাডোর বর্ণনায় তিনি আর একটু কল্পনাপ্রবণ হলে ভালো লাগতো। প্রহ্লাদরূপে উদয়শঙ্করও যেন আসল চরিত্রটিকেই তুলে ধরলেন। 

আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে

বলা হয় ছবিতে যতটুকু দেখানো হয়েছে সমালোচনা যেন তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তার বাইরে গিয়ে সমালোচনা করা নিয়মবিরুদ্ধ। তবু যেখানে শঙ্কু বিশেষ ধরনের মোবাইল ব্যবহার করলেন বা কথায় কথায় যেচে গিয়ে নিজের তৈরি মলম অন্যকে লাগিয়ে দিলেন, সেখানে বিধুশেখরকে একটু কথা বলতে বা হাত পা নাড়তে দেখা গেলে মন্দ হলো না।

ছবিতে ভিএফএক্সের ব্যবহার করা হয়েছে বেশ মেপে। ফলে ছবিটি যেন একটু বেশিই ছিমছাম। যদিও ছবিটিকে ভিএফএক্স সর্বস্ব করে তোলার কোনও ইচ্ছা তাঁর ছিল না বলেই পরিচালক জানিয়েছেন, তবু যেন জটায়ুর মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘একটু ধুমধাম হলে খুশিই হতুম মশাই।’ জাগুয়ারের দৃশ্যটি বেশ স্বাভাবিক লাগলেও উল্কাপাতের মতো বিশাল এক প্রাকৃতিক ঘটনাকে বড় বেশি সংক্ষিপ্ত করে দেখানো হলো। তবে গল্পের থেকে কিছুটা আলাদা করে পোরোরির ঘটনায় স্থানীয় উপজাতি চুকাহামাইদের আক্রমণ ও কিউরারে বিষমাখানো তীরের ফলার ঘটনা দেখতে মন্দ লাগে না। হাইটরের ভূমিকায় বিদেশি অভিনেতা খুব কম সময়ের জন্য থেকেও খুব স্বাভাবিক অথচ মনে রাখার মতো অভিনয় করলেন। তাঁর উপস্থিতি হলিউড ছবিকে মনে করিয়ে দিল। তবে গল্পের বর্ণনা যতটা উত্তেজিত করে ছবিতে কাহিনীর মোড় ঠিক ততটা ছাপ ফেলতে পারল না যেন। 

তবু চেনা ভঙ্গীতে সন্দীপের গল্প বলার স্টাইল দেখতে ভালো লাগে। সৌমিক হালদারের ক্যামেরার কাজ বেশ ভালো। ললিতা রায়ের পোশাক পরিকল্পনা যথাযথ। ছবির বেশিরভাগ অংশই ইংরেজিতে হলেও তা খুবই সরলভাবে হয়েছে, ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না। সব মিলিয়ে শঙ্কুর সিরিজের প্রথম ছবি দেখে শীতের শুরুটা ভালোই কাটবে বাঙালির। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *