পাকদণ্ডীর পথে পথে দেওরিয়াতাল

দিউরিয়াতাল বা দেওরিয়াতাল উত্তরাখণ্ড রাজ্যে উখিমঠের কাছে অপূর্ব সুন্দর এক পাহাড়ি হ্রদ। পার্শ্ববর্তী সবুজ বুগিয়াল থেকে দেখা যায় তুষারাবৃত গাড়োয়াল হিমালয়ের বিখ্যাত সব পর্বতশৃঙ্গ। এই হ্রদের কথা প্রথম জেনেছিলাম আমার স্বামীর কাছে, অফিসের কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি বছর ছয়েক আগে সেখানে ক্যাম্পিং করে এসেছিলেন। তাই এবার পুজোয় কেদারনাথ যাত্রার সঙ্গে এই সুন্দর স্থানটিকে যোগ করে নেওয়ার প্রস্তাবে আনন্দিতই হয়েছিলাম। তবে কেদারনাথ থেকে ফেরার দিনই আবার এই পাহাড়ে ওঠা বেশ কঠিন কাজ ছিল।

কেদারের পথ ছেড়ে, কুন্ড থেকে গোপেশ্বর-চামোলির রাস্তা ধরে একটু এগোতেই এসে গেল ছবির মত ছোট্ট শহর উখিমঠ। এই রাস্তাতেই পড়ে বাকি চার কেদারের (মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বর) প্রবেশপথ।

ছোট হলেও, উখিমঠ বেশ জমজমাট শহর। শীতকালে কেদারনাথ ও মদমহেশ্বরের কপাট বন্ধ হলে এখানেই বিগ্রহের পুজো করা হয়। বলা হয়, পুরাণের বানরাজার রাজ্য শোণিতপুর হলো বর্তমানের উখিমঠ বা উষামঠ। উষা ছিলেন বানরাজার পরমাসুন্দরী কন্যা। তার প্রেমে পড়েন বানরাজার চিরশত্রু, শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। বানরাজার কানে সেই খবর আসতেই তিনি বন্দী করলেন অনিরুদ্ধকে। কিন্তু ছেলেকে বন্দী করার অপমান শ্রীকৃষ্ণ মেনে নেবেন কেন? অতএব যুদ্ধ। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করার কোনও লক্ষণই তো দেখা যাচ্ছে না কোনও পক্ষের। প্রমাদ গনলেন মহাদেব, মধ্যস্থতা করে যুদ্ধ থামালেন তিনি। মহাদেবের অনুরোধে বানরাজার প্রাণরক্ষা করলেন কৃষ্ণ, উষা ও অনিরুদ্ধের মিলনে কোনও বাধা দিলেন না তিনি।   

আরও পড়ুন: বস্টনে সেরা প্রগতিশীল ছবির শিরোপা পেল ‘অব্যক্ত’

উখিমঠ থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরত্বে, সারিগ্রাম পৌঁছতে আমাদের সময় লাগল প্রায় আধ ঘন্টা। সারিগ্রাম থেকে পায়ে চলা পথ উঠে গেছে পাহাড় বেয়ে। চড়াই বেয়ে ২.২ কিমি উঠলেই দেওরিয়াতাল। উচ্চতা প্রায় ৮,০০০ ফুট (২,৪৩৮ মিটার)। পাহাড়ি গ্রামের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে পাথরে বাঁধানো এই পরিস্কার পথ। ঘোড়া বা পনির পিঠে চেপেও সারিগ্রাম পৌঁছনো যায়, তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা।

দেওরিয়াতাল

দেওরিয়াতাল যাওয়ার পথে এক ফাঁকে সারিগ্রাম

সারিগ্রামের রাস্তা বেশ চড়াই, শহুরে সভ্যতায় অভ্যস্ত মানুষের উঠতে হাঁপ ধরে। তাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী হাঁটেন সবাই। পথে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দু-তিনটি বসার জায়গা আছে। সারিগ্রাম থেকে কিছুটা ওঠার পর পথে পড়ে ওঙ্কার রত্নেশ্বর মহাদেবের মন্দির। পথের দুপাশে সবুজের সমারোহ।  মস, ফার্নের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। চলার ক্লান্তি নিমেষে দূর করে দেয় পাখির কলকাকলি।

মন্দির চত্বরে ক্ষণিকের বিরতি নিয়ে আবার শুরু হলো পথচলা। ধীর পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম আমাদের রাতের আশ্রয়, হ্রদের একদম গা ঘেঁষে সুরেন্দ্র সিংয়ের হোমস্টে টেন্টে। উখিমঠ থেকে এই গোটা পথ পৌঁছতে সময় লাগল তিন ঘন্টার একটু বেশি। আগে একদম হ্রদের গায়েই টেন্ট খাটানো যেত। কিন্তু ২০১৪ সালে উত্তরাখণ্ড হাই কোর্টের নির্দেশে বুগিয়ালে টেন্টিং বা ক্যাম্পিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন হ্রদ থেকে একটু দূরে ক্যাম্পিং করা হয়। টেন্ট ছাড়া সুরেন্দ্রর হোমস্টেতে দুটি ঘরও আছে বাথরুম সমেত।

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

বিকেল নামছে দ্রুত। দিনের আলো আর বেশিক্ষণ থাকবে না। তাই ব্যাগ রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে চা খেয়ে এগিয়ে গেলাম হ্রদের দিকে। বনের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ শেষ হতেই সিনেমার পর্দার মতো চোখের সামনে খুলে গেল মখমলের মত সবুজ গালিচা পাতা বুগিয়ালের কোলে অপূর্ব হ্রদটি। আমাদের মনের ভাব তখন অনেকটা ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ গল্পে জটায়ুর মতো। অর্থাৎ, ‘স্তব্ধভাষ রুদ্ধশ্বাস বিমুগ্ধ বিমূঢ় বিস্ময়!’

বেশকিছু পৌরাণিক কাহিনী আছে এই হ্রদটিকে নিয়ে। তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য কাহিনীটি হলো, মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বকরূপী যক্ষ বা ধর্মরাজের প্রশ্নোত্তর নাকি এই হ্রদের ধারেই হয়েছিল। স্থানীয়দের বিশ্বাস, জলের তলায় নাগদেবতার বাস। জন্মাষ্টমীতে নাগদেবতার পুজোও করা হয় এখানে। অন্য আরেকটি গল্প হলো, চাঁদনী রাতে দেও বা দেবতারা ও স্বর্গের অপ্সরারা না কি হ্রদে স্নান করতে আসেন। সেই দেও বা দেবতাদের নাম থেকেই জায়গাটার নাম দেওরিয়াতাল।

হ্রদ ও তার আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সবাই এতটাই মুগ্ধ ছিলাম  যে খেয়ালই করিনি বন দপ্তরের কর্মী আমাদের হাত নেড়ে ডাকছেন। কেদারনাথ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির মাথাপিছু প্রবেশমূল্য ₹১৫০ দিতে হলো আমাদের। আমার বারো বছরের কন্যাটির জন্য ছাড় দিলেন বনরক্ষী। জানা গেল পরের দিনের জন্য আর কোনও প্রবেশমূল্য দিতে হবে না।

দেওরিয়াতাল

চৌখাম্বায় সূর্যোদয়

এদিকে মেঘ সরে গিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ, যার মধ্যে সবার আগে চোখে পরে চৌখাম্বা। তারপর একে একে দৃশ্যমান হলো কেদারনাথ, কেদারডোম, সুমেরু, মন্দানি, জহ্নুকূট। ঘাসের মখমলে পা ফেলে একটু এগোতেই চোখে পড়ল বেশ কয়েকটা লাল মাথাওয়ালা সবুজ কাঠঠোকরার দল, যাদের নাম পোশাকি স্কেলি বেলিড উডপেকার। গাছের ওপর ডাক শুনে তাকাতেই উড়ে গেল ইয়েলো বিলড ম্যাগপাই। তবে বেশকিছু পাহাড়ি দাঁড়কাক তাদের বিরক্তি প্রকাশ করছিল আমাদের মত অনুপ্রবেশকারীদের দেখে। আমরা ছাড়াও বেশকিছু পর্যটক ছিলেন সেখানে। বেশিরভাগেরই কম বয়স আর তাদের তারুণ্যের অপ্রয়োজনীয় উচ্ছ্বাসে সেই শান্ত সৌম্য পরিবেশ সামান্য হলেও বিঘ্নিত হচ্ছিল মাঝেমধ্যেই। হ্রদের ধারে পায়ে চলা পথ দিয়ে কিছুটা এগোলেই একটা ওয়াচ টাওয়ার। সেখানেও পর্যটকের ভিড়। তার উল্টোদিকে বেশ খানিকটা উঁচু খোলা জায়গা, সেখানে কেউ নেই দেখে আমরা গিয়ে বসলাম।

আস্তে আস্তে সোনালী সূর্যের আলো রাঙা হয়ে এল। চৌখাম্বায় তার অপরূপ আভা। নিচে হ্রদের জলে আবছা লালিমার ছোঁয়া। স্তব্ধ হয়ে দেখলাম জীবনে দেখা সুন্দরতম সূর্যাস্ত। এ সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া বা লেন্সবন্দী করার প্রচেষ্টা অনর্থক। শুধু মনের মণিকোঠায় রেখে দেওয়া যায় এই অপরূপ অনুভূতি।

আরও পড়ুন: ফেলুপুজো ও বাঙালির হা-হুতাশ

ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল। এবার ফিরতে হবে সিংজীর আস্তানায়। সেখানে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ভালোই। রুটি সবজি, ডাল চাউল আর ডিমের ভুজিয়া সহযোগে রাতের খাওয়া সম্পন্ন হলো। খাওয়া শেষ করে টেন্টে মাথা গোঁজার আগে দেখলাম দুর্গাসপ্তমীর চাঁদ উঠেছে আকাশে। সারা আকাশ জুড়ে তারাদের মেলা। মেয়ে তার বাবার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ চিনতে চেষ্টা করছিল সপ্তর্ষি মণ্ডল, কালপুরুষকে। বইয়ে ছাপা অক্ষরের বাইরে যাদের দেখতে পাওয়া যায় একমাত্র হিমালয়ের দূষণমুক্ত আকাশে। বাইরে ঠাণ্ডা ভালোই, তবে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢোকার একটু পরেই সেটা আর টের পেলাম না। পথশ্রমে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল করিনি।

সকালে উঠেই এক দৌড়ে আবার হ্রদের ধারে। দেখি প্রথম রবিকিরণের অপেক্ষায় সদ্য পড়া বরফে স্নান করে ঝকঝক করছে চৌখাম্বা। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা লালচে আভা পড়ল তার ডানদিকের গালে। লাল থেকে ক্রমে সোনালী, খুব দ্রুত হতে থাকল সেই রঙের পরিবর্তন। চৌখাম্বার পর সূর্যের আলো আলতো করে ছুঁয়ে দিল কেদারনাথ, কেদারডোম আর জহ্নুকূটের মুকুট। নীল আকাশ আর সবুজ ঘাসের গালিচার মধ্যে সাদা বরফে রঙের খেলা দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশকিছুটা সময়। পাখিরাও ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গলা সাধতে ব্যস্ত।

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

এবার ফেরার পালা। অনিচ্ছা স্বত্বেও ফিরতে হবে ঘরে। গরম আলুর পরোটা আর চা দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে ফিরতে হবে সারিগ্রাম। হোমস্টের গাছের ফাঁক দিয়েও তখনও হাতছানি দিয়ে ডাকছে দেওরিয়াতাল আর চৌখাম্বা, যদিও পরের জনের সঙ্গে আবার দেখা হবে তুঙ্গনাথে। স্বাভাবিক কারণেই নামতে সময় লাগল কম, প্রায় দুঘন্টা। নামার সময় চলার পথে ক্যামেরাবন্দী হলো নাম না জানা কত রঙের পাহাড়ি ফুল, ফার্ন, পাতা, এমন কি কয়েকটা গিরগিটিও। নিচে দেখা যাচ্ছে ছবির মত সারিগ্রাম আর তার জুমচাষের জমি। গাড়িচলা পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে চোপতার দিকে। সারিগ্রামকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম সেই দিকেই। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য তুঙ্গনাথ।

দেওরিয়াতাল

চৌখাম্বায় সূর্যাস্ত

কিভাবে যাবেন: হরিদ্বার থেকে সারিগ্রামের দূরত্ব ২১৬ কিমি। দেবপ্রয়াগ, শ্রীনগর, রুদ্রপ্রয়াগ হয়ে মন্দাকিনীর পাশ দিয়ে কেদারনাথের পথে অগস্ত্যমুনি, কুন্ড ও উখিমঠ পেরিয়ে সারিগ্রাম। হৃষীকেশ থেকে বাস যায় উখিমঠ পর্যন্ত। তারপর শেয়ার গাড়িতে সারিগ্রাম। এছাড়াও উত্তরাখণ্ড রোডওয়েজ়ের বাস আছে সারিগ্রাম পর্যন্ত। প্রাইভেট গাড়িতে সরাসরি হরিদ্বার বা হৃষীকেশ থেকেও যাওয়া যায়। কেদারনাথ থেকে বদ্রীনাথ যাওয়ার পথে দেওরিয়াতাল, চোপতা তুঙ্গনাথকে অন্তর্ভূক্ত করার পরিকল্পনা করেন অনেকেই। তবে দেওরিয়াতাল থেকে ট্রেক করেও তুঙ্গনাথ যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে মোট ট্রেক ২৪ কিমি এবং আরও দু’রাত থাকতে হবে। পথে পড়বে বিখ্যাত রোহিনী বুগিয়াল ও চোপতার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। বিখ্যাত ট্রেকিং সংস্থাগুলি এই ট্রেক করিয়ে থাকে।

আরও পড়ুন: আবারও এক ফ্রেমে সৌমিত্র-অপর্ণা, মুক্তি পেল ‘বহমান’-এর ট্রেলার

কোথায় থাকবেন: সারিগ্রামেও বেশ কিছু হোমস্টে আছে। দেওরিয়াতালে থাকার বা ক্যাম্প করার জন্য সুরেন্দ্র সিং ছাড়াও হীরা সিং নেগি ও আরও অনেকের ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা আছে। থাকা খাওয়া নিয়ে একরাতের টেন্ট বা ঘরপিছু ভাড়া ₹১,৫০০-২,০০০ এর মধ্যে। আগে থেকে বুক করে নেওয়াই ভালো। অনলাইনে আগাম টাকা দিয়েও বুকিং করার সুযোগ আছে, যদিও সময় বিশেষে টেন্ট বা হোমস্টের ভাড়ায় তারতম্য হতে পারে। সারিগ্রাম থেকে দেওরিয়াতাল পর্যন্ত ঘোড়া বা পনির ভাড়া ₹৫০০-৮০০ এর মধ্যে। তবে তা দরদাম করা যেতেই পারে। ওঠার পথে ঘোড়া বা পনি দেখতে না পেলে সারিগ্রামের দোকান বা হোটেলগুলি থেকে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

শীর্ষচিত্র: হিমালয়ের কোলে দেওরিয়াতাল

ছবি: সৌরভ বাগচী

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Shyamashree

Graduate in Bengali literature. Homemaker, voracious reader and a passionate traveller. A lover of pristine locations with chirping of birds. The serenity of the mountains and historical places makes me an wanderlust. Also an occasional writer penning travelogues

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *