থ্রিলারে ফের জাত চেনালেন সৃজিত

ছবি: ভিঞ্চিদা

পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: রুদ্রনীল ঘোষ, সোহিনী সরকার, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, ভরত কল, ঋদ্ধি সেন

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫৭ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং ‘চতুষ্কোণ’ দেখার পর এই বিশ্বাসটা ছিল যে থ্রিলার ছবির ক্ষেত্রে তিনি হতাশ করবেন না। হতাশ তো নয়ই, উল্টে অনেকদিন পর বাংলা ছবিতে এমন নাটকীয় থ্রিলার দেখার সুযোগ মিলল সৃজিতের হাত ধরেই। ‘ভিঞ্চিদা’র কাহিনী ও টানটান চিত্রনাট্য আগাগোড়াই সিটের সঙ্গে বেঁধে রাখে দর্শককে।




রুদ্রনীলের মূল কাহিনী অবলম্বনে ও মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডুর বাস্তব জীবনের গল্প থেকেই এই ছবির ভাবনা এসেছে। তবে শুধুমাত্র এক শিল্পীর জীবনের হতাশার গল্প হয়ে থেকে যায়নি ‘ভিঞ্চিদা’। সার্থক থ্রিলারের মত যথার্থ অর্থেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে উঠেছে। একজন অতিমানব, যে নিজের বিশ্বাসকে অন্যদের মধ্য দিয়ে চরিতার্থ করে, যার প্রবণতাকে এক কথায় জার্মান শব্দ ‘ইউব্‌রমেন্‌শ’ দিয়ে বোঝানো যায়, তাকে এই ছবির থ্রিলার হয়ে ওঠার মূল ভাবনা বলাই যায়।

যে মৃত্যু আজও রহস্য

এ ছবি যেমন ভিঞ্চিদার, তেমনই আবার আদি বোসেরও। গুণী মানুষ যখন তার কাজের সঠিক কদর পায় না, তখন সে ভিতরে ভিতরে উপোসী বাঘের মতই ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। আর সেই খিদেকে কাজে লাগিয়ে হায়নাজাতীয় পশুরা তার সামনে শিকার এনে ফেলে।

ছবির ট্রেলারে গল্পটা সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। ছবি দেখতে বসে নতুন যেটা জানা গেল, তা হল এ ছবি ভীষণ সরল ও ভীষণ জটিল দুটো চরিত্রকে একটিমাত্র সূত্রে বেঁধেছে। সেই সূত্র হল মেকআপ, বা আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, প্রস্থেটিক। জটিল অপরাধ মনস্তত্বও এ ছবির প্রতিপাদ্য বিষয়। অতিরিক্ত মেধাবী হলে মানুষ একটু পাগলাটে হয়ে যায়, এই ধারণাকে খুঁটি করে আদি বোস হয়ে ওঠেন শহরের বড়লোক অপরাধীদের ত্রাস। নিজেকে তিনি সিরিয়াল কিলার না বলে সিরিয়াল ল’ইয়ার হিসেবে পরিচয় দেন। যদিও একটি পকেটমারকে ধরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও ‘সমাজ সংস্কারমূলক’ কাজ করতে তাকে দেখা যায়নি এর আগে। ভিঞ্চিদার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে আদি বোসের আরও কিছু চমকে দেওয়ার মত নির্লিপ্ত অপরাধের কর্মকাণ্ড দেখালে চরিত্রটা আর একটু বিশ্বাসযোগ্য করা যেত।

তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

ছবির শুরুতে ভিঞ্চিদার জবানীতে তার এ হেন অদ্ভুত নামকরণের কারণ জানা যায়। সঙ্গে শ্যুটিং সেটে সেই ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায় যা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে রুদ্রনীল এই ছবির গল্প লিখেছেন। সোমনাথ অন্য একটি ছবিতে এক দুর্ঘটনার দৃশ্যে আহত এক চরিত্রের এমন ভয়ঙ্কর প্রস্থেটিক করেছিলেন যে পরিচালক নৃশংসতার দোহাই দিয়ে সেই দৃশ্যটি গ্রহণই করেননি। এই ঘটনা ভিঞ্চিদাকে জীবনের মূল স্রোত থেকে অনেকটাই সরিয়ে দেয়। তবে টালিগঞ্জে দীর্ঘদিন কাজ না পাওয়া সত্বেও আদি বোস কিভাবে তার খোঁজ পেলেন এবং এত বড় একটা কাজের জন্য তার ওপর ভরসা করলেন, সেটা ঠিক স্পষ্ট হল না।

ভালো লাগে প্রথম অপরাধের পর ভিঞ্চিদা ও আদির মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্যটি। স্বপ্নে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ছবি আঁকার দৃশ্যটিও সুন্দর।

ছবির শুরুতেই দা ভিঞ্চির কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে শিল্প ও বিজ্ঞানকে একাসনে বসিয়ে ভিঞ্চিদা বুঝিয়ে দেন তিনি শুধু একজন মেকআপ আর্টিস্ট নন, বরং শিল্প বিষয়ে জ্ঞান তাকে প্রায় এক দার্শনিকে পরিণত করেছে। এরপর আসে ২,৫০০ কোটি টাকার জালিয়াতি ও শ্যামসুন্দর জয়সওয়ালের নির্মম পরিণতি। আদালত থেকে কিভাবে আদি বোস তার শিকার খুঁজে বার করত তাও স্পষ্ট হল। তবে তাবড় উকিলরা যেখানে আদির কাছে পরামর্শের জন্য আসেন, সেখানে সাধারণ মক্কেল কেন তার কাছে আসবেন না বা তার পসার নেই কেন, সেটা ঠিক বোঝা গেল না। শ্যামসুন্দর, মানস সাহা ও সানি সেনকে শাস্তি দিতে গিয়ে তাদের মত করে অপরাধ করার প্রবণতা আদি বোসের নিষ্ঠুর ও নির্লিপ্ত চরিত্রকে আরও স্পষ্ট করেছে। কিন্তু চরিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধোঁয়াশা রেখে যায়। সানির ঘটনা প্রথম দুটি ঘটনার চেয়ে বেশ একটু তাড়াহুড়ো করে শেষ করা হয়েছে বলে মনে হল।  

শব্দ যখন ছবি আঁকে

ভিঞ্চিদা ও আদি বোস ছাড়াও যে দুটি চরিত্রকে দেখার জন্য সারাক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকতে হয় তাদের একজন হলেন জয়া ও অন্যজন বিজয় পোদ্দার। এত জটিল ঘটনাবলির ভিড়ে সহজ সরল জয়া অনেকাংশে বেশ রিলিফ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আর বাংলা ছবিতে বিজয়ের মত এমন বাস্তব পুলিশ চরিত্র খুব একটা দেখা যায় না। তবে সাধারণ একটা আত্মহত্যার ঘটনায় গোয়েন্দা প্রধানের সশরীরে হাজির হওয়ারও কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ পাওয়া গেল না।

এছাড়া সবচেয়ে বড় খটকা রেখে যায় ছবির মূল বিষয়, প্রস্থেটিক মেকআপ। ছবির প্রয়োজনে মেনে নিলেও, এত সহজে সেই মেকআপের দৌলতে তৈরি মুখোশ খোলা-পরা করা যায় কি? তবে ওই লার্জার দ্যান লাইফ ব্যাপারটাকে মেনে নিলে এটুকু অসঙ্গতি সৃজিতের এই ছবিকে কোথাও খর্ব করে না।

অভিনয় এই ছবির বড় সম্পদ। ‘ভিঞ্চিদা’ আসলে অভিনেতাদের ছবি। পরিচালকের এখানে কিছুই করার থাকত না, যদি বর্তমান বাংলা ছবির এই চার মহারথীকে সহযোদ্ধারূপে না পেতেন। ছবির কাহিনীর উপোসী শিল্পীর মতই ভালো চরিত্রের জন্য অভিনেতারা যে মুখিয়ে থাকেন, তা আবারও বোঝা গেল ভিঞ্চিদারূপী রুদ্রনীল ও আদি বোসের ভূমিকায় ঋত্বিককে দেখে। এমন চরিত্র রোজ রোজ মেলে না, তাই ফ্রি হিট পেয়েই তাঁরা যে ওভার বাউন্ডারি হাঁকাবেন, এটা জানাই ছিল। দুই অভিনেতাই নিজের চরিত্রে অপ্রতিরোধ্য। শিল্পীর ভেতরের খিদেটাকে অসামান্য ফুটিয়ে তুলেছেন রুদ্রনীল। ঋত্বিক প্রতিবারের মত এবারেও অসম্ভব সতেজ ও নতুন চেহারায় চমকে দেন।

আমার মুক্তি আলোয় আলোয়

তবে এই দুটো চরিত্রের চেয়েও কোথাও যেন একটু বেশি কঠিন ছিল জয়া ও বিজয় পোদ্দার। জয়ারূপী সোহিনী যে শুধু অবাক করলেন তা নয়, এও বুঝিয়ে দিলেন যে এই মুহূর্তে টালিগঞ্জে তাঁর ধারেকাছে আর কেউ নেই। মেকআপ বিহীন মুখে তাঁর সংযমী অভিনয় জয়াকে অন্য চরিত্রগুলির তুলনায় অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ভাঙা বাড়ির সিঁড়িতে বসে জয়ার কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য ভীষণভাবে মূর্ত করে তুলেছেন তিনি। গোটা দৃশ্যে সোহিনীর দাপট এতটাই যে রুদ্রনীল প্রায় চোখেই পড়েন না। তবে স্বীকার করতেই হয়, অভিনয়ের দাবী মেনে নিজেকে নামিয়ে নেওয়ার বিরাট ক্ষমতাও রুদ্রনীল রেখেছেন এই দৃশ্যে।

আরেকজনের অভিনয় অনেকদিন মনে থেকে যাবে। তিনি হলেন অনির্বাণ। চরিত্রে বিশেষ কিছু করার সুযোগ না থাকলে আন্ডারঅ্যাক্টিং দিয়ে কিভাবে মনে ছাপ রেখে যাওয়া যায় তা আবারও দেখিয়ে দিলেন তিনি। ছবির শেষে গোয়েন্দাগিরির প্রমাণটুকু রাখা ছাড়া বিজয়ের আর বিশেষ কিছুই করণীয় ছিল না। তবু নায়ক হোক বা চরিত্রাভিনেতা, সব ক্ষেত্রেই যে তিনি অপরিহার্য তা আবারও বোঝালেন অনির্বাণ।

ছবির একটিমাত্র দৃশ্যে অসামান্য অভিনয়ে ঋদ্ধি আরও একবার জানান দিয়ে গেলেন আগামীদিনে টালিগঞ্জে তিনি কতটা অপরিহার্য হতে চলেছেন। সোমনাথ নিজেও হাজির মেকআপ সামগ্রীর বিক্রেতারূপে একটি দৃশ্যে।

তুখোড় অভিনেতাদের সমাহারে ‘ভিঞ্চিদা’র গল্পকে বাংলা ছবির সেরা থ্রিলারগুলোর সঙ্গে একাসনে বসিয়ে দিলেন সৃজিত। অনুপমের সুরে নোবেলের গাওয়া ‘তোমার মনের ভেতর’ গানটি কানে লেগে থাকে। অন্য গানের মধ্যে অনুপমের নিজের গাওয়া ‘গ্যাস বেলুন’ শুনতে ভালো লাগে। 

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
11

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *