সাম্প্রতিককালের অন্যতম সেরা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি
ছবি: বল্লভপুরের রূপকথা
পরিচালনা: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
অভিনয়ে: সত্যম ভট্টাচার্য, সুরাঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবরাজ ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তী, সন্দীপ ভট্টাচার্য, ঝুলন ভট্টাচার্য, কৃপানাথ চৌধুরী, সুরজিৎ সরকার, সুমন্ত রায়, শ্যামল সরকার
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৬ মিনিট
RBN রেটিং: ৪/৫
‘এক গপ্পো হাজারবার বললে, সে আর এক গপ্পো থাকে নে, পাল্টে-পাল্টে যায়।’ তবু বাদল সরকারের সৃষ্টি ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ হাজারবার পেশাদার মঞ্চে, শখের থিয়েটারে, অফিস ক্লাবে অভিনীত হয়ে যাওয়ার পর যখন প্রথমবার ছবির পর্দায় এলো, পরিচালক অনির্বাণ পাল্টালেন না কিছুই। শুধু বনেদিয়ানা, ভূত, মজা ও রোমান্স এমন অনুপাতে মেশালেন যে এ রূপকথাকে সাম্প্রতিককালের অন্যতম সেরা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি বলাই যায়।
বল্লভপুরের জরাজীর্ণ রাজবাড়ির বর্তমান বাসিন্দা রাজাবাহাদুর ভূপতি রায় (সত্যম)। ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ির মতোই তারও দৈন্যের দশা। দশ হাজার টাকা দেনা মাথায় নিয়ে কোনওরকমে পাওনাদারের এড়িয়ে সে দিন কাটায়। একমাত্র সঙ্গী বলতে বহু পুরাতন ভৃত্য মনোহর (শ্যামল)। অবশ্য আরও একজন আছেন ওই বাড়িতে, রঘুদা। এহেন ভূপতির একমাত্র উদ্দেশ্য রাজবাড়ি বিক্রি করে, দেনা মিটিয়ে কলকাতায় গিয়ে দাঁতের চেম্বার করা। এদিক সেই বাড়ি কেনা তো দূর, কেউ দেখতেও আসে না।
এক সকালে ভূপতির তিন বড় পাওনাদার—সাহা (কৃপানাথ), শ্রীনাথ (সুরজিৎ) ও পবন (সুমন্ত)—পাওনা আদায় করতে আসে। এমন সময় ভূপতি সমীপে একটি টেলিগ্রাম এসে পৌঁছয়। কলকাতার স্বপ্নাছন্দা সাবানের মালিক বিপি হালদার (সন্দীপ) সপরিবারে আসছেন রাজবাড়ি দেখতে। পছন্দ হলে উপযুক্ত দামে সেই বাড়ি কিনতে তিনি রাজি। ব্যস, শুরু হয়ে যায় হালদারমশাইকে খোশমেজাজে রাখার প্রস্তুতি। এরই মধ্যে কাকতলীয়ভাবে এসে উপস্থিত হয় ভূপতির কলেজের বন্ধু সঞ্জীব (দেবরাজ)। হালদারমশাইকে তুষ্ট করা, রঘুদার পরিচয় গোপন রাখা, সবমিলিয়ে এক হইহই কান্ড চলে গোটা ছবি জুড়ে।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
এই প্রথম ছবি পরিচালনা করলেন অনির্বাণ। ‘মন্দার’ ওয়েব সিরিজ়ে পরিচালক হিসেবে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’য় আরও কয়েক মাইল এগিয়ে গেলেন অনির্বাণ। এ ছবি যেন সিনেম্যাটিক থিয়েটার। কাহিনীতে পরিবর্তন না করে, শুধুমাত্র পরিবেশনের গুণে যে একটি বহুল জনপ্রিয় নাটককে ভিন্ন মাত্রায় উত্তরণ ঘটানো যায়, তা দেখিয়ে দিলেন তিনি।
অভিনয়ে প্রত্যেকে চমৎকার। সত্যমের চেহারায় এমনিতেই একটি জমিদারী ছাপ থাকায় এই চরিত্রের সঙ্গে তাঁকে বেশ মানিয়ে গেছে। দেবরাজ তাঁর নিজ পরিসরে যথাযথ, পরিমিত। মনোহরের ভূমিকায় শ্যামল অসাধারণ। বেশ কিছু দৃশ্যে হালদারমশাইয়ের চরিত্রে সন্দীপের অভিনয় উৎপল দত্তের কথা মনে করায়। সুরাঙ্গনা তাঁর নিজের মতোই সাবলীল। কৃপনাথ, সুরজিৎ, সুমন্ত এই ছবির অন্যতম সম্পদ।
আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ
ছবির গান অসম্ভব ভালো। বিশেষত ছবির শুরুতে বাদল সরকারের গানের ভিজ়্যুয়াল উপস্থাপনা ভীষণ মনোগ্রাহী। ছবি জুড়ে রয়েছে ইতিহাস। তবে অন্যান্য ছবির মতো এখানে ইতিহাসের ক্লাস করানো হয়নি। গল্পের সঙ্গে সময়ে-সময়ে তা উন্মোচিত হয়েছে।
গোটা ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ জুড়ে যত্ন ও দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। হাস্যরস, ভয়, পরাবাস্তবতার এক দুর্দান্ত মিশেল এই ছবি। বাংলা ছবির রিপিট ভ্যালু কমে যাচ্ছে বলে যাঁরা হা হুতাশ করেন, একবার হলেও তাঁদের ভুল প্রমাণ করবেন অনির্বাণ ও তাঁর দলবল।
ও হ্যাঁ, ছবির শুরুতে ধূমপান সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে একটি অভিনবত্ব রয়েছে। তাই ছবির শুরু মিস করা যাবে না কিছুতেই।