পাহাড়ের বাঁকে অজানা পাপের ইতিহাস
সিরিজ়: মার্ডার ইন দ্য হিলস
পরিচালনা: অঞ্জন দত্ত
অভিনয়ে: অর্জুন চক্রবর্তী, অনিন্দিতা বসু, সন্দীপ্তা সেন, সুপ্রভাত দাস, সৌরভ চক্রবর্তী, রাজদীপ গুপ্ত, রজত গঙ্গোপাধ্যায়, শাশ্বতী গুহঠাকুরতা, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, অপরাজিতা ঘোষ, অঞ্জন দত্ত
দৈর্ঘ্য: ৩ ঘন্টা ৪৮ মিনিট (৮ পর্বে)
RBN রেটিং: ৩/৫
দার্জিলিং শৈলশহর হলেও তার নিজস্ব কিছু চেনা উষ্ণতা আছে। পাহাড়ের কোলে ছবির মতো ছোট্ট শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি, স্টেশন চত্বর, অবজ়ারভেটরি হিলের রাস্তা, জলাপাহাড় রোড এই সবই বাঙালির আজন্ম চেনা। আসলে রোদে ঘামে বিরক্তিতে তেতে পুড়ে বাঙালি সারা বছর তার এই একান্ত নিজস্ব হিল স্টেশনেই বারবার ফিরতে চায়। তাই সেই খুব চেনা গলি থেকে রাজপথ খুঁজে নিতে তাঁরা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার যে কোনও সময় দার্জিলিং পাড়ি দিতে পারেন। এই শহরটাকে নিয়ে বাঙালির রোমান্টিকতা বোধহয় শেষ হওয়ার নয়। তবু এই সাজগোজ করা, খুব চেনা শহরের ভেতর আর একটা অচেনা শহরও আছে। সে শহরটা নোংরা, ঘিঞ্জি আর জটিল।
সেই অচেনা শহরের কিছু অচেনা মানুষের গল্প শুরু হয় প্রাক্তন তারকা অভিনেতা টোনি রায়ের (অঞ্জন) ৬৬তম জন্মদিনের পার্টিতে। স্বভাবে অতিরিক্ত উচ্ছল ও নাটুকে টোনি পরিচিত ছ’জনকে তার জন্মদিনের সান্ধ্য পার্টিতে আমন্ত্রণ জানায়। এই ছ’জন হলেন ক্রাইম থ্রিলার লেখক রঞ্জন গাঙ্গুলী (রজত), নেপালি ভাষার শিক্ষিকা শীলা (অনিন্দিতা), প্রাক্তন ফুটবলার ও স্পোর্টস টিচার বব দাস (সুপ্রভাত), ডাক্তার নিমা প্রধান (সন্দীপ্তা), পরিচালক বিজয় মুখার্জী (সৌরভ) ও ডেপুটি এসপি শুভঙ্কর ব্যানার্জী (রাজদীপ)। এর সঙ্গেই পার্টিতে শীলার অতিথি হয়ে আসে তার বয়ফ্রেন্ড অমিতাভ (অর্জুন)। কিন্তু অচেনা কেউ টোনির মতো তারকার ব্যক্তিগত পার্টিতে এত সহজে ঢুকে পড়বে! তাই মজা করেই সে অমিতাভর সঙ্গে এক অভিনব খেলা শুরু করে। টোনি জানায়, আজ একজনকে খুন করার জন্য এই পার্টিতে ডাকা হয়েছে। অমিতাভকে বলতে হবে সেই ব্যক্তি কে।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
আজব খেলার ফাঁদে পড়ে সকলেই শুরুতে মজা পেলেও পরে অস্বস্তিতে পড়ে। এইসব চলতে চলতেই একসময় হঠাৎ টোনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং মারা যায়। হৃদরোগে মৃত্যু বলে ধরে নেওয়া হলেও অমিতাভর সন্দেহ হয় টোনির মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। সে হালকা চালে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। হঠাৎই তার হাতে আসে তিরিশ বছর পুরোনো একটা ডায়েরি, যা ১৯৯১ সালে লিখেছিল তরুণ বোস নামে এক সাংবাদিক। এই ডায়েরি থেকে টোনি ও তার বাবা রাজা রায় সম্পর্কে রীতিমতো চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে অমিতাভর হাতে । উঠে আসে শৈবাল সেন, অরুণা সেন, উদয় লামা আর ডাক্তার রিমা ব্যানার্জীর মৃত্যুর কাহিনী।
আরও খুঁজতে শুরু করে অমিতাভ। তার মনে হয় সেদিনের পার্টিতে যারা ছিল তাদের মধ্যেই কেউ এই খুনের জন্য দায়ী, কিন্তু খুনের কারণ জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে তিরিশ বছর আগের ঘটনায়। একে-একে সে সকলের মুখোমুখি হতে থাকে। এদের মধ্যেই কি কেউ খুনি নাকি মেঘনাদের মতো আড়ালে থেকে সমস্ত খেলা পরিচালনা করছে কোনও এক প্রদীপ জয়সওয়াল? একটার পর একটা বিপদের মুখোমুখি হয়েও সঠিক জায়গা থেকে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে অবশেষে একসময় অমিতাভ তার কলকাতার কাগজের ফ্রন্ট পেজের ব্রেকিং স্টোরি লিখতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
পাহাড়ের রানীকে ঠিক যতরকমভাবে দেখালে তার সৌন্দর্যের প্রতি সুবিচার করা যায়, তার সবটাই এই সিরিজ়ে করে ফেলা হয়েছে। গোটা সিরিজ়টাই অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন লেগেছে বললে ভুল বলা হয় না। সিরিজের সবকটি গানই অঞ্জন ও নীল (দত্ত) ঘরানার হলেও তা বেশ কিছুটা অন্যরকম এবং রেশ রেখে যায়। আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হয় শীর্ষসঙ্গীতের। সিরিজ়ের মেজাজের সঙ্গে ভীষণভাবে মানানসই সঙ্গত করেছেন নীল।
তবে অনেকটা সময় ধরে দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন দিককে তুলে ধরার জন্য গল্প কিছু জায়গায় তার গতি হারিয়েছে। প্রতিটা পর্ব শেষ হয় পরেরটায় কী হবে এই কৌতূহল নিয়েই, যদিও মাঝপথে সেই টান টান উত্তেজনা কিছুটা যেন থিতিয়ে পড়ে। চেষ্টা করলে পর্ব সংখ্যা কিছুটা কমিয়ে রহস্যের সমাধান করা যেত। থ্রিলার কাহিনীর বেশি আলোচনায় রহস্য উন্মোচনের আশঙ্কা থেকেই যায়। তবু যতটা সম্ভব স্পয়লার না দিয়ে এটুকু বলা যায় যে ম্যানেজারের ভাইয়ের উপস্থিতির কারণ আরও একটু জোরালো হলে ভালো হতো। একই সঙ্গে রমার নেপথ্য ইতিহাস দেখানো গেলে দর্শকের বুঝতে সুবিধা হতো।
অভিনয়ে প্রত্যেকেই তঁদের চরিত্রের প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করেছেন। অর্জুন, অনিন্দিতা ও সুপ্রভাত অসাধারণ। ভালো লেগেছে রাজদীপ, সৌরভ ও সন্দীপ্তাকেও। রজতকে এমন ভূমিকায় আগে দেখা যায়নি, তাই তাঁর অভিনয় যথেষ্ট চমক লাগায়। শাশ্বতী তাঁর ভূমিকায় যথাযথ। ছোট ভূমিকায় অঞ্জন তাঁর নিজের মতোই অপ্রতিরোধ্য। আলাদাভাবে উল্লেখ্য টোনির অল্পবয়সী চরিত্রে সুহোত্রর অভিনয়। চেহারায় অঞ্জনের সঙ্গে মিল না থাকলেও শরীরী ভাষায় তিনি বিশ্বাসযোগ্যভাবে টোনিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এরই সঙ্গে বলতে হয় এই চরিত্রের ডাবিং অঞ্জন নিজে করায় চরিত্রটি খুব সহজে বয়স্ক টোনির সঙ্গে মিশে যায়।
পাহাড়ের কোলে ‘ব্যক্তিগত’ হত্যারহস্যের প্রতিটি বাঁক বেশ আলাদা ধরনের উত্তেজনা এনে দেয়। পরবর্তী সিজ়নে অমিতাভর অন্যরকম কোনও স্টোরির অপেক্ষা থাকবে।