পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

কথা, কথাকলি, কাহিনী ও অবশেষে কাহিনীর দৃশ্যায়ন। ভেবে দেখলে বোঝা যায়, আদি ও আবহমান কাল ধরে অর্থপূর্ণ ধ্বণি অর্থাৎ ভাষা উৎপত্তি হওয়ার পর থেকে তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে মানব জীবনে। তাকেও বিভিন্ন বিপর্যয় পেরিয়ে অবশেষে চলিত রূপে সম্মান আদায় করতে হয়। কিন্তু বিপর্যয় বা পরিবর্তনই স্থায়ী, এ কথা কে না জানে? মানব জীবন ও সভ্যতা নিজেও যেহেতু বহু বিপর্যয় মাথা নত করে স্বীকার করে নিতে বাধ্য থাকে, তাই সে চারপাশের সব কিছুকে, এমনকি এই ভাষাকেও ভেঙে নতুন-নতুন ভাষার আমদানী করে থাকে। কারণ নবীনের স্বাগত চিরকাল, তা সে ভাষার ক্ষেত্রেই বা হবে না কেন?

কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা যা বলি, যেভাবে বলি, একটা সময় অবধি খুব কম ক্ষেত্রেই দৃশ্যায়নে তার ব্যবহার ঘটেছে। আর সেই ভাষা বাস্তব ও মাধুর্যের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়েছে, তার হার শতকরা আরও কম।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি অবধি নির্মল দে, তপন সিংহ, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, তরুণ মজুমদার ও আরও অনেকে সেই বাস্তব সমন্বিত মাধুর্যের মেলবন্ধন উপহার দিয়েছেন। তারপরে যদিও স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরী লাগাতার গ্রাম বাংলার দর্শককে তাদের দৈনন্দিন দীন-হীন জীবনের গায়ে সংলাপের চাবুক মেরে হলমুখী করছেন, তবুও একটা সময় এল যখন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি দর্শক বছরের শতকরা আটানব্বই/ নিরানব্বই শতাংশ সময় তাঁদের জীবনের প্রতিফলন হিসেবে একটা ভালো কাহিনীর বাস্তব দৃশ্যায়ন পাননি। ফলে ধীরে-ধীরে বাংলা ছবির বাস্তবতা যেমন হারাচ্ছিল, তেমনই শিক্ষিত বাঙালি দর্শকও নিজেদের উপযুক্ত মননের, রুচিশীল বাস্তবধর্মী সেরকম কোনও ছবি না দেখতে পাওয়ায়, একরাশ সৃজনশীলতার খিদে পেটে নিয়ে বাংলা ছবির প্রতি ব্যাজার মুখ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। কারণ সব ছবি কোনওভাবেই সবার জন্য হতে পারে না, এটা মেনে নিতেই হবে। ‘ক্লাস’ আর ‘মাস’ কোনওদিনই একসাথে একটা ছবি দেখতে পারেন না। ক্লাসের যেখানে একটু মেধার স্পর্শ প্রয়োজন, মাসের সেখানেই কোনওমতে দৈনন্দিন সংগ্রামের মুখে একটা ভালো থাকার মত যোগ্য জবাব পেলেই হল। এখন প্রশ্ন উঠল, তাহলে সত্যজিৎ পরবর্তী যুগে বাংলা ছবির কি আর কোনও ভবিষ্যত নেই? বাঙালির এই এত শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্রে সমৃদ্ধ মেধাভান্ডার কি তাহলে ধীরে-ধীরে ফুরিয়ে এল?

বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ

সালটা ১৯৯৪। বছর দুয়েক হল সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এর পর বুদ্ধিজীবি বাঙালি দর্শককূল যখন সবে ভাবা শুরু করেছে, তবে কি আর কিছু দেখেশুনে মন ভরানোর নেই, ঠিক তখনই ১৪ মার্চ মুক্তি পেল ‘উনিশে এপ্রিল’, পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। প্রায় আনকোরা নতুন ঠেকল দর্শকের কাছে নামটা, কারণ তাঁর প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ সেভাবে প্রচার পায়নি। কিন্তু তৎকালীন জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা চারজন অভিনেতা ও অভিনেত্রী একত্রে—অপর্ণা সেন, দীপঙ্কর দে, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও দেবশ্রী রায়—একজন প্রায় নতুন পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করেছে! তাহলে তো দেখতেই হচ্ছে ছবিটা।

ঠিক এই ভাবনার সাথে হাজার-হাজার বাঙালি দর্শক যখন সাদরে বরণ করে নিচ্ছেন এই ছবিকে, তখন কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যেগুলি পাওয়া গেল তা সত্যিই আজ এই পঁচিশ বছর বাদেও খুব সাধরণভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতায় উনিশে এপ্রিল দেখলে মনে পড়ায় এক প্রৌঢ়া ও তাঁর কন্যার মধ্যে অভিমানের মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়া সম্পর্কের কিছু নরম, চলতি জীবনের মিঠেকড়া কথোপকথন। যে কথোপকথনে কড়া হতে গিয়েও নিজের অজান্তেই মায়ের হাঁটুর ব্যথার কথা মনে করিয়ে দেয় সদ্য ডাক্তারি পাশ করা মেয়ে। পরের বছর শ্রেষ্ঠ ছবি ও শ্রেষ্ঠ নায়িকার জাতীয় পুরস্কার ছিনিয়ে নেয় এই ছবি।

খেল দিখা সকোগে না?

উনিশে এপ্রিলের হাত ধরে ঋতুপর্ণর পরিচালক জীবনের তিনটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম অধ্যায়ের সূচনা। এই অধ্যায়ে মধ্যবিত্ত জীবন পরিসরে নারী ও বিভিন্ন সম্পর্কের নিজস্ব মনস্তত্ত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণ অর্থবহ, বাস্তবিক ও ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। পরে অবশ্য তিনি তাকে আরও বৃহৎ ব্যাপ্তির পথে নিয়ে যান ‘দহন’, ‘উৎসব’, ‘অসুখ’, ‘বাড়িওয়ালি’, ‘তিতলি’ এবং ‘আবহমান’ ছবিতে, প্রতিটি দৃশ্যের দৃশ্যায়ন, গান ও সংলাপের এক অদ্ভুত তাল, লয়, ছন্দকে একত্রিত করে সুরমূর্চ্ছনার মতনই সমান আবহে পরিবেশন করে।

ঋতুপর্ণ তাঁর পরিচালক জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর নিজের চোখ দিয়ে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেন, অর্থাৎ রবি ঠাকুরের উপন্যাসকে অনু পরমাণুতে ভেঙে নিজের মনের মতন সাবলীল ভাষায় দর্শকের ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিলেন ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’ ইত্যাদি ছবির মধ্যে দিয়ে। ছবি পরিচালনার তৃতীয় অধ্যায়ে সমকামী সম্পর্কের দুঃখ, যাতনা, চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি যে আর পাঁচটা সম্পর্কের মতনই স্বাভাবিক, তাও প্রমাণ করে গেলেন ঋতুপর্ণ।

যে জন থাকে মাঝখানে

কিন্তু এত সৃষ্টির মধ্যেও তাঁর প্রথম জাতীয় স্তরে খ্যাত হওয়ার যোগ্যতা রেখেছিল যে ছবি, সেই ‘উনিশে এপ্রিল’ দর্শকের হৃদয়ের মাটি কেটে জল বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম আজও। আমরা বাঙালিরা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’। সেই প্রবাদের মুখে কালি ছিটিয়ে দেয় ‘উনিশে এপ্রিল’। মা মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিনী হয়েও নিজের শিল্পে জগৎব্যাপী ভাস্বর। মেয়ে ছোট থেকেই মায়ের স্নেহবঞ্চিতা, বাবা মারা যায় বাল্যকালেই। হস্টেল জীবন সেই মা-মেয়ের সম্পর্কে অভিমান আরও যেন উচ্চতম শৃঙ্গ শিখরের মাথা অবধি ছুঁইয়ে দেয়। বাবার মৃত্যুর ঠিক দশ বছর পর সেই অভিমানের ঘনত্ব আরও বেড়ে যায় যখন মা সঙ্গীত নাটক আকাদেমী পুরস্কার পায়। একই সঙ্গে মেয়ের প্রথম আত্মসমর্পণকারী ভালোবাসাও ছেড়ে চলে যায় সেই মায়েরই শিল্পখ্যাতির কারণে।

এই জটিল পরিস্থিতি কে আগে রচনা করেছিল তা সত্যিই জানা নেই। তবে এক্ষেত্রে স্রষ্টা ঋতুপর্ণ শেষমেশ পরিস্থিতির জটও খুললেন শুধু একটা আশ্বাস বাক্যে। মা হিসেবে অপর্ণা বলেন, ‘সুদীপ ফোন করেছে। ঝগড়া কোরো না, দরকার হলে আমাকে ডেকো।’ মেয়েও মায়ের অন্য ছাত্রী সঙ্গীতার মুখ থেকে তাঁর হাঁটুর ব্যথার কথা শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সেই অভিমান যাকে আসলে আমরা ঘেন্না ভাবি, বুঝি না তার ঠিক নীচ দিয়েই কত স্নেহ, ভালোবাসা অন্তঃসলিলা হয়ে বয়ে যাচ্ছে।

তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে

ঋতুপর্ণ নিজে একজন নারী মননশীল ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু অন্য সব স্বত্ত্বা ছাপিয়ে তাঁর শিল্পস্বত্ত্বাই বেরিয়ে আসে। তাই তিনিই হয়ত ভালো বুঝেছেন, শিল্পীরও সংসার করার স্বপ্ন থাকে। কিন্তু ‘এক জীবনে কি সব পাওয়া যায়?’ এই সংলাপও তিনিই তাঁর ছবির নায়িকার মুখ দিয়েই বলালেন। আবার কারোর জন্য সব ত্যাগ করলেও সংসার জোটে না। কারণ মানুষটা হয়ত একজন শিল্পী বা বিখ্যাত গুণী ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে থাকার যোগ্যই হয়ে উঠতে পারে না। আশেপাশে এত বেশি মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ ঘুরে বেড়ায় যে তাঁদের আলাদা করে পুরুষ বা নারী মনন দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না। তাদের ওই একটিই পরিচয়, তারা মানসিক ভাবে মধ্যবিত্ত তাই তাঁরা ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ বা হীনমন্যতায় ভুগেই সারা জীবন কাটিয়ে দেন। শিল্পীর সঙ্গে থাকা যায়, কিন্তু তাঁর স্বত্ত্বাকে আগলে, উদ্‌যাপন করে খুব কম মানুষই জীবন কাটাতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে ‘আমি তো তোমার মত বিখ্যাত লোক নই, লোকে এসে আমার অতগুলো ছবি এক জায়গায় দেখলে আমার লজ্জা করবে’ এই কথা আসাটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ সত্যিই তো ‘শুধু মারধোর করলেই বুঝি খারাপ লোক হয়?’ কি অবলীলায় খুব সাধরণ কথাগুলো দিয়ে ঋতুপর্ণ বুঝিয়ে দেন, একজন মধ্যবিত্ত মানুষের সঙ্গে কোনও শিল্পী ঘর বাঁধলে শুধুমাত্র হীনমন্যতার কারণে একটা বিরাট সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

সত্যজিতের প্রভাব ঋতুপর্ণর প্রায় প্রতিটি ছবিতেই। বাংলা ছবিতে যখন নাচগান আর মেলোড্রামা নামক অতিরঞ্জিত দৃশ্যায়নের পিছনে কথায়-কথায় আবহ সঙ্গীতের অত্যাচারে কান পাতা দায়, তখনই ঋতুপর্ণ আবার আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দুই ঘন্টা আঠারো মিনিটের একটা সুস্থ পরিবেশ দিলেন যেখানে অযথা চড়া আবহের অত্যাচার নেই। বরং ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের কিছু প্রয়োজনমূলক ব্যবহার ‘উনিশে এপ্রিল’-কে আরও সমৃদ্ধ করল। বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া খুব সাধারণ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ সংলাপ, যেমন ‘তোমার সময় কবে ছিল আমার কথা শোনার?’ বা ‘ডাক্তারী পড়তে অনেক খরচ, তুমি জানো নিশ্চই?’ অথবা ‘এত টাকার গরম ভালো না মা’ এই কথাগুলোর অত্যন্ত স্থিতধী ব্যবহার ছবিতে যেমন আধুনিকতা ও রুচিশীলতার মাত্রা যোগ করে তেমনই দর্শককে নিজের ঘরের দৈনন্দিন সন্তান লালনকারী বাক্যগুলো মনে করিয়ে দেয়। বাংলা ছবির সত্যজিৎ পরবর্তী যুগে ঋতুপর্ণ তাঁর নিজস্ব স্বাক্ষর রেখে যান সেখানেই।




অভিমান শব্দটার সঠিক কোনও ইংরাজি প্রতিশব্দ হয় না। এ এক আদ্যন্ত বাংলা শব্দ, আর সেটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসলে বাঙালি মা-মেয়ের মধ্যেও তীব্র অভিমান গাঢ় হতে পারে, যা প্রেমের মতই খুবই হৃদয় বিদারক। শিক্ষিত সভ্য সমাজে সেই ঝগড়া আসলে সম্পর্ক শৈত্য, যার ফলে প্রিয়জনের কোলে মুখ গুঁজে শুধুমাত্র ‘না, তুমি এখন যাবে না’, এই দাবীটা করে বসতেও সারা জীবন লেগে যায় অথবা জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে ছবির শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হতে হয় ঋতুপর্ণর মত বাস্তববাদী পরিচালককে। আসলে এই একটি সংলাপের সময়োপযোগী ব্যবহারেই তিনি জীবন আর সিনেমাকে এক ক্যানভাসে এঁকে ফেলেন।  

ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘উনিশে এপ্রিল’ গ্রীষ্মের তপ্ত হাওয়ায় দুলতে-দুলতে জানান দেয় তাঁর প্রথম সাফল্যের আজ পঁচিশ বছর হয়ে গেল। বাকি এই মহামানব সভ্যতায় সুদীপের ফোনের মতই তুচ্ছ অনুভূতি, আবেগের আসা-যাওয়া চলতে থাকবে। কিন্তু দিনের শেষে এক প্রৌঢ়া স্বনামধন্যা নৃত্যশিল্পী মা আর তাঁর কৃতী সন্তানের দূরত্বের বোঝাপড়া মিটিয়ে আজ তাদের কাছের আসার পঁচিশ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন। আজকের দিনে স্রষ্টার অমরত্ব লাভের যৌবনকাল হয়ে থাকুক ‘উনিশে এপ্রিল’।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Indrani

Lover of soft music where words play a pivotal role. Indian classical, Tagore, and Bengali oldies seizes her heart immediately. Classics, periodical fiction can lie her down the whole day. Opiumated on Khaled Hossaini, Shirshendu Mukhopadhyay, and Sunil Gangopadhyay

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *