আমি হলাম সৃজিতের ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো: পরমব্রত

সৃজিত মুখোপাধ্যায় (Srijit Mukherji) পরিচালিত বিভিন্ন ছবিতে তিনি ফিরে-ফিরে আসেন। কিন্তু সৃজিত পরিকল্পিত এমন কিছু চরিত্র যেখানে তাঁকে আগে ভাবা হয়নি, সেখানেও শেষমেশ তাঁকেই ডেকে পাঠানো হয়। নিজেকে সৃজিতের ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’ বলতে ছাড়েন না পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় (Parambrata Chattopadhyay)। সৃজিতের ‘সত্যি বলে সত্যিই কিছু নেই(Shotyi Bole Shotyi Kichhu Nei) ছবিতে তিনি আছেন একজন রূপান্তরকামী পুরুষের চরিত্রে। ট্রেলার মুক্তির দিন রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ছবির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা কথা জানালেন পরমব্রত। 

প্রশ্ন: এরকম একটা তারকাখচিত ছবিতে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা আর পাঁচটা ছবির থেকে অনেকটাই আলাদা হয়, তাই নয় কি?

পরমব্রত: বিষয়ের দিক থেকে আলাদা তো বটেই, এছাড়াও এরকম সব সহঅভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করা একটা রিইউনিয়নের মজাও দেয়। সেদিক থেকে আলাদা অবশ্যই। ইন্ডাস্ট্রিতে তো কম দিন হলো না আমার। এই ছবির সেটে ফাল্গুনীদা (চট্টোপাধ্যায়) আর দুই কৌশিকদাকে (গঙ্গোপাধ্যায় ও সেন) বাদ দিলে আমি অনেকের থেকেই সিনিয়র। ঋত্বিক (চক্রবর্তী), কাঞ্চনদা (মল্লিক) বা অনন্যার (চট্টোপাধ্যায়) মতো কেউ-কেউ সমসাময়িক আছেন। এদের অনেকের সঙ্গেই দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। একসঙ্গে কাজ করতে পারলে খুবই ভালো লাগে। 



প্রশ্ন: ট্রেলার দেখে মনে হলো তোমার অভিনীত চরিত্রটা বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা, তোমার নিজের কী মত? 

পরমব্রত: এ ছবিতে আমিই একমাত্র চরিত্র যে ঘরভর্তি ভিন্নমতের লোকের মাঝে হাত তুলে বলতে পারে, না, আমি আপনাদের মত সমর্থন করছি না। আজকের পৃথিবীতে আমরা যা দেখছি, অধিকাংশ মানুষের মত যেদিকে ধেয়ে যায়, পপুলার ওপিনিয়ন যাকে বলা হয়, সাধারণ মানুষের একটা প্রবণতা আছে সেদিকে মতামত দেওয়ার। সেটা সোশ্যাল মিডিয়া হোক বা অন্য কোথাও। মানুষের মনে হয় জনপ্রিয় মতের সঙ্গে গেলে প্রাসঙ্গিক থাকা যাবে। কিন্তু গণতন্ত্রে একটিমাত্র মানুষের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। আমার চরিত্রটি সেই ভিন্নমতকে জোর গলায় বলার ক্ষমতা রাখে। আর সেই কারণেই ছবির গল্পটা শুরু হয়। এই চরিত্রটা যদি আপত্তি না জানাত তাহলে দশ মিনিটে গল্প শেষ হয়ে যেত। কারণ সেক্ষেত্রে সকলেই একমত হতো। এই একজনের কারণেই আলোচনা শুরু হয়। এই যে এতজন মিলে আলাপ আলোচনা এবং তথ্যপ্রমাণ সমেত যুক্তি দিয়ে কথাবার্তার মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটা এগিয়ে যেতে থাকে, সেটা এই চরিত্রটাই ঠিক করে দেয়।

প্রশ্ন: ব্যক্তিগত জীবনে পরমব্রত স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কথা বলে কি? 

পরমব্রত: সৌভাগ্যক্রমে বলো বা দুর্ভাগ্যক্রমে, এমন একটা অভ্যেস আমার চিরকালই আছে, যে কারণে ছোটবেলা থেকে একটা উপাধি আমার জুটেছে, ‘পাকা পরম’ (হাসতে-হাসতে)। সেটা এই সব জায়গায় ‘তবে’, ‘আসলে’, ‘ইত্যাদি’ বলে নিজস্ব মতামত দেওয়ার অভ্যাসের কারণে। সেটার জন্যই এই বিশেষণটা আমার নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে অনেকদিন ধরেই। প্রথম-প্রথম বেশ খারাপ লাগলেও এখন কিন্তু এই নামটার জন্য গর্ববোধ করি।

আরও পড়ুন: ‘আশিকি ৩’ ছাড়লেন তৃপ্তি দিমরি

প্রশ্ন: এই ছবিতে তোমার অভিনীত চরিত্র নিয়ে তুমি খুশি? 

পরমব্রত: আমি হলাম সৃজিতের ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। তার কারণটা বলি। এই ছবিতে প্রথমে আমার এই চরিত্রটা করার কথা ছিল না। সৃজিত মাঝে-মাঝে বলতো, তুই এই চরিত্রটা কর, মানে ওর ভাষায় বলতো তুই আট নম্বর বা ন’নম্বর জুরি কর। কিন্তু আমার সেটা পছন্দ হতো না। তখন ও বলতো, তাহলে থাক। আমিও বলতাম, বেশ থাক। হঠাৎ করে গতবছর মে মাসে ফোন করে বলল, শোন তোর অমুক সময়ে কী অবস্থা থাকবে? আমি তখন গুজরাটে একটা হিন্দি ছবির শুটিং করছি। বললাম, আবার তুমি ওই ছবিটা নিয়ে ফোন করেছ? তখন বলল, হ্যাঁ ওই ছবিটাই কিন্তু এবার তোর পছন্দের চরিত্রটাই তোকে দেব। তখন আমি বললাম, তাহলে এবার ভেবে দেখা যেতে পারে। 

প্রশ্ন: তার মানে এই চরিত্রটাই করতে চেয়েছিলে শুরু থেকে? 

পরমব্রত: আসলে আমার তিনটে চরিত্র খুব পছন্দের ছিল। এর মধ্যে যে কোনও একটা পেলেই রাজি হয়ে যেতাম। তার মধ্যে প্রথমটা সম্ভব ছিল না কারণ ওটার জন্য আমার থেকে কিছুটা বেশি বয়স্ক অভিনেতার প্রয়োজন ছিল। সেটা করেছেন কৌশিকদা (গঙ্গোপাধ্যায়)। এছাড়া ঋত্বিক যে চরিত্রটা করেছে, সেটাও আমার খুব পছন্দের ছিল। আর এখন যে চরিত্রটা করেছি সেটা তো সবসময়ই পছন্দের।

আরও পড়ুন: বাস্তুচ্যুত প্রান্তজন, নর্মদা ‘পরিক্রমা’য় দেখালেন গৌতম

প্রশ্ন: ২০১১ সালে প্রথম চিত্রনাট্য শোনার পরে এই চরিত্রটাই ঋতুপর্ণ ঘোষের করার কথা ছিল সেটা জানতে? 

পরমব্রত: সেটা জানতাম না। শুনেছিলাম ঋতুদার এই ছবিতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেটা যে এই চরিত্রে সেটা জানা ছিল না। ‘চতুষ্কোণ’ ছবিতেও এরকম একটা ব্যাপার হয়েছিল। যে চরিত্রটা ওঁর করার কথা ছিল সেটা পরে আমি করি। তবে এটা পুরোপুরি কাকতালীয় একটা ব্যাপার। আমার কাছে যখন চরিত্রটা আসে, সৃজিত বলেছিল আমি এটা এভাবে দেখছি, আমি সেইভাবেই চরিত্রটা তৈরি করেছিলাম।

প্রশ্ন: নিজের দৈনন্দিন অভ্যাসের বাইরে গিয়ে একটা বিশেষ ধরনে কথা বলা বা আচরণ করা এটা নিশ্চয়ই বেশ কঠিন

পরমব্রত: সহজ তো ছিলই না। দেখো, নারীসুলভ পুরুষ যারা, তাদের সম্পর্কে সমাজের একটা বাঁধাধরা ধারণা আছে যে এরা এভাবে কথা বলে বা এরকম ভাবে। এই তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার বা তাদের হয়ে কথা বলার সময় এসেছে সেটা আমরা সকলেই জানি। এখন লোকে যেটা ভাবে এদের সম্পর্কে সেটা তো আমি দু’ঘন্টার ছবিতে ভাঙতে পারব না। কিন্তু সেই ধারণাকে বাঁচিয়ে রেখে এই ধরনের চরিত্রের মনের কথা বলতে পারা, এটা বেশ কঠিন ছিল। 

আরও পড়ুন: হাফপ্যান্ট পরে অভিনয়, কিশোরের প্রস্তাবে সত্যজিতের অট্টহাসি

প্রশ্ন: এতদিনের এত কথাবার্তার পর অবশেষে ছবিটা মুক্তি পেতে চলেছে। কেমন লাগছে?

পরমব্রত: আমি খুবই একসাইটেড। আমার অভিনীত চরিত্রটা নিয়েও। অনেকদিন ধরে তো অভিনয় করছি। পরিচালনা এবং প্রযোজনায় এসেছি অনেক পরে। তবে সত্যি বলতে কী সাম্প্রতিককালে পরিচালনা-প্রযোজনার কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন আমি আর যে কোনও চরিত্রে অভিনয় করি না। থোড় বড়ি খাড়া চরিত্র করতে এখন আর ইচ্ছা করে না। এই জায়গায় এসে এখন মনে হয় কোনও চরিত্র যদি আমার মাথায় যেটুকু গ্রে ম্যাটার আছে সেটাকে নাড়া না দেয়, তাহলে আমি সেটা করব কেন? এই ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছিল এতজন অভিনেতা থাকা সত্ত্বেও কোনও ইনসিকিউরিটি আমার মধ্যে কাজ করবে না। বরং এখানে প্রত্যেকের কাজই আলাদাভাবে চ্যালেঞ্জিং ছিল। তাই এই ছবিটা নিয়ে আমি সত্যিই বেশ একসাইটেড।  

ছবি: RBN আর্কাইভ

Anurag Kashyap

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *