তিন নারীর উত্তরণের গল্প
ছবি: মিনি
পরিচালনা: মৈনাক ভৌমিক
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৫ মিনিট
অভিনয়ে: মিমি চক্রবর্তী, অয়ন্না চট্টোপাধ্যায়, মিঠু চক্রবর্তী, কমলিকা বন্দোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি মৌলিক, রুদ্রজিৎ মুখোপাধ্যায়
RBN রেটিং: ৩/৫
আমার সঙ্গেই কেন এমনটা হলো? আমাকে কি কেউ কোনওদিন বুঝবে না? আমি বোধহয় হেরে গেলাম। সব সমালোচনা শুধু আমাকে ঘিরেই! এরকম ভাবনার আনাগোনা সব মানুষের মনেই অল্পবিস্তর থাকে। এসব আপেক্ষিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হারিয়েও যায় অনেকে। আবার অনেকে ঘুরে দাঁড়ায় সমালোচনার চোখ রাঙানি, লোকে কী বলবে, এসবের ঊর্ধ্বে। তাঁরা আত্মবিশ্বাসের বলে ডানা মেলে, আলো হয়ে ওঠে। ঠিক যেন ‘মিনি’র মতোই। মৈনাকের ‘মিনি’তে গল্পের মেঘ জমে উঠেছে মানুষের এই অন্ধকার ভাবনাগুলো নিয়েই।
ছোট্ট মিনির (অয়ন্না) বাবা-মায়ের সম্পর্কটা প্রথম থেকেই স্বাভাবিক ছিল না। সে তাদের বেশিদিন একসঙ্গে পায়নি। এ নিয়ে নিজের মনখারাপের কথা সে বলে না কাউকেই। এমনকী নিজের দিদাকেও (মিঠু) না। একদিন বাড়িতে একটা চিঠি আসে। মিনির মায়ের (কমলিকা) কাছে সেই চিঠি ছিল একটা বড় আঘাত। ভালোবাসা, মানসিক নির্ভরতা তার এতটাই বেশি ছিল যে স্বামীর দ্বিতীয়বারের বিয়েটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আরও পড়ুন: উজ্জ্বয়িনী, মনোময়, রূপঙ্করের ইউএমআর
এরপর ভীষণ বদলে যায় ছোট্ট মিনির জীবন। মায়ের মানসিক অবস্থা প্রভাবিত করে মিনিকে। ছোট্ট মিনির দায়িত্ব পড়ে মাসির (মিমি) ওপরে। মিনির মাসি ফ্যাশন ডিজ়াইনার, কাজের চাপ অনেক। তার কর্পোরেট জীবনযাত্রা পরিবারের পছন্দ নয় মোটেও। অগত্যা তাকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকতে হয়। জীবনে প্রেম থাকলেও, তার স্ট্যাটাসটা বেশ ঘাঁটা। এরই মাঝে হঠাৎ করে দিদির মানসিক সমস্যা, বোনঝির দায়িত্ব, তাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। যে মানুষটাকে আজীবন সবাই অকেজো বলে দাগিয়ে এসেছে, সে কীভাবে স্বপ্ন দেখবে একটা বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়ার? শুরু হয় সমালোচনা।
আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান
তবে পথে নামলে হাত জুটে যায় ঠিক। বন্ধুসম সহকর্মীর অনুপ্রেরণায়, বোনঝিকে খুশি করার জন্য চেষ্টা করতে থাকে ডানা মেলতে চাওয়া, সাধারণ সেদ্ধ ভাত তৈরি করতে না পারা এক তরুণী। বোনঝিকে খুশি করার সে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। তার মায়ের দায়িত্ব পালন করে। বিরক্ত হয় মিনি। সে নিজের কিন্তু মনের কথা বলতে পারছিল না। মাসির এইসব অতিরঞ্জিত প্রচেষ্টা তার কাছে একেবারেই না-পসন্দ। স্কুলে প্রতি মুহূর্তে তাকে বাবার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে গঞ্জনা কথা শুনতে হয়। এই পরিবেশ মিনিকে ক্রমশ রূঢ় করে তোলে।
মানুষের মনন অবাক করে। দুটি মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের দায় গিয়ে পড়ে পরিবারের ছো্ট্ট সদস্যটির ওপর। ভয় লাগে, কারণ এই মানুগুলোই তো সমাজটা তৈরি করেছে। মৈনাকের মতো পরিচালক জীবনের রোজকার বোঝাপড়া নিয়ে কথা বলছেন দেখে আশাও জাগে।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
তবু এগিয়ে চলে মিনি। মাসির সঙ্গে তার সম্পর্কটা সহজ হতে থাকে। দুজনে সহজভাবে কথা বলতে শুরু করে। মন বিনিময় হতে থাকে। মাসির জটিল সম্পর্ক আর মিনির ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, সবকিছুর মধ্যে দিয়ে দুজনে কাছে আসতে থাকে। দুটি ভিন্ন মানুষের কিছু ব্যক্তিগত না পাওয়া যেন হয়ে ওঠে তাদের মনের যোগসূত্র।
নদীর এক পাড় যখন গড়ে, তখন অন্য পাড়ে জমে ওঠে দীর্ঘশ্বাস। মাসি-বোনঝির বোঝাপড়া যখন মজবুত হচ্ছিল, ঠিক তখনই মিনির মায়ের বোধোদয় ঘটে। মিনি গোল্লায় যাচ্ছে, দিন-দিন মাসির মতোই হয়ে উঠছে। একপ্রকার জোর করে মিনিকে তার মাসির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় মা। এই দূরত্ব দুটি মানুষকে যেন আরও দূঢ় করে গড়ে তোলে।
আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ
স্কুলের ফ্যান্সি ড্রেস প্রতিযোগিতায় মাসির প্রচেষ্টায় জয়ী হয় মিনি। বন্ধুমহলে ভালোবাসা ফিরে পায় সে। ফিরে পায় জীবনের মূলস্রোতে এগিয়ে চলার আত্মবিশ্বাস। মিনির প্রচেষ্টাতেই তার মাসি মনের মানুষটিকে মনের মানুষকে (রুদ্রজিৎ) খুঁজে পায়। মেয়ে ও বোনের প্রচেষ্টাতেই মিনির মা আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, জীবনকে ভালোবাসে।
তিন নারীর জীবনে উত্তরণের গল্প বুনেছেন মৈনাক। বুনোটে কোথাও একটু অযত্ন থাকলেও মূল ভাবনা মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে অনায়াসেই।