চেনাশোনা জানার মাঝে লঘু রহস্য

ছবি: অপরিচিত

পরিচালনা: জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: ঋত্বিক চক্রবর্তী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, ইশা সাহা, সাহেব ভট্টাচার্য, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, প্রিয়া কার্ফা, ইসাডোরা বেকন

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৭ মিনিট 

RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆

যা কিছু আমরা দেখি সবই কি সত্যি? যেভাবে জীবন আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়, সম্পর্কের মোড়ক ধীরে-ধীরে উন্মোচিত হয় তাতে কতটা সত্যি আর কতটা মনগড়া ধারণা, সেই নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যায়। যেভাবে উল্টোদিকের মানুষটা আমাকে দেখতে চায় কিংবা আমি উল্টোদিকের মানুষটাকে দেখতে চাই এই সবটাই অনেকাংশে আমাদের ধারণার ওপর নির্ভর করে। হতে পারে সেই ধারণা সত্যি হয়ে জীবনভর এক আনন্দের আবহে ভাসিয়ে রাখে, ভরসা আর ভালোবাসায় তরতরিয়ে কেটে যায় একটা গোটা জীবনকাল। কিন্তু উল্টোটা হলে? একসঙ্গে পথ চলা সত্যিই সবসময় হয়তো তেমন সুখকর হয়ে ওঠে না। জয়দীপের নতুন ছবি সেই সম্পর্কের গোড়ার কথাই বলতে চেয়েছে রহস্যের সেলোফেনে মুড়ে।



ঘটনাক্রমের সঙ্গে একটু পরিচয় করানো যাক। লন্ডন শহর থেকে কিছু দূরে জঙ্গলের ভেতর এক দুর্ঘটনায় একটি গাড়ি খাদে গিয়ে পড়ে। দুর্ঘটনাস্থলের কিছু দূরে আহত অবস্থায় একটি লোককে পাওয়া যায়। তার মাথার আঘাত দুর্ঘটনা থেকে নয় বরং কোনও ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে করা হয়েছে। গাড়ির কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায় লোকটির নাম রঞ্জন ঘোষাল (ঋত্বিক)। দুর্ঘটনা ও আঘাতের রহস্য অনুসন্ধানে নামেন ব্রিটিশ পুলিশের বাঙালি আধিকারিক অভীক দত্ত (অনির্বাণ)। তদন্তে নেমে জানা যায় সেদিন গাড়িতে রঞ্জনের সঙ্গে ছিল তার স্ত্রীও। কিন্তু কোথায় সে? রঞ্জন তার জীবনের প্রায় কোনও কথাই মনে করতে পারে না। পুলিশের সন্দেহ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এমন সময় নিকটবর্তী অন্য এক থানায় এসে নিজের পরিচয় দিয়ে রঞ্জনের খোঁজ করে রিয়া ঘোষাল (ইশা) নামে একজন। ঠিক কী ঘটেছিল দুর্ঘটনার দিন? 

ছবির প্লট নানা অলঙ্কারে সাজানো হলেও গল্প মূলত চেনা। মাইকেল অ্যান্ডারসনের ‘Chase a Crooked Shadow’ হোক বা উত্তম-সাবিত্রী-শর্মিলার বিখ্যাত থ্রিলার ছবির ধাঁচ, দর্শককে চমকে দেওয়ার মতো দৃশ্য তেমনভাবে নেই। গল্পের মাঝামাঝি জায়গা থেকেই আন্দাজ করা যায় কী হতে চলেছে। তবে চিত্রনাট্যে তেমন নতুন কিছু না থাকলেও অভিনেতাদের দক্ষতা এবং ঝকঝকে মেকিং ছবিটিকে শেষ অবধি দেখার যোগ্য করে তোলে।

আরও পড়ুন: মুম্বইও কি “ঘটিয়া”? প্রথম ছবি মুক্তির আগেই পাততাড়ি গোটালেন অনুরাগ কশ্যপ

প্রশ্ন অন্য জায়গায়। একটা সময় ছিল যখন বাংলা ছবির গানের শুটিং হতো বিদেশে। মূলত ঝাঁ চকচকে লোকেশন আর বিখ্যাত মনুমেন্টের সামনে নায়ক নায়িকার নাচ অনেক ছবির গানকে হিটের মুখ দেখিয়েছে। কিন্তু ইদানিং বিদেশে গোটা ছবির শুটিং এক নতুন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবির ব্যবসার ক্ষেত্রে সেটা কতটা ছাপ ফেলে জানা নেই কিন্তু গল্পের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে আদৌ বিদেশের প্রয়োজন ছিল কি? রঞ্জন, রিয়া আর অভীকের গল্প কলকাতায় না হোক উত্তরবঙ্গে দিব্যি জমে যেত। তাহলে জোর করে সে গল্পকে বিদেশে নিয়ে যেতে হলো কেন?

চিত্রনাট্যে অতিরিক্ত টানটান ভাব বজায় রাখতে হিউমারের ছোঁয়া কমই রয়েছে, ফলে দর্শক দম নেওয়ার সুযোগ পাবে না। প্রথমার্ধে গল্পের গতি বেশ মন্থর। একটা সময়ের পর ক্লান্ত লাগতে পারে। ক্লাইম্যাক্স তেমন কোনও চমক দিতে পারে না কারণ অনেকটা আগে থেকে দর্শক বুঝতে পেরে যাবে অর্ধেক গ্লাস খালি মানে অর্ধেক গ্লাস ভর্তিও। এছাড়াও খুনের মোটিভ তেমন জোরালো নয়। যে ঘটনা এতকিছুর মূলে সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পিছনের কারণ আর একটু বড়ভাবে দেখানো যেতে পারত। আর সেই সূত্রে অরণ্যের (সাহেব) চরিত্র যা এই গল্পের একটা মূল ভিত সেটাকে আর একটু বিস্তারিতভাবে প্রতিষ্ঠা করলে ধোঁয়াশা কাটতে পারত।

আরও পড়ুন: হিন্দি টেলিভিশন ধারাবাহিকে অর্জুন চক্রবর্তী

অভিনয় এই ছবির মূল জোরের জায়গা। বলা যায় অভিনেতাদের কাঁধে ভর করেই গল্প এগিয়ে গিয়েছে। রঞ্জনের ভূমিকায় ঋত্বিক যথাযথ। সাময়িকভাবে স্মৃতি হারিয়ে ফেলা একজন মানুষ যখন অস্তিত্বের সঙ্কটে ভোগেন, সেই অসহায়তার জায়গায় ঋত্বিক যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য। শহুরে, স্মার্ট কাহিনিতে ইশা সবসময়ই সুন্দর মানিয়ে যান। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। স্বল্প পরিসরে কমলেশ্বর মানানসই। অরণ্যরূপে সাহেবও গল্পের ভারসাম্য রক্ষা করে গেছেন দক্ষতার সঙ্গে। অনির্বাণ আর কতবার পুলিশের চরিত্র করবেন কেউই জানে না। তবে তিনি নিজে প্রতিটি চরিত্রে আলাদা ছাপ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। আগাগোড়া অভীক চরিত্রের ঋজু ব্যক্তিত্ব আলাদাভাবে চোখে পড়বেই। তবে ভয় হয়, অনির্বাণ এবং ঋত্বিকের মতো অভিনেতাদের জন্য বাংলা ছবি আর কতটুকুই বা বৈচিত্র দিতে পারবে। ভালো অভিনেতাদের টাইপকাস্ট হয়ে যাওয়া বাংলা ইন্ডাস্ট্রির পুরনো রোগ। নিজের-নিজের চরিত্রে প্রিয়া এবং ইসাডোরা বেশ ভালো।

ছবির চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনা দুইই যথোপযুক্ত। চেনা প্লটে গল্প বুনতে গিয়ে দর্শককে খুব নতুন কিছু উপহার দেওয়া না গেলেও, প্রথমবার দেখায় অনেকেরই ভালো লাগবে আগাগোড়া রহস্যে মোড়া এই কাহিনি। জমাটি শীতের আবহে রহস্যপ্রিয় বাঙালি রঞ্জনা, রিয়া, অভীকদের কতটা আপন করে নেবে সেটাই দেখার।

Anurag Kashyap

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *