অশান্ত জমিতে শীতল শৈশবের প্রলেপ
ছবি: দোস্তজী
পরিচালনা: প্রসূন চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে: আশিক শেখ, আরিফ শেখ, স্বাতীলেখা কুন্ডু, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, জয়তী চক্রবর্তী
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট
RBN রেটিং: ৪/৫
যখন হাতে থাকা শেষ ঘুড়িটাও মাঞ্জার ধারে কেটে যায় তখন ঘুড়ি ওড়ানো চোখগুলো উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। যতদূর দেখা যায় চেয়ে থাকে সেই প্রাণপ্রিয় ঘুড়িটার দিকে। নীল আকাশের মায়া কাটিয়ে কে জানে কোন দেশে চলে যায় সে উড়ে। খাল, বিল, মাঠ ধানক্ষেত পেরিয়ে হয়তো পৌঁছে যাবে প্রতিবেশী দেশে। হয়তো কোনও অচেনা জায়গায়। পলাশ আর সফিকুলের ঘুড়িটা যেমন চলে গিয়েছিল।
সময়টা ১৯৯৩। অযোধ্যায় সদ্য ভাঙা হয়েছে বাবরি মসজিদ। সেই নিয়ে তেতে রয়েছে গোটা দেশের মুসলিম সম্প্রদায়। তারা চায় নতুন করে মসজিদ গড়তে। এমনকি বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামেও স্থানীয় উদ্যোগে চলছে ছোটা বাবরি মসজিদ গঠনের জন্য টাকা তোলা। বসে নেই হিন্দুরাও। মুসলমানরা ক্রমশ কোণঠাসা করছে তাদের। তাই যে করে হোক নিজেদের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে তারাও চায় রামসীতার মন্দির গড়ে তুলতে। উত্তপ্ত হতে থাকে গ্রামের পরিবেশ।
পলাশ আর সফিকুলের পৃথিবী এসব থেকে অনেক দূরে। একই দরমার বেড়ার দু’ ধারে থাকে দুই প্রাণের বন্ধু, একে অপরের ‘দোস্তজী’ (উচ্চারণে দোস্তোজী)। দুজনে একই ভ্যানগাড়িতে স্কুলে যায়, একই সঙ্গে হেঁটে-হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজে খেলে বেড়ায়। মাথা খাটিয়ে নানারকম অভিনব খেলা বার করে দুজনেই। কখনও হাটে গিয়ে টকটকি কেনে বা স্কুল পালিয়ে মেলায় গিয়ে বচ্চনের নির্বাক বায়স্কোপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। কোনওদিন মসজিদের বালি কুড়িয়ে নিয়ে ঝুলন সাজাতে চায় তো কখনও ঈদের দিন লুকিয়ে বন্ধুকে সিমাই খাওয়ায়। ঝগড়া হয়, সে ঝগড়া মিটেও যায়। এমন নিষ্কলুষ সখ্যের আশেপাশে অনেক রক্তচক্ষু থাকলেও তারা যেন কিছুতেই এদের মাঝে ঢুকতে সাহস পায় না।
আরও পড়ুন: শহরে পরীক্ষামূলক ছবির উৎসব
তারপর একদিন সব কেমন যেন থেমে যায়। থমকে যায় সফিকুলের জীবন। তবু সে নিজেকে হারায় না। সেই ভালোবাসা যা তারা গাছের গায়ে খোদাই করেছিল, তাকে ভোলে না সফিকুল। নিজেকে দিয়ে প্রমাণ করে ভালোবাসাই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে।
বাস্তবের কঠিন, অশান্ত জমিতে স্বপ্নের মতো এক বন্ধুত্বের বীজ বুনেছেন প্রসূন। শৈশব বুঝি এমনই হয়। নিষ্কলুষ, নির্ভেজাল। প্রেক্ষাপট তৈরি ছিল। কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষ যারা ধর্মস্থান ভাঙল, তাদের সঙ্গে সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়কে গুলিয়ে ফেলে প্রায় প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা, অন্যদিকে রাম মন্দিরের জন্য প্রতীকী রাম-রাবণের যুদ্ধের যাত্রাপালার ব্যবস্থা করে শক্তি প্রদর্শন, সবই নিজের নিয়মে এগিয়ে চলেছে। যদিও পুরোহিত নিজেই স্বীকার করেন ‘বাঙালি হিন্দুরা কোনওদিনই রামের পূজা করত না।’ তবু টিকে থাকতে গেলে তাই করতে হবে। অনেককেই করতে হয়। সহজ সরল শৈশব তো দূর এমনকি বিজ্ঞ পণ্ডিতেরাও যা বোঝে না, সে কথা শোনা যায় যাত্রাপালার রাম-রাবণের মুখে: ‘আমরা সবাই সবার শত্রু সাজি, পেটের জন্য। সাজতে হয়। আসলে কেউ কারও শত্রু নয়।’ দুই অবোধ শিশু না বুঝলেও দর্শকের কানে এসে চাবুকের মতো লাগবে এই সংলাপ।
আরও পড়ুন: একেন এবার রাজস্থানে
আগুন জ্বালাবার সবরকম প্রস্তুতি নিয়েও সে আগুনকে জ্বলতে দিলেন না পরিচালক। এরকম এক প্রেক্ষাপটে এই সংযম প্রশংসনীয় বটে! বন্ধুত্বের শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে গেল আপাত কঠিন ধর্মপ্রাণ, ও ধর্মান্ধ মানুষগুলোকেও। কাছে টেনে নিতে না পারলেও অবহেলায় দূরে সরাতেও পারল না কেউ। পলাশ আর সফিকুলের আদরের শুঁয়োপোকা যেদিন প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেল, সেদিন পলাশের মায়ের বুকফাটা কান্না স্পর্শ করে যায় দর্শককেও। স্যারের সঙ্গে আমবাগানে বেড়াতে গিয়ে সফিকুল যেন নতুন করে ফিরে পায় পলাশকে, অনেকটা মনখারাপের মধ্যেও এই দৃশ্য আরামের প্রলেপ লাগিয়ে যায়।
অভিনয় শিক্ষার পাঠশালায় একটি উক্তি হামেশাই শোনা যায়: ডোন্ট অ্যাক্ট, বিহেভ। এ ছবির শিল্পীরা তাই করলেন। একজনকে দেখেও মনে হলো না তাঁরা অভিনয় করছেন বা ছবির প্রয়োজনে কোনও দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। যেন সবই এইভাবে চলছিল, রোজই চলে। তারই মাঝে পরিচালক চুপি-চুপি ক্যামেরা নিয়ে কিছু দৃশ্য তুলেছেন। প্রতিটি দৃশ্য অসম্ভব প্রাণময়, বাস্তবের সঙ্গে যার তফাৎ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সে বাটনা বাটা হোক, গামছা তৈরি হোক বা ফেরিওয়ালার ডাক। চিত্রগ্রহণে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল এই ছবি। গ্রামদেশের বৃষ্টি, বিষণ্ণ বিকেল-সন্ধ্যা, গ্রাম্য পরিবারের রোজনামচা, হাটের কোলাহল, সমস্ত কিছুকে খুব যত্নে, নিটোলভাবে ক্যামেরায় ধরা হয়েছে। সংলাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যা সংযম দেখালেন পরিচালক, তা মনে রাখার মতো। বিরতির পর কিছু জায়গা সামান্য গতিহীন লাগলেও তা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
সব মিলিয়ে দৃষ্টি ও শ্রুতিমধুর ‘দোস্তজী’ বাংলার ছবির মানচিত্রে নিজস্ব ছাপ রেখে যাবে বলেই মনে হয়। প্রেক্ষাগৃহে দর্শক আনুকূল্য যথেষ্ট চিন্তার বিষয় হলেও দুটি শিশুর অটুট বন্ধুত্বের ছবি না দেখলে বেশ কিছু আবেগঘন মুহূর্ত হারাবেন বাংলার দর্শক।
যাঁরা বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান বলে আবেদন করেন, তাঁরা সত্যিই এ ছবির পাশে দাঁড়াবেন তো?