কৌতুকাভিনেতারা কি তবে শুধুই নায়কদের পরিপূরক?
RBN Web Desk: ‘রামগরুরের ছানা, হাসতে তাদের মানা, হাসির কথা শুনলে বলে হাসব না না না না’, সুকুমার রায়ের রামগরুরের ছানা হাসতে না চাইলেও বাংলা ছবির অসংখ্য কৌতুক অভিনেতারা চিরকালই আমাদের হাসিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেনও। দুই-আড়াই ঘণ্টার কোনও ছবির মধ্যে দশ মিনিটের একটি কৌতুক দৃশ্য ছবির বিনোদনের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয় অনেকটাই। এমনকি ‘সোনার কেল্লা’র মতো থ্রিলারেও কমিক রিলিফের জন্য বুদ্ধিদীপ্ত জটায়ুর চরিত্রটি যোগ করেন সত্যজিৎ রায়। অথচ সেভাবে কেন কোনও মৌলিক ছবিতে খুঁজে পাওয়া যায় না এই অভিনেতাদের? তবে কি সিনেমায় কমেডি শুধুই হ-য-ব-র-ল? এবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এমনই এক বিষয় নিয়ে জমে উঠেছিল সিনেআড্ডা। অংশগ্রহণ করেছিলেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, অম্বরীশ ভট্টাচার্য ও রজতাভ দত্ত। সূত্রধরের ভূমিকায় ছিলেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত।
বাংলা ছবিতে একজন কৌতুকাভিনেতার ভূমিকা ঠিক কতটা প্রশ্ন করলে উত্তর আসবে ‘অপরিসীম’। প্রসঙ্গে উঠে আসবে স্বর্ণযুগের বিশিষ্ট অভিনেতাদের নাম। কিন্তু বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা ছবির সুদর্শন নায়করা যখন ছবির গল্প এগিয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম, তখনই প্রয়োজন হয় একজন কৌতুক অভিনেতার। এমনটাই মনে করেন অম্বরীশ। তাঁর কথায়, “একজন নায়কের যখন কিছুই করার থাকে না, তখন পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার ছবিতে একটু কৌতুক গুঁজে দেন। আমি তো মনে করি আমরা কৌতুকাভিনেতারা নায়কদেরই পরিপূরক। আমরা অভিনেতা। দর্শক আমাদের যেভাবে দেখতে চাইবেন সেভাবেই আমরা নিজেদের উপস্থাপন করব।”
আরও পড়ুন: বছরের শেষে দুই ফেলুদা?
বাংলা ছবির জগতে যাকে স্বর্ণযুগ বলা হয়, সেই সময় শুধুমাত্র কৌতুকাভিনেতা নির্ভর মৌলিক ছবির সংখ্যা অনেক। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘ভানু পেল লটারি’, ‘মিস প্রিয়ম্বদা’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এধরণের অসংখ্য ছবি আজও সমান জনপ্রিয়। এমনকি মুখ্য অভিনেতার নামে ছবির নামকরণ বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভারতীয় ভাষার ছবিতে সম্ভবত নেই। তবু বর্তমানে শুধুমাত্র কৌতুকাভিনেতা নির্ভর মৌলিক ছবি তৈরি হয় না কেন?
“যে সময়ের কথা উঠছে তখন এই ছবিগুলির পাশপাশি একজন অভিনেতা পরপর বাণিজ্যিক ছবিতে সাফল্য এনে যাচ্ছেন। তিনি উত্তমকুমার। ফলে প্রযোজকরা এই ধরণের ছবি তৈরি করার ঝুঁকি নিতে পারতেন। কিন্তু এখন তো দর্শক হলে গিয়ে সেভাবে ছবিই দেখে না। ফলে এই ধরণের ছবি তৈরির ঝুঁকিও কেউ নিতে চাইছেন না,” জানালেন রজতাভ।
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
বাংলা ছবির সেকাল-একাল নিয়ে তর্ক চিরকালীন। বাঙালি স্বভাবতই নস্ট্যালজিয়াপ্রেমী। তাই পুরোনো কিছুকে নতুন করে আপন করতে চাইলেও অভিনেতারা ট্রোলিংয়ের সম্মুখীন হন। “আজ যদি অম্বরীশ কোনও ছবিতে হাম-হাম গুড়ি-গুড়ি নাচ করে তাহলে সবার আগে ওকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। কারণ তুলনা আসবেই,” বললেন বিশ্বজিৎ।
তবে কৌতুকের পিছনে থাকা সূক্ষ হাস্যরস বোঝার ক্ষমতাও সকলের নেই বলে মনে করেন পদ্মনাভ। তিনি বলেন, “‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে একটা দৃশ্যে ফেলুদা যখন জানায় তার ছাতি ও কোমর দুইয়েরই মাপ ছাব্বিশ ইঞ্চি তখন জটায়ু মজার ছলে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি শুয়োর? এখানে সুকুমার রায়ের ‘হ-য-ব-র-ল’-এর রেফারেন্সটা ক’জন জানেন? আমরা কোনও সংলাপ লেখার আগে ভাবি, দর্শক বুঝবে তো! কিন্তু সত্যজিৎবাবু ধরেই নিয়েছিলেন হ-য-ব-র-ল সবার পড়া।”
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
বাংলা ছবির কৌতুক বর্তমানে কিছুটা জোর করে হাসানো বলে মনে করেন অনকেই। ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’ বা ‘দাদার কীর্তি’র মতো রোমান্টিক কমেডি ছবিই বা কেন তৈরি হচ্ছে না? সুপরিচালক, ভালো লেখক, নাকি সুঅভিনেতা, কিসের অভাব?
প্রশ্ন শুনে সবাইকেই চিন্তিত দেখাল। কিছুক্ষণ থেমে বিশ্বজিৎ বললেন, “এটা আমরাও সঠিক জানি না। আমরাও আপনাদের মতোই এই একই কথা ভাবি।”
এই সময়ে দাঁড়িয়ে দর্শক কি তাহলে নির্ভেজাল হাস্যকৌতুক পাবেন না? নাকি কৌতুকাভিনেতারা আজ শুধুই নায়কদের পরিপূরক? এ প্রশ্নের সম্ভবত কোনও উত্তর নেই।
ছবি: গার্গী মজুমদার