আদিবাসী, জঙ্গল, জমিদখল, প্রতিবাদ

ছবি: মহানন্দা

পরিচালনা: অরিন্দম শীল

অভিনয়ে: গার্গী রায়চৌধুরী, দেবশঙ্কর হালদার, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, ঈশা সাহা, উজান চট্টোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১২ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

“মাটি আমার মা, মা-কে ছাড়ছি না।” এই মন্ত্রই তো বরাবর বলে এসেছে ভারতবাসী। সে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদই হোক বা দিকুদের বিরুদ্ধে বীরসা মুন্ডার উলগুলানের ডাক, নিজের জমির ওপর অন্যের দখলদারি বরদাস্ত করেনি কেউ। যুগ পাল্টেছে, পাল্টেছে শাসকদলও। কিন্তু পাল্টায়নি শাসনযন্ত্র, জমিদখলের ইতিহাস। এই ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে এক সাহিত্যিক, এক লেখিকার নাম। তিনি মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য। সারাজীবন তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন সত্যসমৃদ্ধ তথ্যকে। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগত, ইতিহাস তথ্যসমৃদ্ধ হলেও তার সত্যতা কতটা? তবে লেখিকার থেকেও বেশি, মহাশ্বেতা ছিলেন প্রতিবাদী।



সেই অচেনা, অজানা মহেশ্বেতাকেই অরিন্দম চেনালেন তাঁর ‘মহানন্দা’য়। মহাশ্বেতাই এখানে মহানন্দা ভট্টাচার্য। মহাশ্বেতার জীবনও তো নদীর মতোই বহমান ছিল। প্রান্তিক মানুষদের উন্নতির লক্ষ্যে আপন বেগে পাগল পারা হয়ে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে গেছেন। তাঁর সেই অদম্য মনোভাব এবং জীবনের কয়েকটা পাতা উল্টেপাল্টে দেখাল এই ছবি।

অনেকটা ‘জোর যার মুলুক তার’ মন্ত্রে ভর করেই ২০০৮ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এক বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিঙ্গুরে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে। উদ্দেশ্য, চাষের জমির উপর কারখানা নির্মাণ এবং প্রতিশ্রুতি বেকারের কর্মসংস্থান। অসংখ্য চাষী, সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে প্রতিবাদে। এই যুদ্ধে বহু সাধারণ মানুষের সঙ্গে পা মেলান মহানন্দা। নিজের সাহিত্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা বলতে গিয়ে মহানন্দা নিজেই নেমে পড়েন প্রতিবাদের মাঠে। ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়া, ভাঙাগড়া সবকিছুকে দূরে সরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন জঙ্গলের ‘নন্দা মা’।

আরও পড়ুন: বড়সড় চমক দিতে চলেছে ‘মিঠাই’, ঘুরে যাবে গল্পের মোড়

আলালের ঘরের দুলালী মহানন্দা ভালোবেসে বিয়ে করেন নাট্যকার বিধান ভট্টাচার্যকে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বিধানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন মহানন্দা। তাই হাজার অভাব থাকলেও কোনওদিন বিধানের হাত ছাড়েননি তিনি। কিন্তু সেই মনোভাবকে বিসর্জন দিয়ে বিধান যখন সিনেমার জন্য গল্প লিখতে শুরু করলেন, তখনই আঘাত পেলেন মহাশ্বেতা। স্বামী এবং ছেলে অর্ককে ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন দীর্ঘদিনের বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে। নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলেন জঙ্গলের মানুষদের কাছে। কিন্তু সেখানেও আবার আঘাত। যে জমি চাষ করে বাঁচে, সেখানে কারখানা হবে? এতে আদৌ উপকার হবে সাধারণ মানুষের? নাকি এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক দলের লোকেদের স্বার্থসিদ্ধি। কোথাও যেন ঘটনাটা আন্দাজ করতে পারছিলেন মহানন্দা।

আরও পড়ুন: কলকাতায় কেতন-রাজ, ‘তদন্তে’ চিরঞ্জিত

এরই মধ্যে এসে পড়ে মানসী হত্যাকাণ্ড। রাতের অন্ধকারে স্থানীয় মেয়ে মানসীকে ধর্ষণ করে জীবিত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়। দেখা যায় সেখানেও শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের হাত আছে। যে বামপন্থাকে নিজের আদর্শ মনে করতেন, সিঙ্গুরকাণ্ডে তাদের আচরণ দেখে দল ছাড়লেন মহানন্দা। পায়ের আঘাতে ভেঙে দিলেন সরকারের দেওয়া বেড়া। এগিয়ে গেলেন বীরদর্পে।

এই ছবি রাজনৈতিক। এ ছবি মহাশ্বেতা দেবীকে সামনে রেখে তুলে ধরে সিঙ্গুরকাণ্ড। নামভূমিকায় গার্গী অনবদ্য। তাঁর অভিনয় মুগ্ধ করে। ছবির অন্যতম দুই সম্পদ বিহান (অর্ণ) ও মহাল (ঈশা)। প্রেমিক বিহানের উৎসাহে মহানন্দার সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মহাল। ধীরে-ধীরে বুঝতে পারে রাজনৈতিক অসঙ্গতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিহানও।

আরও পড়ুন: কানে সত্যজিতের দশ

ঈশা এবং অর্ণর অভিনয় এই ছবিতে বিশেষ ভূমিকা রেখে যায়। বিধানের চরিত্রে দেবশঙ্কর ভালো। তবে কিছু ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণের প্রয়োগ কানে লাগে। স্বল্প পরিসরে উজান অনবদ্য। তাঁকে পর্দায় আরও কিছুক্ষণ পেলে ভালো লাগত।

শুভেন্দু দাশমুন্সির কথায় এবং বিক্রম ঘোষের সুরে ছবির গানগুলি ভীষণ যথাযথ এবং অর্থবহ। মতাদর্শ আলাদা হওয়ার কারণে মহানন্দার বিধানকে ছেড়ে চলে আসার সময় সাহানা বাজপেয়ীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার এই পথ’ ভীষণ উপযুক্ত।

আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন

এই ছবিতে আরেকজনের কথা বলতেই হয়। তিনি এই ছবির মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুন্ডু। মহানন্দার বেশি বয়সের প্রস্থেটিক মেকআপের পাশাপাশি মানসীর অগ্নিদগ্ধ দেহ দেখে গা শিউরে ওঠে। তবে প্রত্যন্ত গ্রামের আদিবাসী নাচের সময় মহিলাদের গায়ে ব্লাউজ এবং ম্যাচিং সোনালী গয়না কোথাও যেন একটু অতিরিক্ত সাজানো মনে হয়েছে। এক্ষেত্রে সাবর্নী দাস একটু নজর রাখতে পারতেন।

ইতিহাস, সত্য এবং সিনেমা এই তিনটি বিষয় এই ছবির মূল বক্তব্য। মহাশ্বেতা দেবীর জীবনী অবলম্বনে তৈরি এই ছবি কতটা ইতিহাসভিত্তিক তা দর্শক বলবেন। তবে ঘটনার বিস্তারিত ইতিহাস এবং ব্যক্তি মহাশ্বেতাকে চিনতে হলে একবার অন্তত ‘মহানন্দা’ দেখতেই হবে। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *