ঝকঝকে, আধুনিক, আগাগোড়া রাজনৈতিক ছবি
ছবি: ঘরে বাইরে আজ
পরিচালনা: অপর্ণা সেন
অভিনয়ে: অনির্বাণ ভট্টাচার্য, যীশু সেনগুপ্ত, তুহিনা দাস, অঞ্জন দত্ত, শ্রীনন্দা শংকর, সোহাগ সেন, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৬ মিনিট
RBN রেটিং: ৪/৫
‘আমি আগুনের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি; যা পোড়বার তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যা বাকি আছে তার আর মরণ নেই।’
উপন্যাসের পাতায় এ কথা ধ্বনিত হয়েছিল বিমলার কণ্ঠে, এখানে শোনা গেল অন্যভাবে নিখিলেশের গলায়। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৮৪-তে প্রথমবার সেলুলয়েডে মুক্তি পেয়েছিল ‘ঘরে বাইরে’। প্রকাশের ১০০ বছরেরও বেশী সময় অতিক্রম করে বড় পর্দায় এলে সে কাহিনীর আঙ্গিক যে বদলে যাবে তা বলাই বাহুল্য। সমাজের কোনও স্তরেই আজ নারী পর্দানশীন নয়। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের আগের বিমলা আর ২০১৯-এর বিমলার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই ভূমিকাটুকু বাদে শুরু থেকেই এ ছবির সঙ্গে মূল উপন্যাস বা আগের ছবিটির প্রসঙ্গ টানা বন্ধ করা যায় সচেতনভাবেই।
‘ঘরে বাইরে আজ’ একেবারেই স্বতন্ত্র একটি ছবি। নামেই স্পষ্ট এ ছবি আজকের, বর্তমান সময়ের। আরও ভালো করে বললে, বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির। যে পরিস্থিতির আঁচে এই মুহূর্তে দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা বেশ টালমাটাল, সেই উত্তপ্ত আবহাওয়া এই ছবির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় শুরু থেকেই।
দিল্লীর সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত সচেতন পরিবারের ছেলে নিখিলেশ (অনির্বাণ)। সে বিবাহ করে তার থেকে বয়সে অনেক ছোট একটি দলিত মেয়েকে যার নাম বিমলা (তুহিনা)। কোন পরিস্থিতিতে এই বিবাহ হয় তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন, কেন না নিখিলেশ বিমলাকে (পরে নাম পাল্টে বৃন্দা) ভালোবেসেছিল। ছোট থেকে নিখিলেশের পরিবারে মানুষ হওয়া বৃন্দাও নিজেকে যেভাবে তাদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিল তাতে করে কোনওদিক দিয়েই সে নিখিলেশের অযোগ্য ছিল না। সে নিজেও তার স্বামীর মধ্যে নিজের পৃথিবীকে দেখেছিল।
আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে
বর্তমানে নিখিলেশ ‘ইন্ডিয়া অনলাইন’ নামক সংবাদমাধ্যমের সদাব্যস্ত সম্পাদক। শুধুমাত্র দৈনিক সংবাদ সরবরাহ করা নয়, সমাজের প্রতি নৈতিক দায়িত্বের দিকটিও মাথায় রেখে চলে নিখিলেশ ও তার টিম। বৃন্দা এখন অক্সফোর্ড প্রেসের প্রুফরিডার। তবে সে বাড়িতে থেকে কাজ করতেই পছন্দ করে। কাজের চাপ সামলেও তার কাছে সংসার একটু বেশীই প্রিয়।
এই সময়ে দিল্লীতে এসে উপস্থিত হয় প্রফেসর সন্দীপ ঝা (যীশু)। ছাত্রজীবনে কট্টর বামপন্থী, পরে মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মেলালেও, বিহারের ছাপরা জেলার অধিবাসী সন্দীপ বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী পার্টির ধ্বজাধারী এক নামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নিখিলেশের বাল্যবন্ধু। ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে না থেকে সে নিখিলেশের বাড়িতে থাকাই সাব্যস্ত করে। দুই বন্ধুর স্মৃতিতে উঠে আসে নানান কথা। সন্দীপ, নিখিলেশ ও সামাইরার (শ্রীনন্দা) বন্ধুত্বের দিনগুলো আবার যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলেও কেউই তাদের মধ্যে বয়ে চলা বর্তমান বিপরীতমুখী আদর্শের ধারাকে ভুলতে পারে না। যদিও একে অন্যকে বুঝতে চায়, বোঝাতে চায় নিজের নীতিবোধের দিকটি, তবু যে যার আদর্শে অটল থাকে। এর মাঝে পড়ে বৃন্দা বুঝে নিতে চায় সন্দীপের বিশ্বাসের দিকটি। সে নিজে নিখিলেশের বিশ্বাসে নিজেকে জারিত করলেও কোথাও যেন তার মন ভিন্ন কথা শুনতে চায়, ভিন্ন আশ্রয়ে মাথা গুঁজতে চায়।
আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’
কাহিনীর মূল গতি সকলেরই জানা। তাই সেই বর্ণনা অতিদীর্ঘ না হওয়াই শ্রেয়। বরং নির্মাণ প্রসঙ্গে আসা যাক। পরিচালকের নাম যখন অপর্ণা সেন তখন বাড়তি একটা প্রত্যাশা থেকেই যায়। সে বিষয়ে তিনি নিজেও সচেতন। তাই অত্যন্ত যত্নে সাজিয়েছেন ছবির প্রতিটি দৃশ্যকে। এই অতি সচেতন সাজসজ্জা ছবির মূল গতিকে সামান্য হলেও বিঘ্নিত করে, যেন কিছুটা অগোছালো হলেও পারতো অন্দরমহলের দৃশ্যগুলি। তবে স্টাইলিশ ছবি বানানোয় অপর্ণা সিদ্ধহস্ত, তাই এই ছবি একদিক দিয়ে চোখের আরামও। প্রত্যেকটি দৃশ্যে সঠিক রঙের ব্যবহার এক একসময় ছবির থেকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয় মুগ্ধতায়।
মূল উপন্যাসের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী প্রেক্ষাপটকে ২০১৯-এ এনে ফেলতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই সঠিকভাবে করেছেন অপর্ণা। ধর্মের হাতে মানবিকতার হত্যা, রাজনীতির আড়ালে মানব সভ্যতার মৌলিক দিকগুলিকে অবহেলা, আদর্শের আড়ালে সুযোগের সদ্ব্যবহার, সবই পরিচালক দেখিয়েছেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। ছবিতে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের প্রসঙ্গকে তিনি যেভাবে এনেছেন তা দর্শককে মুহূর্তে স্তব্ধ করে দেয়। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য বস্তারের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নিখিলেশের কাজ করার দৃশ্যগুলি। বাস্তব ভারতের দরিদ্র গ্রামগুলির অবস্থা সাংঘাতিক প্রকট সৌমিক হালদারের ক্যামেরায়। তাই শুধুমাত্র এক শতাব্দী প্রাচীন উপন্যাসকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তুলে আনা নয়, বরং এ ছবি পরিচালকের অত্যন্ত স্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। ধর্ম ও স্বার্থের রাজনীতি করা কিছু মানুষের শোষণের ফলে অনাহারে অশিক্ষায় ও অপুষ্টিতে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে দরিদ্র ভারতবর্ষ, এ চিত্র খুব স্পষ্ট একাধিক ফ্রেমে। সিনেমা এমন এক মাধ্যম যেখানে সর্বসাধারণের কাছে খুব সহজে যে কোনও বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। পরিচালক সেটাই ব্যবহার করেছেন তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের জন্য, এবং তা এমনভাবে যাতে তা সর্বজনগ্রাহ্য হয়। তবে ছবির শেষ দৃশ্য কিছুটা অতিনাটকীয়। বাস্তবের সঙ্গে মেলালে তা খানিকটা আরোপিত লাগতে বাধ্য।
আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। অনির্বাণ তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে নিজের আগের ইমেজ ভাঙচুর করতেই অভ্যস্ত। তাই তিনি যে নিখিলেশের চরিত্রেও মানিয়ে যাবেন তা জানাই ছিল। যেটা দেখে চমকে যেতে হয় তা হলো তাঁর নিখুঁত ও ঝরঝরে ইংরেজি উচ্চারণ। না, তিনি কোথাকার ছেলে বা কোন মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। যা অবাক করে, তা হলো দিল্লীর সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবির ভূমিকায় অনির্বাণের শরীরী ভাষার আমূল পরিবর্তন। নিজের কাজে ডুবে থাকা তুমুল পেশাদার নিখিলেশের কথাবার্তা বা চলাফেরায় এমন এক ‘কেতা’ রয়েছে যা কিছুতেই ওয়েব সিরিজ়ের ব্যোমকেশ কিংবা নেতাজি গবেষক চন্দ্রচূড়কে মনে পড়তে দেয় না।
একইভাবে বলা যায় যীশুর কথাও। সন্দেহ ছিল সন্দীপের ভূমিকায় যীশু এবং নিখিলেশের চরিত্রে অনির্বাণের নির্বাচন কতটা সঠিক হবে সে ব্যাপারে। কিন্তু দুজনেই যে যার জায়গায় অনবদ্য। যীশুকে গোটা ছবি জুড়ে অসম্ভব সুদর্শন লেগেছে। সঙ্গে সন্দীপের ব্যক্তিত্বের ক্রুরতার ছোঁয়াকে তিনি সযত্নে লালন করেছেন নিজের দৃষ্টিতে। সব মিলিয়ে সন্দীপকে এত বিশ্বাসযোগ্যভাবে এই মুহূর্তে আর কেউ পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন কিনা সন্দেহ।
আলাদাভাবে প্রশংসার দাবী রাখেন তুহিনাও। তাঁর ক্লাসিক ভারতীয় সৌন্দর্যকে পরিচালক প্রত্যাশামতোই ব্যবহার করেছেন প্রতিটি দৃশ্যে। দুই অভিজ্ঞ অভিনেতার মধ্যে পড়েও কোথাও বেমানান লাগেনি তাঁকে। বরং দুই বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্বের মাঝের ভারসাম্য তিনি রক্ষা করেছেন অনায়াস দক্ষতায়।
আরও পড়ুন: যে মৃত্যু আজও রহস্য
সামাইরার চরিত্রে শ্রীনন্দা বেশ ভালো। ভবিষ্যতে আরও বড় চরিত্র সামলাতে পারবেন তিনি। অমূল্যর ভূমিকায় ঋতব্রত অত্যন্ত সপ্রভিত। তবে প্রবীণ প্রফেসরের চরিত্রে অঞ্জনের বিশেষ কিছু করার ছিল না। তাঁর প্রফেসর সুলভ নতুন চেহারা পর্দায় দেখতে ভালো লাগে। প্রবীণ সমাজকর্মী হিসেবে সোহাগ সেনের অভিনয় নিশ্চিতভাবে দর্শকের বিবেককে জাগিয়ে তুলবে।
নীল দত্তর সঙ্গীতে রাগাশ্রয়ী সুর ও বিদ্যাপতির পদের ব্যবহার ছবির মেজাজকে ঋদ্ধ করে। রশিদ খান ও মনোময় ভট্টাচার্যর কণ্ঠের গান শ্রুতিমধুর।
উপসংহারে বলা যায় ছবির নির্মাণ অত্যন্ত ঝকঝকে ও সময়োপযোগী হলেও কাহিনীর পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে কিছু জায়গায় বাস্তবকে অস্বীকার করা হয়েছে। নিখিলেশ ও বৃন্দার বিবাহ কিছুটা আরোপিত লেগেছে। সামাজিক সচেতনতা বোঝাতে বৃন্দাকে দলিত সম্প্রদায়ের মেয়ে না করলেও চলতো। সে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও ওই প্রেক্ষাপটে অন্যভাবে সার্থক বিমলা হয়ে উঠতে পারতো। তবে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘ঘরে বাইরে আজ’ যেভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক স্পষ্ট বার্তা তুলে ধরে, তাতে আরও বেশি করে এই ধরণের ছবি তৈরি হওয়া প্রয়োজন।