রক্তের দাগে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ
ছবি: ব্যোমকেশ গোত্র
নির্দেশনা: অরিন্দম শীল
অভিনয়ে: আবির চট্টোপাধ্যায়, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, সোহিনী সরকার, অর্জুন চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, প্রিয়াঙ্কা সরকার, হর্ষ ছায়া, সৌরসেনী মৈত্র
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ১৫ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
গল্প ছিল কলকাতার, ছবি গেল মুসৌরিতে। কিন্তু তাতে কি? সত্যবতী বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। সে রাজস্থান হোক বা কাশ্মীর, কোথাও একটা গেলেই সে খুশি। অগত্যা জনৈক সত্যকাম দাস যখন তাঁর অবশ্যম্ভাবী খুনের তদন্তের জন্য ব্যোমকেশ বক্সীকে আগাম পারিশ্রমিক দিয়ে যায়—তখন গল্পটা কলকাতার বাইরে ফেললে বেশ একটা পুজোর ছুটির বেড়ানো, সঙ্গে বিদেশে গিয়ে রহস্যভেদ, আর সত্যবতীরও ইচ্ছাপূরণ—মানে এক ঢিলে তিন পাখি মারা যায়। তাই কলকাতার সুচিত্রা এম্পোরিয়ম উঠে এল মুসৌরিতে। চোখের পুষ্টির জন্য এটুকু করাই যায়।
ছবির শুরুতেই ট্রেন ছুটল দেরাদুন। ভারী সুন্দর দৃশ্য। যদিও ২০১৮-এর ইলেকট্রিক ট্রেনকে ১৯৫২ সালের স্টিম ইঞ্জিনের রূপ দিতে গিয়ে ভিএফএক্স-এর ধোঁয়া যোগ করতে হয়েছে, তবু দুপাশের খোলা প্রান্তর সমেত ট্রেনের দৃশ্য সত্যিই আকর্ষণীয়। ভালো লাগে ড্রোনের মাধ্যমে লেন্সবন্দী করা মুসৌরির পাকদন্ডি। পরিচ্ছন্ন ও সাজানো জায়গা হিসেবে বিখ্যাত ক্যামেল ব্যাক রোডকে অরিন্দম সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন দৃশ্যে। এছাড়া পাহাড়ি রাস্তায় চেজ় সিনও বেশ রোমাঞ্চকর।
তবুও একটা খটকা।
ছবির সময়কাল ১৯৫২। শুরুতেই ব্যোমকেশের কেয়াতলার বাড়িতে বসে সত্যকাম বলছে তাঁর জন্ম ১৯২৭-এ। অর্থাৎ এখন তাঁর বয়স ২৫। এদিকে ব্যোমকেশ ও অজিতের কথায় উঠে আসে দিল্লিতে বল্লভভাই প্যাটেলের সরকারের কথা। কিন্তু ১৯৫২-তে প্যাটেল কিভাবে দিল্লিতে থাকবেন? তাঁর তো মৃত্যু হয় ১৯৫০-এ।
যাই হোক, তথ্যের এই সামান্য ভুল ছবিকে কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
যে মৃত্যু আজও রহস্য
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী রক্তের দাগ ছবির প্রয়োজনে কিছুটা পাল্টেছে। সেটুকু না করলে ছবি সিনেমা হয়ে ওঠে না। খুন ও খুনের কারণ অপরিবর্তিত রয়েছে। যাঁরা গল্পটি পড়ে ব্যোমকেশ গোত্র দেখতে যাবেন, আনুষঙ্গিক কিছু জিনিস হয়ত তাঁদের চোখে লাগতে পারে। কিন্তু ছবির প্রয়োজনে সেটুকু মেনে নেওয়াই যায়। যেমন ব্যোমকেশ-সত্যবতীর পুত্র অর্থাৎ খোকার অনুপস্থিতি। গল্পে খোকার কথা রয়েছে। ছবিতে কোথাও খোকা তো এলই না, এমনকি তার প্রসঙ্গও উঠল না। ব্যোমকেশ ও সত্যবতী আগাগোড়া নবদম্পতির মত প্রেমে ভেসে রইল।
ছবিতে নতুন অজিত রূপে এসেছেন রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়। এযাবৎ ঋত্বিক চক্রবর্তীকে অজিত হিসেবে আবিরের পাশে দেখা গেছে। শুরুতে তাঁর অভাব কিছুটা বোধ হলেও রাহুল সেটা পুষিয়ে দিয়েছেন তাঁর অভিনয় দক্ষতায়।
যে জন থাকে মাঝখানে
সত্যকাম যে কামুক ও লম্পট তা শরদিন্দু গল্পেই লিখে গেছেন। যেটা লিখে যাননি, সেটা দেখালেন পরিচালক। পঁচিশ বছরের সদ্য যুবা সত্যকাম রাস্তার মধ্যে ছয়-সাতজন গুন্ডাকে একা হাতেই শায়েস্তা করেন. অস্ত্র বলতে শুধু একটি মাফলার। সত্তর দশকের হিন্দী ছবি মনে করিয়ে দিল এই দৃশ্যটি। আবার আবির ও রাহুলের অ্যাকশন দৃশ্য যথেষ্ট উপভোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য।
আবির সুদর্শন অভিনেতা। কিন্তু যেখানে সত্যবতীকে ব্যোমকেশের সামনেই অপমানিত হতে হয়, সেখানে স্বামী হিসেবে আর একটু জ্বলে ওঠা উচিত ছিল আবিরের। তার চোখে সেই রাগ কোথাও দেখা গেল না। বড় বেশি সচেতন ও ভাবলেশহীন যেন ব্যোমকেশ। কিন্তু প্রেমের দৃশ্যে তিনি সপ্রতিভ। সোহিনী বরাবরই তাঁর চরিত্রের প্রতি সুবিচার করে এসেছেন।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
কিন্তু অবাক করলেন যিনি, তিনি সত্যকামরূপী অর্জুন চক্রবর্তী। চরিত্রের প্রয়োজনে সত্যকাম যেমন হওয়া উচিত, বলা বাহুল্য অর্জুনকে সেখানে মানায় না। বয়স যাই হোক, অর্জুনের চেহারায় এখনও কিশোরছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সেই অভাব তিনি পূরণ করলেন দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে। মেকআপ তাকে সাহায্য করেছে লম্পট ও ধূর্ত সত্যকাম হয়ে উঠতে। বাকিটা অর্জুন করলেন তার চোখ ও হাসি দিয়ে। শানিত দৃষ্টি ও ধারালো সংলাপ দিয়ে প্রতিটা দৃশ্যে তিনি ছাপ রেখে গেলেন অভাবনীয় ভাবে। সত্যকামের পাশে ব্যোমকেশও যেন কিছুটা ফিকে।
অঞ্জন দত্ত প্রত্যাশামতই দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঊষাপতির বাইরের কাঠিন্য ও ভেতরের হতাশা। সুচিত্রা দেবীর চরিত্রে বৈশাখী মার্জিত অসম্ভব সংযত ও অনবদ্য। তাঁর কমবয়সী চরিত্রে অনিন্দিতা বসুকে অল্প সময়ের জন্য এলেও ভালো লাগে। পুরন্দর পান্ডে রূপে হর্ষ ছায়া আগের মতই মানানসই। প্রিয়াঙ্কা ও সৌরসেনী দুজনেই যথাযথভাবে চরিত্রের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। শিতাংশুর ভূমিকায় সুপ্রভাত দাস নিঃসন্দেহে ভালো অভিনেতা। আগামীদিনে আরও ভালো চরিত্র অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
তবে ছবির শেষে সত্যকামের চরিত্রের খারাপ দিকগুলো ব্যোমকেশ যেভাবে জাস্টিফাই করে সেটা হয়ত না করলেও চলত। কারণ শরদিন্দু নিজেই তা করেননি। আর অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে ব্যোমকেশকে যে নীতিজ্ঞান দেওয়া হল সত্যবতী ও অজিতের মাধ্যমে, সেটা বোধহয় না দিলেও চলত। ব্যোমকেশের পাঠক মাত্রেই জানেন যে সত্যান্বেষী কখনওই তাঁর কোনও তদন্তে মানবতার দিকটি অস্বীকার করেননি। অজিত ও সত্যবতীর কথা শুনে ব্যোমকেশ বক্সী তাঁর মানবতার কর্তব্য স্থির করছেন, এটা মেনে নিতে একটু অস্বস্তি হয়।
বিক্রম ঘোষের সঙ্গীত এ ছবির সম্পদ। সঙ্গীতের ক্রেডিট লাইনে বৈশাখী মার্জিতর নাম দেখে অবাক হতে হয়। কিন্তু যে সমস্ত কঠিন রাগের আলাপ শোনা গেল তাঁর কণ্ঠে সেগুলি সত্যিই অসাধারণ। বৈশাখীর কাছে আগামীদিনে সঙ্গীত জগতের আরও প্রত্যাশা রইল। প্রিয়াঙ্কার লিপে উজ্জয়িনীর গানটিও শুনতে বেশ ভালো লাগে।
বছরে একটি করে ব্যোমকেশের ছবি উপহার দেওয়ার যে ধারা অরিন্দম শুরু করেছেন তা এভাবেই চলতে থাকুক। দর্শক মুখিয়ে থাকবেন এমন গোছানো একটি পিরিয়ড পিস দেখতে। শুধু অরিন্দমের মতো সু-অভিনেতাকে গোটা ছবিতে ছবি হয়ে থাকতে হলে তা দর্শকের দুর্ভাগ্য। আশা করা যায় পরিচালক মাঝে মাঝে অভিনেতাও হয়ে উঠবেন।