সেই মোটামুটিই থেকে গেল

ছবি: ফাটাফাটি

পরিচালনা: অরিত্র মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে:  ঋতাভরী চক্রবর্তী, আবীর চট্টোপাধ্যায়, সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বস্তিকা দত্ত, লোকনাথ দে, রক্তিম সামন্ত, অরিজিতা মুখোপাধ্যায়, সংঘশ্রী সিংহ মিত্র, দেবশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, অস্মি ঘোষ

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১১ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆

ছত্রিশ-চব্বিশ-ছত্রিশ। সুতনুর অধিকারিণীদের সংজ্ঞা হিসেবে এই মাপটাই চিরচেনা। এর থেকে একচুল এদিক ওদিক বাড়লেই গেল-গেল রব। আর যাঁরা চিরকালই মোটা? তাঁদের প্রতিনিয়ত ঠিক কী-কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়? এসব নিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কথা হলেও মূল সমস্যা কোথায় এবং ঠিক কীভাবে তা পরিবর্তন করা যায়, তার উত্তর পাওয়া যায় না। আজকের দিনে চারদিকে তাকালে স্থূলকায় মহিলাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর তাঁদের সাধারণ গড়পরতা জীবনের মোটামুটি গল্প নিয়েই অরিত্র বানালেন তাঁর তৃতীয় ছবি ‘ফাটাফাটি’।



সিনেমার নায়িকা মানেই আমাদের চোখে ভাসে তন্বী, সুন্দরী। গা থেকে মোমের মতো আলো পিছলে পড়ে। সেইদিক থেকে এই ছবির কেন্দ্রবিন্দু একজন ৯৫ কেজি ওজন সম্পন্না গৃহবধূ ফুল্লরা ভাদুড়ি (ঋতাভরী)। অবশ্য সেও সুন্দরী। তবে এই ওজনের জন্য তাকে সব জায়গাতেই নিরন্তর নির্যাতিত হতে হয়। এমনকী সন্তানহীনতার কারণ হিসাবেও ডাক্তারবাবু তার এই ওজনকেই দায়ী করে। অবশ্য এখানে বিজ্ঞানকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও ডাক্তার তাকে ওজন কমাতে বলায় ফুল্লরা বলে সমস্যাটা তার পেটে। সেদিকে অতিরিক্ত ওজনের কারণেও তার জরায়ু বা ডিম্বাশয় সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। অন্যদিকে ফুল্লরার শাশুড়ি (সোমা) তাকে যথেষ্ট ভালোবাসলেও তা দেখাতে চান না। হয়তো নাতি-নাতনির মুখ দেখতে না পারার আক্ষেপ তাকেও কোথাও কুরে-কুরে খায় আর সেই যন্ত্রণা থেকে তিনিও বৌমাকে কথা শোনাতে দ্বিধাবোধ করেন না।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে সব প্রেক্ষাগৃহে হাউজ়ফুল ‘পাঠান’

ফুল্লরার স্বামী বাচস্পতি (আবীর) সবসময় তার পাশে থাকে। আর আছে ফুল্লরার একমাত্র গুণমুগ্ধ  লক্ষণ দেবর গোগোল (রক্তিম)। আসলে সে নিজেও বেশ গোলগোল। তার বিশ্বাস, বৌমনি মোটা হতে পারে কিন্তু জীবনযুদ্ধে কারও থেকে সে কোনও অংশে কম নয়। ফুল্লরা আদতে একজন সীবনিশিল্পী। কাপড় কেটে, সূক্ষ্ম মাপ নিয়ে সে পোশাক বানায়। পরিচিত মহলে তার বেশ নামডাক। ফুল্লরার কাছে জীবনের সব না পাওয়ার খামতি পূরণ অনেকটা এই সেলাই দিয়েই হয়। একটা গোটা কাপড় থেকে নিপুণ হাতে মাপ নিয়ে যত্ন সহকারে সে যখন প্লাস সাইজ়ের পোশাক বানায়, সেটাই তার জয় বলে মনে হয়। কাঁচি দিয়ে বাড়তি কাপড়ের মতোই কেটে ফেলে দেয় প্রতিবেশী বিকির (স্বস্তিকা) গা জ্বালানো মন্তব্য। বিকিরণবালা ওরফে দ্য বিকি সেনের মতে মোটা মানুষের ফ্যাশন করার অধিকার নেই। র‍্যাম্পে হাঁটা তো তাদের কাছে কুঁজোর চিত হয়ে শোওয়ার মতো। কিন্ত সত্যিই কি তাই? হঠাৎই সমাজের ছকে দেওয়া নির্দেশের মুখে ঝামা ঘষে প্লাস সাইজ়ের মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ফুল্লরার।

মোটামুটি জীবনের রাস্তায় চলা ফুল্লরা কীভাবে রাতারাতি মিস ফাটাফাটি হয়ে ওঠে সেই গল্পই বলেছেন অরিত্র।

আরও পড়ুন: জয়সলমেরে সত্যজিৎ রায়ের মূর্তি, উদ্যোগী রাজস্থান সরকার

এ তো গেল গল্প। এবার আসা যাক অভিনয়ের কথায়। ফুল্লরার ভূমিকায় ঋতাভরী বেশ ভালো। আসলে ছবির জন্য তো তিনি চেহারা ভারী করেননি। ব্যক্তিগত কারণে হঠাৎই তার ওজন বৃদ্ধি হওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর ট্রোলের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। এই অভিনয় যেন সেই অপমানেরই জবাব। ফুল্লরার স্বামীর ভূমিকায় আবীরের বিশেষ কিছু করার ছিল না। অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পুরুষ বাচস্পতি। একদিকে স্ত্রীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে চায় আবার চাকরি চলে যাওয়ার সেই স্ত্রীর টাকায় বাজার করতে তার পৌরুষে লাগে। পরবর্তীকালে কলকাতার নামকরা শপিং মলে তার চাকরি হয়। সেখানেও ফুল্লরার একটু অবদান ছিল। কিন্ত সেটা স্বীকার করতে তার মন মানেনি।

বিকিরণবালার ভূমিকায় স্বস্তিকা বড্ড চড়া দাগের অভিনয় করেছেন। ইদানীং তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি সব একই ধরণের। শাশুড়ি হিসেবে সোমার অভিনয় মানানসই। ভালো লাগে রক্তিমের অভিনয়। অন্যান্য চরিত্রে অরিজিতা, সংঘশ্রী, দেবশ্রী যথাযথ। ছবির গান ভালো।



তাহলে কেমন হলো ‘ফাটাফাটি’? কথায় বলে, সাইকেল আর সাঁতার যে একবার শেখে সে কোনওদিন ভোলে না। সংঘশ্রী অভিনীত চরিত্রটি এককালে খুব ভালো সাইকেল চালাতেন। কিন্তু ছবির শুরুতে দেখানো হলো মোটা বলে ভারী চেহারার জন্য তিনি এখন সাইকেল চালাতে গেলেই পড়ে যাচ্ছেন। এদিকে বাস্তবের রোজনামচায় অহরহ প্রচুর মোটা মহিলা ও পুরুষ সাইকেলের প্যাডেল ঘুড়িয়ে জীবিকা অর্জনে বেরোচ্ছেন। আবার ছবির শেষ দৃশ্যে সেই চরিত্রই দুর্দার সাইকেল চালিয়ে বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাস ধরে ফেলছেন। বাস্তবনির্ভর ছবি করতে গেলে এই মেলোড্রামাগুলো বাদ দেওয়া প্রয়োজন।

মোটা মেয়ে নায়িকা এই প্রথম নয়। এর আগে হিন্দিতে ও বাংলাতে এধরণের অনেক ছবি হয়েছে। তবে এই গল্প সব স্থূলকায় মানুষের কথা বলতে গিয়ে কোথাও যেন সেই পারিবারিক গল্পে ঢুকে গেল। সমাজের সকল মানুষ বিকি নয়। মোটা বলে শুধু মেয়েদেরই অসম্মানিত হতে হয় না। বহু পুরুষ আছেন যাঁরা মোটা বলেই হাসির খোরাক। একাধিক বাংলা ছবিতে বহু মোটা মহিলা ও পুরুষকে সস্তা কমেডির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, এখনও হয়। শুধুমাত্র পোশাক বা রূপ দিয়ে এই স্থূলতাকে বিশ্লেষণ করা যায় না। সেক্ষেত্রে যাঁরা ভীষণ রোগা, তাঁদেরও পছন্দের জামাকাপড় পাওয়া ভীষণ সমস্যার। এই সমস্যা অনেক গভীর। সবার জীবনে বিকি থাকে না যে তাকে উত্তর দিতেই নিজের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। একজন মোটা মানুষ বিশাল বড় কিছু না করলে সমাজ তাকে গ্রহণ করবে না? আজ ফুল্লরা মিস ফাটাফাটি না হয়ে শখের দর্জি হলে কি তাকে সমাজ এত প্রশ্রয় দিত? নাকি সারাদিন ‘ঢেপসি’, ‘হাতি’ এসব বিশেষণ শুনেই দিন কাটাতে হতো। সবাই তো সেলিব্রিটি হতে পারবে না। তাহলে তাদের কী হবে?

তাই সমস্যার জন্য নিজেকে বদলানো প্রয়োজন। চলচ্চিত্র যদি সমাজের আয়না হয় তাহলে সবার আগে গল্প বলার ধরণ বদলানো দরকার। সিনেমার নামে সিরিয়াল বানানো বন্ধ হোক। সব মিলিয়ে অরিত্রর ‘ফাটাফাটি’ কোনওভাবেই ফাটাফাটি হতে পারল না। সেই মোটামুটিই থেকে গেল।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *