বাস্তবতার আড়ালে কল্পনার গোপন রং
ছবি: বিনিসুতোয়
পরিচালনা: অতনু ঘোষ
অভিনয়ে: জয়া আহসান, ঋত্বিক চক্রবর্তী, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, স্যমন্তকদ্যুতি মৈত্র
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৩৪ মিনিট
RBN রেটিং: ৪/৫
বরাবরই সম্পর্কের গল্প বলতে ভালোবাসেন অতনু। তাঁর নতুন ছবি ‘বিনিসুতোয়’ও এর ব্যাতিক্রম নয়। তবে এখানে সম্পর্কের সমীকরণ আলাদা। দুই কেন্দ্রীয় চরিত্রের পূর্ব পরিচয় নেই, আলাপ নেই, এমনকি বন্ধুত্বও নেই। তবু এক অদ্ভুত সম্পর্কের সমীকরণে জড়িয়ে পড়ে তারা। আর এখানেই এই ছবির নামকরণ স্বার্থক।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে শশব্যস্ত। মাঝেমধ্যেই ভুলে যাই আমরা আসলে কিসে খুশি হই, আনন্দ পাই। কাজল ও শ্রাবণী সমাজের একই শ্রেণীর মানুষ। ‘কে জিতবে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা’ প্রতিযোগীতায় দুজনের দেখা হয়। নিছক কাকতলীয়ভাবেই কিছু সময়ের জন্য আলাপও ঘটে যায়। কাজল এবং শ্রাবণী দুজনেরই টাকার দরকার। কিন্তু এত টাকা নিয়ে তারা কী করবে, সেই বিষয়ে তাদের বিশেষ কোনও ধারনা নেই। সকালে মেয়ের পছন্দের ফুলদানি ভেঙে ফেলায় তার সঙ্গে খানিক রাগারাগি হয় শ্রাবণীর। স্থানীয় দোকানে সেই ভাঙা ফুলদানির অনুরূপ আরেকটি খুঁজতে গিয়ে সে জানতে পারে এরকম ফুলদানি দিল্লীর একটি শহরে পাওয়া যায়। অন্যদিকে বান্ধবী অন্তরার জমানো পঞ্চাশ হাজার টাকা হারিয়ে ফেলে কাজল। এরই মধ্যে রাস্তায় পড়ে গিয়ে চোট পান শ্রাবণী। তাকে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় শ্রাবণীর ব্যাগে রাখা একটি মোটা পাঁচশো টাকার বান্ডিলে চোখ পড়ে কাজলের। ইচ্ছা এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে টাকাটা চুরি করতে পারে না।
আরও পড়ুন: টেলিভিশনে ‘সত্যজিৎ একাই ১০০’, থাকছে তাঁর ক্রিপ্টোগ্রাফির কথাও
এই পর্যন্ত গল্পটা দিব্যি এগোচ্ছিল। কিন্তু কাজলের বান্ধবীকে নিজের ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ে গল্পের ছন্দপতন ঘটাল শ্রাবণী। কাজল অস্বীকার করে এই কথা। করবে নাই বা কেন! অন্তরা তো কাজলের কল্পনা মাত্র। এক বিরাট কোম্পানির সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাজলের শখ গল্প বলা। বাড়িতে, রাস্তাঘাটে যখন যেভাবে ইচ্ছা লোকের সঙ্গে সে এভাবে আলাপ জমায়। কল্পনার ডানায় ভর করে তার গল্পগুলো এগোতে থাকে। তবে এই প্রথম সে ঘাবড়ে যায়। নিছক কৌতূহলের কারণে সে সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রাবণীর খোঁজ করে। জানতে পারে শ্রাবণী কলকাতার এক নামকরা চা কোম্পানির অন্যতম মালকিন। তারও ওই এক শখ, গল্প বলা। বৈবাহিক জীবনে অসুখী বিপুল সম্পত্তির মালিক শ্রাবণী ভালোবাসে সাধারণ জীবনের গল্প বলতে। একটা সময় দুজনেই দুজনের খেলা ধরে ফেলে। কী হয় এরপর? দুই কথকের কাছাকাছি আসা কি তবে নিছকই দেখার দেখা? নাকি কোনও অদ্ভুত এক বিনিসুতোয় আটকে আছে তাদের জীবন?
বহু পরিচালকই আজকাল তাঁদের ছবিতে গল্প বলতে ভুলে যান। ড্রামা, মেলোড্রামা, থ্রিলার, মার্ডারের বাইরেও যে ছবির মাধ্যমে একটা গল্প বলা যায় তা আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চোখে পড়ে না। সেই গল্প বলার কাজটাই করলেন অতনু। তাঁর ‘ময়ূরাক্ষী’ বা ‘রবিবার’-এর মতোই ‘বিনিসুতোয়’ অত্যন্ত সাধারণ গল্পনির্ভর এক অসাধারণ ছবি। বাস্তবতার আড়ালে কল্পনার গোপন রং মিশেছে ‘বিনিসুতোয়’। তার একপিঠে রয়েছে গল্প বলার মুন্সিয়ানা আর অন্য পিঠে অভিনয়। কাজলের চরিত্রে ঋত্বিক এবং শ্রাবণীর চরিত্রে জয়া আরও একবার প্রমাণ করলেন তাঁরা জাতশিল্পী। কাজলের স্ত্রীর চরিত্রে স্বল্পপরিসরে চান্দ্রেয়ীর অভিনয় প্রশংসাযোগ্য। ভালো লাগে শিশুশিল্পী সামন্তকের অভিনয়। অথিতি শিল্পী হিসেবে কৌশিক সেন ও রেশমী সেন যথাযথ। ছবির আবহসঙ্গীত দেবজ্যোতি মিশ্রের। রূপঙ্কর বাগচী এবং ইমন চক্রবর্তীর গলায় গানগুলি শ্রুতিমধুর। তবে মন জয় করে জয়ার নিজস্ব কণ্ঠে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত।
প্রথমার্ধে ‘বিনিসুতোয়’ কিছুটা ধীর গতির মনে হতে পারে। কিন্তু ভালো গল্প তো আর তাড়াহুড়ো করে বলা যায় না, তাই এটুকু ধৈর্য ধরাই যায়। খুব নিপুণভাবে কাহিনীর জাল বুনেছেন অতনু। ভালো লাগে মিথ্যে গল্প বলার সময় আসল পরিচয় প্রকাশ। আসলে কাজল বা শ্রাবণী এরা দুজনেই হয়তো খুব সাধারণ জীবন চেয়েছিল। কেউ কিচেন চিমনির সেলসম্যান হয়েই খুশি তো কেউ বা স্কুল শিক্ষিকা। তাই তারা নিজেদের পরিচয়ের আড়ালে তৈরি করে সাধারণ মানুষের গল্প। এ যেন তাদের একঘেয়ে রোজনামচার আড়ালে নিজেদের মতো করে বাঁচার কাহিনী।
‘বিনিসুতোয়’-এর শেষটা চমকপ্রদ। শুধুমাত্র শেষটুকুর জন্যই এ ছবি মনে দাগ কেটে যাবে। এই দৃশ্যের জন্য পরিচালককে কুর্নিশ। যদিও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে অন্তরে অতৃপ্তি থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পরিপূর্ণ ‘বিনিসুতোয়’ বাস্তব এবং পরাবাস্তবের মেলবন্ধন, যার রেশ রয়ে যাবে বহুক্ষণ।